রোজই এক জিজ্ঞাসাবাদ নাটক! জনগণের প্রশ্ন, তদন্তে নেমে সিবিআই কি কোনও তল পাচ্ছে না? নাকি পেছনে অন্য কোনও খেলা আছে? আরও যা লিখলেন উত্তম দেব –
আরজি কর হাসপাতালে মহিলা ইন্টার্নিকে খুন ও ধর্ষণের ঘটনার শেষ পর্যন্ত কোনও কিনারা হবে? গত ৮ অগাস্ট রাতে মহিলা চিকিৎসককে খুন ও ধর্ষণ করা হয়। ৯ অগাস্ট সকালে তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার হয় হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চার তলার সেমিনার হলে। মহিলা চিকিৎসকে খুন ও ধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা দিতে আরজি কর কর্তৃপক্ষ সে’দিন দুপুর পর্যন্ত কী কী কৌশল অবলম্বন করেছিল, তা এতদিনে রাজ্যবাসীর জানা হয়ে গেছে। এইসব ঘটনার সবথেকে বড় সাক্ষী নির্যাতিতার বাবা-মা। তাঁদের অভিযোগ, আরজি কর কর্তৃপক্ষের তরফে তো বটেই এমনকি কলকাতা পুলিশের তরফেও ঘটনা ভিন্ন খাতে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল।
আরজি কর কান্ডে বাংলা উত্তাল এবং গোটা দেশে সেই ঢেউ লেগেছে। বহির্বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমে পর্যন্ত হেডলাইন হয়েছে আরজি করের ঘটনা। দেশের সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আরজি করে মহিলা চিকিৎসককে খুন ও ধর্ষণের ঘটনায় হস্তক্ষেপ করেছে। মঙ্গলবারের (২০ অগাস্ট) শুনানিতে আরজি কর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও কলেজের হোস্টেলের নিরাপত্তায় সিআইএসএফ মোতায়েন সহ একাধিক নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। গত ১৩ অগাস্ট আরজি কর কান্ডের তদন্তভার কলকাতা পুলিশের হাত থেকে সরিয়ে সিবিআইয়ের হাতে দিয়েছে হাইকোর্ট। ১৪ অগাস্ট থেকেই তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু করে দেয় সিবিআইয়ের টিম। ২০ অগাস্ট পর্যন্ত তদন্তে কোনও অগ্রগতি হয়েছে বলে অন্তত সাধারণ মানুষের চোখে পড়ছে না।
আরজি করের মহিলা ইন্টার্নিকে খুন ও ধর্ষণের অভিযোগে গত ৯ অগাস্ট সঞ্জয় রায় নামে এক সিভিক ভলান্টিয়ারকে গ্রেফতার করেছিল কলকাতা পুলিশ। একা সঞ্জয়ই যদি মহিলা চিকিৎসকের খুনি ও বলাৎকারি হয়, তবে তো পুলিশই ঘটনার একপ্রকার কিনারা করে ফেলেছিল, বলা চলে। অথচ ঘটনার পেছনের আসল মাথাদের বাঁচাতে প্রশাসন ও আরজি কর কর্তৃপক্ষ সঞ্জয়কে আরও একটা ধনঞ্জয় বানানোর চেষ্টা করছে; আরজি করের চিকিৎসক, ইন্টার্নি ও জনগণের তোলা এই দাবি রাজ্যে কতটা তোলপাড় ফেললে তবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত নির্যাতিতার বাড়ি গিয়ে সিবিআই তদন্তের আশ্বাস দিতে বাধ্য হন!
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে তাঁদের বশ করতে চেয়েছিলেন বলে নিহত, ধর্ষিত চিকিৎসকের বাবা-মা সংবাদ মাধ্যমের সামনে বলেছেন। তাঁরা মেয়ের বিনিময়ে টাকা-চাকরি চান না, চান তাঁদের মেয়ের হত্যাকারী ও ধর্ষকদের শাস্তি। ঘটনার পরপরই প্রমাণ লোপাট করা হয়েছে বলে অভিযোগ। সিবিআই তদন্তভার হাতে নেওয়ার আগেই আরজি কর হাসপাতালের সেমিনার হল সংলগ্ন ঘরের দেওয়াল ভেঙে ফেলা হয়েছে বলেও গুঞ্জন। ওই নারী চিকিৎসককে অন্য ঘরে ধর্ষণ ও খুন করে দেহ সেমিনার হলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বলেও কানাঘুষো চলছে। প্রমাণ লোপাটের চক্রান্তের সঙ্গে অনেক পদস্থ ব্যক্তি ও প্রভাবশালী জড়িত বলে জনগণের সন্দেহ। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সবই আরজি করের চিকিৎসক ও ইন্টার্নি মহল, নির্যাতিতার পরিবার, সংবাদ মাধ্যম, বিরোধী দল ও সর্বোপরি রাজ্যের জনগণের অভিযোগ, অনুমান ও সন্দেহতেই সীমাবদ্ধ।
ময়নাতদন্তের রিপোর্ট ইতিমধ্যেই নির্যাতিতার পরিবারের হাতে পৌঁছেছে। পরিবারের হাত ঘুরে তা এখন সংবাদ মাধ্যমের কাছে। মৃতার দেহের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট ভয়াবহ, যা দেখে চিকিৎসকদের অনেকেরই ধারণা, একা একজনের পক্ষে মেয়েটির উপর এমন পাশবিক নির্যাতন চালানো সম্ভব নয়, দলে আরও কয়েকজন রয়েছে। সিবিআই তদন্তের দায়িত্ব নেওয়ার পর ৬ দিন অতিক্রান্ত। আরজি কর কান্ডে নতুন করে আর কেউ গ্রেফতার হয় নি। আরজি কর মেডিকেল কলেজের অপসারিত অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে পরপর পাঁচ দিন টানা ১২-১৩ ঘন্টা করে জেরা করা হয়েছে। পঞ্চম দফা জেরা শেষে মঙ্গলবার রাতেও সিজিও কমপ্লেক্স থেকে বাড়ি ফিরে যান সন্দীপ। এই সন্দীপ ঘোষই নাটের গুরু বলে অভিযোগ রাজ্যের বিরোধী দলনেতা থেকে চিকিৎসক মহলের। ঘটনার পরপরই সন্দীপ আরজি করের অধ্যক্ষের পদ থেকে ইস্তফা দেন এবং তার কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁকে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত করে স্বাস্থ্য দফতর। শেষে হাইকোর্টের গুঁতো খেয়ে সন্দীপকে ছুটিতে পাঠান মমতা।
সন্দীপের বিরুদ্ধে গুচ্ছের দুর্নীতির অভিযোগ। দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই তিনি আরজি করে হাত খুলে দুর্নীতি চালিয়ে গেছেন বলে অভিযোগ। ইন্টার্নি খুন ও ধর্ষণের ঘটনাতেও তাঁর ভূমিকা সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। নির্যাতিতার পরিবারকে বিভ্রান্ত করার অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। মানুষ রোজই আশা করছে, এই নারকীয় ঘটনার সঙ্গে যুক্ত বাকিদেরও গ্রেফতার করেছে সিবিআই। কিন্তু আশাই সার। রোজই এক জিজ্ঞাসাবাদ নাটক। জনগণের প্রশ্ন, তদন্তে নেমে সিবিআই কি কোনও তল পাচ্ছে না? সব তথ্যপ্রমাণই কি এমন ভাবে লোপাট করা হয়েছে যে সিবিআইয়ের ঘাঘু আধিকারিকেরাও চোখে সর্ষেফুল দেখছেন? নাকি পেছনে অন্য কোনও খেলা আছে? পশ্চিমবঙ্গে তো অনেক স্ক্যামেরই ‘কিংপিন’-এর কেশাগ্র পর্যন্ত স্পর্শ করতে ব্যর্থ সিবিআই-ইডির মতো কেন্দ্রীয় এজেন্সি।
আরজি করে খুন-ধর্ষণের ঘটনার রহস্য শেষ পর্যন্ত বাকি স্ক্যামগুলির মতোই অনুদ্ঘাটিত থাকলে, আসল মাথারা ধরা না পড়লে কে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবেন, তা মানুষ জানে। এত বড় মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগের সেমিনার হলে মাত্র একজন ঢুকে এক নারী চিকিৎসককে নিঃশব্দে ধর্ষণ শেষে খুন করে ফিরে গেল, কেউ কিচ্ছু টের পেল না, এই গল্প আমাদের বিশ্বাস করতে হবে? কী ভয়ঙ্কর চিত্রনাট্য সেই রাতে সাজানো হয়েছিল আরজি করে, মানুষ ভাবতেও শিউরে উঠছে। অথচ তদন্ত হাতে নিয়ে সিবিআই এখনও ডুগডুগি বাজিয়ে যাচ্ছে! অনেকেই বলবেন, তাড়াহুড়োয় তদন্ত ভুল রাস্তায় চলে যেতে পারে, তাই ধীরেসুস্থে এগোচ্ছেন সিবিআই অফিসারেরা। হলেও হতে পারে কিন্তু সিবিআই-ইডির তদন্ত নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের অভিজ্ঞতা বড়ই খারাপ। এতদিন পর্যন্ত মূলত টাকা-পয়সা ঘাপলা করার মামলা সামলেছে ইডি-সিবিআই। হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে গেছে। যোগ্যরা চাকরি পান নি। অযোগ্যদের কাছে চাকরি বেচে কোটি কোটি টাকা রোজগার করেছে প্রভাবশালীরা। কিন্তু আরজি করে তো পথের কাঁটা সরিয়ে দিতে একজন নারী চিকিৎসককে নির্মমভাবে খুন-ধর্ষণ করাতেও পিছপা হল না ষড়যন্ত্রীরা! হাসপাতাল-মেডিকেল কলেজের ভেতরে চিকিৎসককে খুন-ধর্ষণের ঘটনা এর আগে ভূ-ভারতে ঘটে নি। মুখ বন্ধ করিয়ে দিতে নারী চিকিৎসককে ধর্ষণ করিয়ে খুন পর্যন্ত করতে যারা পারে, তারা শেষ পর্যন্ত অধরা থাকলে সাধারণ মানুষ আর কোন নিরাপত্তায় পথেঘাটে বেরোবেন, অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন?
শুক্রবার সুপ্রিম কোর্টে আরজি কর মামলার পরবর্তী শুনানি। বৃহস্পতিবারের মধ্যে সিবিআইকে তদন্তের ‘স্ট্যাটাস রিপোর্ট’ জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছে দেশের শীর্ষ আদালত। দেখা যাক, সুপ্রিম কোর্টে কী রিপোর্ট দাখিল করে সিবিআই। বাংলার মানুষ তো সুপ্রিম কোর্টের উপরেও আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। ফেলবেই বা না কেন। কলকাতা হাইকোর্ট থেকে যে মামলাই সুপ্রিম কোর্টে যাচ্ছে, সেই মামলাই ‘তারিখ পে তারিখ’ হয়ে যাচ্ছে। এত বড় নিয়োগ দুর্নীতি মামলারও সুপ্রিম কোর্টে আর কোনও অগ্রগতি নেই। কান্ডকারখানা সব দেখে-শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উপরওয়ালার কাছে বিচার চাওয়া ছাড়া আর কোনও পথ খোলা নেই আমাদের সামনে।
Feature graphic is representational and created by NNDC.