এখনও পর্যন্ত আমাদের রাজ্যে সিবিআই এমন কিছু করে দেখাতে পারে নি যাতে সংস্থাটির উপর ভরসা করা চলে। বরং ঘটনা পরম্পরা অনেক অপ্রিয় প্রশ্ন তোলার সুযোগ করে দিচ্ছে। একটি প্রতিবেদন-
পশ্চিমবঙ্গে এখন ঠিক কতগুলো মামলার তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে তা সংস্থাটির আধিকারিকদেরও বোধ হয় খাতা দেখে গুণে বলতে হবে। ভোট পরবর্তী রাজনৈতিক হিংসা, ঝালদার কংগ্রেস কাউন্সিলর খুন এবং বগটুই গণহত্যাকান্ডের মতো ফৌজদারি মামলার পাশাপাশি গরুপাচার, কয়লাপাচারের মতো ঘোটালা। আবার স্কুল সার্ভিস কমিশনের মতো স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ দুর্নীতি। সবকটিই সিবিআই দেখছে এবং প্রত্যেকটির তদন্তকাজে সিবিআইকে নিয়োগের পেছনে আছে আদালতের নির্দেশ। এইসব ছাড়াও রাজ্যের আরও কয়েকটি মামলার তদন্তে নিয়োজিত সিবিআই। এই মুহুর্তে সিবিআইয়ের যে তদন্তটি সব থেকে বেশি ফুটেজ খাচ্ছে তার নাম অবশ্যই এসএসসি-র নিয়োগ দুর্নীতি। সিবিআই-ইডি যে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে সারদা, রোজভ্যালির মতো চিটফান্ড কেলেঙ্কারির তদন্তেরও দায়িত্বে রাজ্যের মানুষ মনে হয় এতদিনে তা ভুলে গেছে। নারদাকান্ডের তদন্তেও সিবিআই। সিবিআই দফতরে সারদা-নারদার কেস ফাইলে কত ইঞ্চি ধুলোর আস্তরণ জমেছে তা দফতরের আধিকারিকরাই ভাল বলতে পারবেন। আমরা শুধু অনুমান করতে পারি মাত্র।
চিটফান্ড স্ক্যামের কিনারা করতে ব্যর্থ সিবিআই
রাজ্য তোলপাড় করে দেওয়া চিটফান্ড স্ক্যামের তদন্তের দায়িত্ব আট বছর আগে সিবিআইকে দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। ঘটনার পেছনে যে লার্জার কনস্পিরেসি বা বৃহত্তর ষড়যন্ত্র আছে সেই বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের ষড়যন্ত্রীদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব সিবিআইকে দিয়েছিল আদালত। কিন্তু আট বছরে কতজন ষড়যন্ত্রীকে পাকড়াও করেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা? বাম আমলে শান্তিনিকেতন থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পদক চুরির ঘটনার তদন্তের দায়িত্বেও ছিল সিবিআই। আজ পর্যন্ত চোরও ধরা পড়ে নি। নোবেল পদকও উদ্ধার হয় নি। মমতা সময় পেলেই সিবিআইয়ের অক্ষমতা-অদক্ষতা প্রমাণ করতে এই প্রসঙ্গটি তুলতে ভোলেন না। যদিও নোবেল চুরির থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ চিটফান্ড কেলেঙ্কারি। কারণ, চোর রবি ঠাকুরের সোনার পদকটি হাতিয়ে নিলেও তাঁর সৃষ্টিকে চুরি করতে পারে নি। পক্ষান্তরে রাজ্যের লক্ষ লক্ষ মানুষের কষ্টার্জিত অর্থ লোপাট হয়ে গেছে সারদা-রোজভ্যালির মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চক্করে। সুদীপ্ত সেন ছাড়া চিটফান্ড স্ক্যামে ধৃত বাকি সব অভিযুক্ত আজ জেলের বাইরে। বহু অভিযুক্তকে হাতেই নিতে পারে নি সিবিআই। কত কোটি টাকা গায়েব হয়ে গেছে, স্পষ্ট করে এই সংখ্যাটাও জানাতে ব্যর্থ তদন্তকারী দুই সংস্থা। আর্থিক দুর্নীতিতে জড়িত সংস্থাগুলির কাছ থেকে কত কোটি টাকার সম্পদ এখনও পর্যন্ত উদ্ধার হয়েছে তাও আমরা জানি না। ক্ষতিগ্রস্ত আমানতকারীদের টাকা ফেরতের গল্প তো বিশ বাঁও জলে।
সারদা তদন্তে সিবিআইয়ের ভূমিকা কি নিয়ন্ত্রিত?
চিটফান্ড দুর্নীতির তদন্ত ফাইল এখনও ক্লোজ করে নি সিবিআই। কিন্তু এর তদন্ত যে রহস্যের চোরাগলিতে পথ হারিয়েছে তা বুঝতে কারও বাকি নেই। সারদা ঘোটালা প্রথম যখন বাজারে ধরা পড়ল। রাজ্য জুড়ে যখন হইচই কান্ড। তখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন- “যা গেছে তা গেছে। আর যাতে এমন ঘটনা না ঘটে, তা দেখতে হবে।” শেষ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রীর কথাই সত্যি হল! তিনি দূরদর্শী নেত্রী। আগে থেকেই টের পেয়েছিলেন- পাবলিকের টাকা মায়ের ভোগে গেছে। ঘাঁটাঘাঁটি করে ঘন্টা হবে। যেই সুপ্রিমকোর্ট এই রাজ্যের বিভিন্ন ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব সিবিআইয়ের হাতে সমর্পণ করেছে, সেই সুপ্রিম কোর্টেরই সিবিআই-কে নিয়ে করা একটি মন্তব্য ইতিমধ্যেই বহু ব্যবহারে ক্লিশে হয়ে গেছে। কেজড প্যারোট- খাঁচা বন্দী তোতা। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকার যেমন বলায় সিবিআই তেমনটাই বলে। পশ্চিমবঙ্গে যখনই কোনও ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সিবিআই তদন্তের দাবি ওঠে, তৃণমূলের নেতারা বলতে থাকেন- সিবিআই তো কেন্দ্রের তোতাপাখি, সিবিআইয়ের তদন্ত নিরপেক্ষ নয়। রাজ্যের বাম-কংগ্রেস শিবির থেকে আওয়াজ ওঠে- বটেই তো! বটেই তো! তৃণমূলের থেকে এটা আর ভাল কে জানে।
চারা ঘোটালায় পারল চিটফান্ড কেলেঙ্কারিতে পারল না কেন সিবিআই?
সিবিআই কেন চিটফান্ড স্ক্যামের মতো একটা মারাত্মক ঘটনার পর্দার পেছনে থাকা প্রভাবশালী ষড়যন্ত্রীদের বিচারের দরবারে টেনে আনতে ব্যর্থ হল? সিবিআই সারদা মামলার রহস্যভেদে ব্যর্থ হওয়ায় শেষ পযন্ত সুবিধা হয়েছে কার সেটা খালি চোখেই দৃশ্যমান। বিহারে পশুখাদ্য মামলা বা চারা ঘোটালায় লালুপ্রসাদ যাদবের রাজনৈতিক জীবনেই যবনিকা পতন। ওই রকম একটা ক্যারিশ্মাটিক নেতা! এখন সাজাপ্রাপ্ত আসামী হয়ে জেল খাটছেন। পশুখাদ্য কেলেঙ্কারির তদন্তেও ছিল সিবিআই। সেই সময় সিবিআইয়ের যুগ্ম অধিকর্তা ছিলেন উপেন বিশ্বাস। গোটা তদন্তপ্রক্রিয়া নিজের হাতের মুঠোয় রেখেছিলেন এই বাঙালি আইপিএস। লালুকে জেলের ডাল-রোটি খাইয়ে তবে ছেড়েছেন উপেন। উপেন বিশ্বাস পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের প্রথম ক্যাবিনেটে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীও হয়েছিলেন। কিন্তু একদফার বেশি মন্ত্রীত্ব পোষায় নি এই আপাদমস্তক সৎ মানুষটির। এখন আবার সংবাদ মাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমে আলোচিত উপেন বিশ্বাসের নাম । এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতি চক্রের পেছনে রঞ্জন নামে এক রহস্যময় ব্যক্তির নাম ভেসে উঠেছে। এক বছর আগেই সামাজিক মাধ্যমে রঞ্জনের উপাখ্যান ফাঁস করে দিয়েছিলেন উপেন। এই রঞ্জনের মাধ্যমেই নাকি টাকা যেত উপরমহলে। যারা রঞ্জনের হাতে টাকা দিত তাদেরই স্কুলে চাকরি হত। চাকরি না দিতে পারলে রঞ্জন নাকি টাকা ফেরত দিয়ে দিত। এখন এই রঞ্জন কে, কোথায় থাকে এবং এই রঞ্জনের হাত দিয়ে টাকা কার কার ঘরে পৌঁছেছে- এইসব খুঁজে বের করার দায়িত্ব সিবিআইয়ের।
বাংলায় ভরসা করার মতো কিছু এখনও করে উঠতে পারে নি সিবিআই
পশ্চিমবঙ্গের জনগণের একটাই প্রশ্ন- রঞ্জন এবং রঞ্জনের গডফাদাররা ধরা পড়বে তো শেষ পর্যন্ত? নাকি নিজাম প্যালেসে দৌড়-ঝাঁপেই নাটক শেষ? রাজ্যের বাম ও কংগ্রেস নেতৃত্বের অভিযোগ- দিল্লিতে সেটিং আছে তাই সিবিআই তদন্তের কিনারা হয় না। চিটফান্ডকান্ডের তদন্তের পরিণাম মানুষকে সিবিআই তদন্ত সম্পর্কে উদাসীন করে তোলার জন্য যথেষ্ট। সিবিআইকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার অভিযোগ অনেক পুরোনো। দিন দুয়েক আগে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি তুলেছেন, সিবিআই-কে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নিয়ন্ত্রণ থেকে বের করে এনে একটি স্বশাসিত সংস্থায় পরিণত করার। সিবিআই-এর মতো জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা স্বশাসিত হলে এর তদন্ত প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর সম্ভাবনা নিঃসন্দেহে হ্রাস পাবে। তখন সারদার মতো দুর্নীতির তদন্তে সিবিআই ফ্লপ খেলেও সেটিং-এর অভিযোগ তোলার সুযোগ থাকবে না বিরোধীদের। এখনও পর্যন্ত আমাদের রাজ্যে সিবিআই এমন কিছু করে দেখাতে পারে নি যাতে সংস্থাটির উপর ভরসা করা চলে। বরং ঘটনা পরম্পরা অনেক অপ্রিয় প্রশ্ন তোলার সুযোগ করে দিচ্ছে।
Feature Image is representational.