উত্তম দেব
যখন মোবাইলের কি প্যাডে আঙুলের চাপ দেওয়া শুরু করলাম তখন ঘড়ির কাঁটায় রাত বারোটা বেজে তেরো মিনিট । গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৩’রা ডিসেম্বর । আজ থেকে ৩৬ বছর আগের ঠিক এই রাতেই এতক্ষণে একটু একটু করে নিঃশব্দে মরণ এসে হানা দিতে শুরু করেছিল হাজার হাজার ঘুমন্ত মানুষের দুয়ারে । কিছু বুঝে ওঠার আগেই গলা টিপে ধরছিল বাতাসের ঘাড়ে চেপে বসা বিষ । বাতাসের থেকে ভারি ‘মিক’ গ্যাস মেঘের মতো ছড়িয়ে পড়ে মৃত্যুশয্যা রচনা করছিল একের পর এক মানুষের । নিঃশ্বাস রুদ্ধ মানুষ অন্ধকারে পালাচ্ছিল । পালাতে পালাতে রাস্তায় পড়ে মুখ দিয়ে ফ্যানা তুলে দাপড়ে মরছিল । ১৯৮৪’ র ৩’রা ডিসেম্বর কালরাত । মধ্যপ্রদেশের রাজধানী পাঁচ লক্ষ মানুষের শহর ভূপাল যেন মৃত্যুপুরী । পৃথিবীর ইতিহাসে ভয়ঙ্করতম শিল্প বিপর্যয়ে কত মানুষ শেষ পর্যন্ত মরেছে তার কোনও হিসেব নেই । সরকারি মতে তিন হাজার ৭৮৭ জন । বেসরকারি মতে ২০ হাজারের বেশি । ভূপাল গ্যাস বিপর্যয় । ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লিমিটেডের কীটনাশক তৈরীর প্ল্যান্টের ভূগর্ভস্থ ট্যাঙ্ক থেকে বিষাক্ত মিথাইল আইসোসায়নেট বা মিক গ্যাস লিকের ঘটনা নিছক শিল্পক্ষেত্রের একটি দুর্ঘটনা নয় এটা একটা হত্যাকান্ড । যার জন্য কাউকে কোনও শাস্তি পেতে হয় নি । মৃতদের পরিবার এবং আহতদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নামে যেটা হয়েছে তাকে নিষ্ঠুর তামাশা বললে ভুল হয় না ।
ঠিক কী কারণে এই দুর্ঘটনা তা অনুসন্ধানে ভারত সরকারের কোনও মাথাব্যথা ছিল না । রক্ষণাবেক্ষণে দীর্ঘ অবহেলা না থাকলে এত বড় বিপর্যয় ঘটতে পারে না বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত । যদিও মার্কিন বহুজাতিক ইউনিয়ন কার্বাইড কর্পোরেশন এবং তার ভারতীয় সহযোগী ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লিমিটেড নিজেদের দায় ঝেড়ে ফেলতে বিলম্ব করে নি। বরং কর্মীদের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছিল ইউনিয়ন কার্বাইড কর্তৃপক্ষ । কর্মীদের একাংশ নাশকতায় জড়িত না থাকলে ভূগর্ভস্থ ট্যাঙ্কে জল ঢুকে গ্যাস লিক করা সম্ভব ছিল না বলে দাবি করে তারা । অথচ ইউনিয়ন কার্বাইডের ভূপাল প্ল্যান্ট নিয়ে কর্মীদের অভিযোগ ছিল বহু আগে থেকেই । চুরাশির তেসরা ডিসেম্বর রাতের মহা বিপর্যয়ের আগে একাধিকবার প্ল্যান্টে গ্যাস লিকের ছোটখাট ঘটনায় কর্মীমহলে ত্রাস এবং অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছিল । এইসব দুর্ঘটনায় শ্রমিকদের অসুস্থ হয়ে পড়া এমনকি একজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও ম্যানেজমেন্ট সজাগ হয় নি । কর্মী ইউনিয়ন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও ইউনিয়ন কার্বাইড পাত্তা দেয় নি ।
হিরোশিমা নাগাসাকির পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের মতোই ভূপাল গ্যাস ট্র্যাজেডির অভিঘাত ছিল দু’রকমের। বিষের জ্বালায় যারা তাৎক্ষণিক মরার মরে জ্বালা জুড়িয়ে বেঁচেছে। কিন্তু যে হতভাগ্যরা শরীরে বিষ ধারণ করেও বেঁচে গিয়েছিল তাদের বড় অংশ পরে তিলে তিলে মৃত্যু বরণ করে দুরারোগ্য ক্যানসার সহ অন্যান্য জটিল রোগে । এবং এই বিষক্রিয়ার মাশুল ভুক্তভোগীদের এখনও গুণতে হচ্ছে বলে গবেষকদের দাবি ।
এই দেশে সাধারণ মানুষের মৃত্যু ও মরণ যন্ত্রণা নিয়ে না মানুষের নিজের গরজ আছে না সরকারের । আমেরিকার মতো দেশে এমন বিপর্যয় ঘটলে প্ল্যান্টের মালিকদের বাকি জীবন কারাগারের সেলে কাটত । আর ভারত সরকার ইউনিয়ন কার্বাইড কর্পোরেশনের সিইও ওয়ারেন অ্যান্ডার্সনকে গ্রেফতারির নাটক শেষে নিরাপদে প্লেনে তুলে দেয় । এই লোকটা তিরিশ বছর ধরে ভারতীয় বিচারব্যবস্থাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ৯৩ বছর বয়সে রেস্ট ইন পিস স্ট্যাটাস লাভ করে ২০১৪ ‘র ২৯ সেপ্টেম্বর । ঘটনার ছাব্বিশ বছর পর ২০১০ এর জুনে ভূপালের একটি আদালত ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লিমিটেডের প্রাক্তন চেয়ারম্যান সহ সাতজন প্রাক্তন কর্মীর বিরুদ্ধে স্রেফ কর্মক্ষেত্রে কর্তব্যে অবহেলার কারণে দুর্ঘটনার অভিযোগে দুই বছরের জেল ও লাখ টাকা করে জরিমানার নির্দেশ দেয় । জেলে ঢোকার দিন কয়েকের মধ্যেই উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়ে ঘরে ফিরে আসে অভিযুক্তরা । অভিযুক্ত আরও আট প্রাক্তন কর্মী রায় বেরোনোর আগেই দুনিয়া থেকে বিদায় নেয় । ‘দ্য ওয়ার্ল্ড’স ওয়ার্স্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাস্টার ‘ এর এই হল বিচার প্রক্রিয়া !
গণহত্যার আসামিদের শাস্তি যেমন হয় নি তেমনি হাজার হাজার ‘গ্যাস ভিক্টিম ‘ কার্যত কোনও ক্ষতিপূরণ পান নি । ইউনিয়ন কার্বাইড কর্পোরেশনের কাছে ৩.৩ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করে শেষ পর্যন্ত ভারত সরকার আদায় করতে পেরেছিল মাত্র ৪৭ কোটি ডলার। পাঁচ বছর আইনি টানাপোড়েনের পর ১৯৮৯ সালে আদালতের বাইরে এক সমঝোতার মাধ্যমে ইউসিসির কাছ থেকে ওই অর্থ পায় সরকার । সেই সময় ভারতীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকা । বিষাক্ত গ্যাসের শিকার মানুষের বড় অংশই ছিল দরিদ্র ঝুপড়িবাসী এবং ফুটপাতে , স্টেশনে শুয়ে থাকা দরিদ্রতম মানুষ । সুপ্রিম কোর্ট নিহতদের পরিবারকে দুই থেকে চার লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিলেও সরকার খরচ করেছিল ৯০ হাজারেরও কম । গ্যাস ভিক্টিমরা বছরের পর বছর ধরে ধুঁকে ধুঁকে মরেছেন । তাদের চিকিৎসার জন্য জনপ্রতি চার হাজার টাকাও ব্যয় করে নি সরকার । যে মানুষগুলো চিরতরে অক্ষম হয়ে পড়ে জনপ্রতি তাদের ভাগে জুটেছিল মাত্র ২৬ হাজার ৫৪৩ টাকা করে । এটা ক্ষতিপূরণ না ভিক্ষা ?
ভূপাল গ্যাস ট্র্যাজেডিকে কেন্দ্র করে বহুজাতিক ইউনিয়ন কার্বাইড বনাম ভারত সরকারের দ্বৈরথে সরকার কখনও দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছে বলে দেশবাসীর মনে হয় নি । গ্যাস পীড়িত নাগরিকদের সুবিচার দেওয়ার চাইতে অভিযুক্ত কোম্পানিকে আড়াল করতেই বেশি উৎসাহ ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের । গবেষকরা পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন গ্যাস বিপর্যয়ের ৩৬ বছর পরেও ইউনিয়ন কার্বাইডের প্ল্যান্ট সংলগ্ন বিস্তীর্ণ এলাকার ভূগর্ভস্থ জল , মাটি বিষের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারে নি । গর্ভবতী জননীদের সন্তান গর্ভেই মরে গেছে । বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম দিয়েছেন মায়েরা । প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর বিষের বোঝা বহন করে চলেছেন ভূপালের মানুষ। বছরে দুটি দিন ‘ গ্যাস ভিক্টিমদের ‘ জন্য ধার্য । বাকি দিন অবহেলাই প্রাপ্য তাদের ।
ছবি – সংগৃহীত