বিশেষ প্রতিবেদন: বসিরহাটের তৃণমূল প্রার্থী হাজি নুরুল ইসলামের সমর্থনে আয়োজিত হাড়োয়ার সভায় উপস্থিত না থাকায় দলনেত্রীর রোষানলে পড়েছেন মিনাখাঁর তিনবারের বিধায়ক ঊষারানি মন্ডল। শনিবার মঞ্চে ঊষারানিকে দেখতে না পেয়ে রাগে ফেটে পড়ে মমতা বলেন, “হাড়োয়া এবং এই মিনাখাঁয় দলই আসল। ব্যক্তি আসল নয়। তৃণমূল কংগ্রেসের এমএলএ থাকবেন, আর মিটিংয়ে আসবেন না, মনে রাখবেন, তাঁর সাথে দলের কোনও সম্পর্ক থাকবে না। আমি আজই বলে গেলাম, আপনাকে নিয়ে দল চলবে না।” হাড়োয়ার সভায় মিনাখাঁর বিধায়ক যে হাজির থাকবেন না, তা জেনেই সভাস্থলের উদ্দেশে মমতা রওনা দিয়েছিলেন বলে সূত্র মারফত জানা গেছে। মুখ্যমন্ত্রী হয়তো মনস্থির করেই হাড়োয়া গিয়েছিলেন যে মঞ্চ থেকেই তিনি মিনাখাঁর বিধায়ককে ছেঁটে ফেলবেন। ঊষারানি ও তাঁর স্বামী মৃত্যুঞ্জয়ের বিজেপির সঙ্গে আঁতাত রয়েছে বলে মঞ্চ থেকে অভিযোগ করেছেন মমতা। যদিও রবিবার সংবাদ মাধ্যমের সামনে মৃত্যুঞ্জয়ের দাবি, “মুখ্যমন্ত্রীকে ভুল বোঝানো হয়েছে।”
নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন অপমানিত ঊষারানি
কারা তাঁদের সম্পর্কে দলের সুপ্রিমোকে ভুল বোঝাচ্ছেন, তাঁদের নাম মিডিয়ার কাছে উল্লেখ করেছেন মৃত্যুঞ্জয় মন্ডল। বসিরহাটের তৃণমূল প্রার্থী হাজি নুরুল ইসলাম থেকে শুরু করে হাড়োয়া ও মিনাখাঁর তৃণমূল নেতৃত্বের প্রায় সকলেই তফসিলি সম্প্রদায়ের ঊষারানিকে দল থেকে উৎখাত করতে উঠেপড়ে লেগেছে বলে জানা গেছে। কালীঘাটে মিনাখাঁর বিধায়ক সম্পর্কে যাঁরা ভুল বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন হাড়োয়া পঞ্চায়েত সমিতির সহকারী সভাপতি ও তৃণমূলের যুব সভাপতি আবদুল খালেক মোল্লা। সঙ্গে রয়েছেন দলের ব্লক সভাপতি ফরিদ জমাদার।
জয়ের হ্যাটট্রিক করলেও সাংসদ হাজি নুরুল ইসলাম ও তাঁর দুই সাগরেদ আব্দুল খালেক মোল্লা এবং ফরিদ জমাদারের অত্যাচারে দলে রীতিমতো কোনঠাসা বিধায়ক ঊষারানি। সম্প্রতি বসিরহাটের সংগ্রামপুরে হাজি নুরুলের কর্মিসভায় উষারানি মন্ডলকে আব্দুল খালেক মোল্লা অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন বলে সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেছেন মৃত্যুঞ্জয়। মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রী উপস্থিতিতেই সে’দিন হিন্দু সম্প্রদায়ের তফসিলি জাতির এক বিধায়ককে অপমান করে পার পেয়ে যান আবদুল খালেক। চোখে দেখেও দলনেত্রী এর বিহিত না করায় অভিমানে তখন থেকেই নিজেকে অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছেন উষারানি। সংবাদ মাধ্যমকে দেওয়া তাঁর স্বামীর বক্তব্য থেকেই বিষয়টা পরিষ্কার।
সংখ্যালঘু নেতাদের মন পেতে তফসিলি নেত্রীকে অবহেলা!
বসিরহাট দখলে রাখতে সংখ্যালঘুদের ভোটকেই নাকি যথেষ্ট বলে মনে করছেন মমতা। বসিরহাট লোকসভার অন্তর্গত সন্দেশখালিতেও তফসিলি সম্প্রদায়ের মহিলারাই শেখ শাহজাহানদের হাতে নির্যাতিত বলে অভিযোগ। এখন তৃণমূল নেতৃত্ব সন্দেশখালির তফসিলি সম্প্রদায়ের মহিলাদের অভিযোগকে মিথ্যা প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। মিনাখাঁর তৃণমূল বিধায়ক ঊষারানি মন্ডলের পরিণতির সঙ্গে সন্দেশখালি আন্দোলনের মুখ রেখা পাত্র-মাম্পি দাসদের উপর প্রশাসনের অত্যাচারের মিল খুঁজে পাচ্ছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ। শনিবার হাড়োয়ার সভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেজাজ দেখে অনেকেরই মনে হয়েছে, মিনাখাঁর তিনবারের বিধায়ককে ইতিমধ্যেই বাতিলের খাতায় ফেলেই দিয়েছেন তিনি।
হাজি নুরুল ইসলাম, আব্দুল খালেক মোল্লা ও ফরিদ জমাদার দীর্ঘদিন ধরেই ঊষারানি ও মৃত্যুঞ্জয়কে দলে কোনঠাসা করে রেখেছেন। মমতা সহ দলের শীর্ষ নেতৃত্বের দৃষ্টি আকর্ষণের অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন মন্ডল দম্পতি। আজ তাঁরা দলে অপাঙক্তেয়। অথচ তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকেই ভালবেসে দলটা করেন দু’জন। দুঃসময়ে দলের সাথে থাকলেও সুপ্রিমোর কাছে আজ যে তাঁদের আর কোনও মূল্যই নেই তা বুঝে গেছেন ঊষারানি ও মৃত্যুঞ্জয়। শনিবার হাড়োয়ার সভায় মমতা যে ভাষায় ও ভঙ্গিতে নিজের দলের বিধায়কের বিরুদ্ধে মন্তব্য করেছেন তা বেনজির বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। মমতা বলেছেন “দলে যাঁরা আছেন, সংগঠনে যাঁরা আছেন, তাঁরা দেখে নেবেন, যতক্ষণ সে ক্ষমা না চাইবে, পায়ে না ধরবে, ততক্ষণ ঊষারানি মন্ডলকে আমরা মানি না। মানব না। মানব না।”
ভোট বড় বালাই, তাই তোলাবাজকেই তেল
ঊষারানি ও তাঁর স্বামী মৃত্যুঞ্জয়ের বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ, “আপনি আর আপনার স্বামী দলটাকে বিজেপির কাছে বেচে দেবেন! আর মনে করেন আমরা সেটাকে সমর্থন করব? না!” যদিও বিজেপির সাথে তাঁদের যোগাযোগ থাকার কথা সংবাদ মাধ্যমের সামনে অস্বীকার করেছেন মৃত্যুঞ্জয় মন্ডল। মমতার মুখ ঝামটা সহ্য করেও তৃণমূলেই থাকতে চান দু’জন। সাংবাদিকদের ঊষারানি মন্ডলের স্বামী জানান, “তৃণমূল কংগ্রেস ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে চাই না। ১৯৮৮ সাল থেকে ভালবেসে দল করি। দল যদি মেনে না নেয়, পার্টির একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে কাজ করব।”
যে আবদুল খালেক মোল্লার জন্য দলের ভেতরে বিধায়ক ঊষারানি মন্ডলের রাজনৈতিক জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে গন্ডায় গন্ডায় তোলাবাজির অভিযোগ। কিন্তু বসিরহাটের ভোট বৈতরণী পার হতে তফসিলি সম্প্রদায়ের ঊষারানি মন্ডল নয়, আবদুল খালেক মোল্লাকেই মমতার বেশি প্রয়োজন।
Feature graphic is representational and created by NNDC.