পরিষদীয় ব্যবস্থায় বিরোধী বেঞ্চ ব্যবস্থার অপরিহার্য অঙ্গ। নির্বাচকমণ্ডলী যদি অপরিহার্য অঙ্গটিকেই অকেজো করে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নিতে থাকে এবং এটাকেই অভ্যাসে পরিণত করে ফেলে তবে বলতে বাধ্য হচ্ছি এই নির্বাচকমণ্ডলী সংসদীয় ব্যবস্থার উপযুক্তই নয়।লিখলেন উত্তম দেব-
স্থানীয় নির্বাচনে বিরোধীদের আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার আদৌ প্রাসঙ্গিকতা আছে কিনা এই প্রশ্ন তুলে দিল রাজের চার পুরসভার ভোটের ফল। বিধাননগর, চন্দননগর এবং আসানসোলের ভোট নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ থাকলেও শিলিগুড়ি নিয়ে আঙুল তোলার অবকাশ নেই। কিন্তু বাকি তিন পুরসভার মতো শিলিগুড়িতেও লজ্জাজনক পরাজয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছে বাম ও বিজেপিকে। বিধাননগর ও চন্দননগরে তৃণমূলের বিপুল জয়ের ব্যাপারে রাজনৈতিক মহলের কোনও সংশয় ছিল না। কিন্তু শিলিগুড়ি ও আসানসোলে বিরোধীরা ধুয়েমুছে কার্যত সাফ হয়ে যাবে এমন উচ্চাশা সম্ভবত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও ছিল না। বিশেষ করে শিলিগুড়ির ফল রাজনৈতিক মহলকে তাজ্জব করেছে।
শিলিগুড়ির জয়ে কোনও জল নেই
চার পুরসভা মিলিয়ে যতগুলি আসন আছে, তার ৮৮ শতাংশ একা পেয়েছে তৃণমূল। তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোটের হার ৬১ শতাংশ। চার কর্পোরেশনের মধ্যে তৃণমূল রাজনৈতিক ভাবে সবথেকে দুর্বল শিলিগুড়িতে। পরপর দুটি বিধানসভা নির্বাচনেই শিলিগুড়িতে পরাজয়ের মুখ দেখতে হয়েছে তৃণমূলকে। এমনকি পাশের ডাবগ্রাম-ফুলবাড়িতেও একুশে বড় ব্যবধানে হারতে হয়েছে গৌতম দেবকে। পুরভোটে সেই শিলিগুড়িতেই ৭৫ শতাংশ আসন এবং ৪৭.২৪ শতাংশ ভোট পেয়েছে তৃণমূল। বিজেপি পেয়েছে মাত্র পাঁচটি ওয়ার্ড ও ২৩.২৪ শতাংশ ভোট। বামেরা চারটি ওয়ার্ড ও ১৮.২৮ শতাংশ ভোট। কংগ্রেস সাকুল্যে একটি আসন ও মাত্র ৫.৩২ শতাংশ ভোট। বিরোধীদের সব ভোট একত্র করলে দাঁড়ায় ৪৬.৮৪ শতাংশ ভোট।
একমাত্র শিলিগুড়িতেই তৃণমূলের ভোটে কার্যত কোনও জল নেই। অশোক ভট্টাচার্যের শিলিগুড়ি ছিল বামেদের শক্ত ঘাঁটি। এগারোর বিধানসভায় পরাজয়ের পর পনেরোর পুর নির্বাচনে দারুণভাবে কামব্যাক করেছিলেন অশোক। নানা টানোপোড়েনের মধ্যেও পাঁচ বছর শিলিগুড়ি কর্পোরেশনের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন এই প্রবীণ বামনেতা। বিরোধীদের অনেক পুরবোর্ড উল্টে দিলেও অশোক ভট্টাচার্যের আসন টলাতে পারে নি তৃণমূল। সেই শিলিগুড়ি বাম থেকে রাম হয়েছে। উনিশের লোকসভা নির্বাচনের ফলেই ইঙ্গিত ছিল শিলিগুড়িতে বামের সূর্য অস্তাচলে। একুশের বিধানসভা নির্বাচনের দোর গোড়ায় অশোকবাবুর রাজনৈতিক শিষ্য বলে পরিচিত শঙ্কর ঘোষ সিপিএম ছেড়ে বিজেপির ঝান্ডা ধরেন। শিলিগুড়ি সহ মহকুমার তিনটি আসনই বিজেপি দখল করে। এমনকি সংলগ্ন ডাবগ্রাম-ফুলবাড়িতেও পদ্ম ফোটে। শিলিগুড়ি বিধানসভায় অশোক ভট্টাচার্যের স্থান হয় তিন নম্বরে।
অবশেষে মমতার আশা পূর্ণ হল
পুরভোটের ফলে দেখা যাচ্ছে শিলিগুড়ি না রামের না বামের মমতার বহুদিনের আশা পূর্ণ করে শিলিগুড়ি জোড়াফুলের। শাসকদলের কাছে সবথেকে স্বস্তির জায়গা হল বিরোধী ভোটের বিভাজন। সেই ক্ষেত্রে শিলিগুড়ি হয়ে দাঁড়াচ্ছে তৃণমূলের জন্য একটা মডেল। যেই হেতু শিলিগুড়ির ভোট নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই তাই তৃণমূলের জয় নিয়েও কোনও প্রশ্ন তোলার জায়গা নেই। শিলিগুড়িতে বিধানসভার তুলনায় প্রায় ২৪ শতাংশ ভোট বাড়িয়েছে তৃণমূল। শিলিগুড়িতে বামেরা ঘুরে দাঁড়াতে ব্যর্থ। আর বিজেপি ব্যর্থ জমি ধরে রাখতে।
শিলিগুড়িতে ভোটের শতাংশের তুলনায় আসন অনেক বেশি পেয়েছে তৃণমূল। বিজেপি-বাম ও কংগ্রেসে ভোট ভাগাভাগি হয়ে যাওয়ার ফয়দাটা তুলেছে তৃণমূল। বাম আমলে শিলিগুড়ির বিরোধী পরিসর ছিল কংগ্রেসের দখলে। কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূলের উত্থানের পর বিরোধী শক্তি ভাগাভাগি হয়ে যায়। ২০০৯-এর শিলিগুড়ি পুর নির্বাচনে কংগ্রেস ও তৃণমূল জোট করে লড়ে বামেদের থেকে বেশি আসন পেয়ে বোর্ড গড়লেও এগারোর পরে মেয়র গঙ্গোত্রী দত্তের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয় তৃণমূল। গঙ্গোত্রীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের বোর্ড মেয়াদ পূর্ণ করে বামেদের সমর্থনে। এই প্রথম সম্পূর্ণ একক শক্তিতে শিলিগুড়িতে বড় জয় পেল তৃণমূল।
বিধাননগর-চন্দননগরে সাফ আসানসোলেও দাগ কাটতে ব্যর্থ বিজেপি
বিধাননগর পুরসভার ৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৩৯টিই জিতেছে তৃণমূল। ৯৭ শতাংশ আসনই জোড়াফুলের দখলে। প্রাপ্ত ভোট ৭৩.৯৫ শতাংশ। ১৭টি ওয়ার্ডে তৃণমূলের ভোট ৮০ শতাংশের উপরে। বিধাননগরে বাম ও বিজেপি উভয়েই শূন্য। কংগ্রেস ও নির্দল একটি করে ওয়ার্ড জিতেছে। বিধাননগরে বামেদের ভোট ১০.৯৪ শতাংশ। বিজেপির ৮.৩৭ শতাংশ। কংগ্রেস পেয়েছে ৩.৪২ শতাংশ। চন্দননগর পুরসভার ৩২টি ওয়ার্ডের ৩১টিই তৃণমূলের। এখানে জনগণ অথবা শাসকদল সিপিএমকে একটি ওয়ার্ড দয়া করলেও তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোট বিধাননগরের থেকে বেশ খানিকটা কম ৫৯.৪২ শতাংশ। চন্দননগরে বামেদের ভোট খানিকটা পাতে দেওয়ার মতো – ২৭.৩৭ শতাংশ। বিজেপির মাত্র ৯.৮ শতাংশ।
আসানসোল কর্পোরেশন বিজেপির দখলে যাবে এটা সুকান্ত মজুমদারও আশা করেছিলেন বলে মনে হয় না। তবে শিল্পনগরীতে বিজেপি তুলনায় বেহেতর পারফরম্যান্স দেখাবে এমন অনুমান রাজনৈতিক মহলের ছিল। কিন্তু ইভিএম খোলার পর দেখা গেল আসানসোলে তৃণমূলের ফল পনেরোর থেকেও অনেক ভাল। ১০৬-টায় ৯১ তৃণমূলের। বিজেপি মাত্র সাত। কংগ্রেস তিন। বামেরা দুই। নির্দল তিন। আসানসোলে তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোট ৬৩ শতাংশের অধিক। বিজেপির ১৬.৩২ শতাংশ। বামেরা পেয়েছে ১২.৩৭ শতাংশ। কংগ্রেসের ৪.১২ শতাংশ।
উদ্বেগের জয় উদ্বেগের পরাজয়
তৃণমূলের দখলে চার পুরসভার ৮৮ শতাংশ আসন ! শিলিগুড়ি বাদ দিয়ে তিন পুরসভার ভোট নিয়েই অনিয়মের অভিযোগ বিরোধীদের। বিরোধীদের অভিযোগ সত্য হলে বলতে হয় অনিয়ম রুখে দিতে পারছে না কেন তারা? বারংবার আদালতের দ্বারস্থ হয়েও যদি স্থানীয় ভোটে অনিয়ম ও সন্ত্রাস রুখতে বিরোধীরা ব্যর্থ হয় তবে ভোটের লড়াইয়ে থাকছে কেন তারা ? আর শাসকদলের কথা মতো বিরোধীদের অভিযোগ যদি মিথ্যা হয় তবে তো পশ্চিমবঙ্গের প্রাপ্ত বয়স্ক নাগরিকদের মাইন্ডসেট নিয়েই উদ্বেগ প্রকাশের অবকাশ আছে। এই মাইন্ডসেট বা মনোভাব আর যাই হোক গণতান্ত্রিক রাজনীতি চর্চার অনুকূল নয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোটে জয়পরাজয় একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু জয় ও পরাজয়ের একটা লক্ষ্মণ রেখা আছে গণতন্ত্রে।
চারটি পুরসভাতেই শাসকদলের জয় এবং বিরোধীদের পরাজয় লক্ষ্মণ রেখা অতিক্রম করে গেছে। পরিষদীয় ব্যবস্থায় বিরোধী বেঞ্চ ব্যবস্থার অপরিহার্য অঙ্গ। নির্বাচকমণ্ডলী যদি অপরিহার্য অঙ্গটিকেই অকেজো করে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নিতে থাকে এবং এটাকেই অভ্যাসে পরিণত করে ফেলে তবে বলতে বাধ্য হচ্ছি এই নির্বাচকমণ্ডলী সংসদীয় ব্যবস্থার উপযুক্তই নয়।
Feature Image is representational.