বিশেষ প্রতিবেদন: এই মুহূর্তে বাংলার রাজনীতির ‘রহস্য পুরুষ’ একজনই। কুণাল ঘোষ। তিনি ডালে ডালে চলেন না পাতায় পাতায় ঘোরেন, বলা মুশকিল। ছিলেন ঝানু সাংবাদিক। হয়েছেন ঘাঘু রাজনীতিক। কেউ কেউ বলেন, তৃণমূলে এখন কুণালই ‘কিং মেকার’! অথচ সারদা মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পর এই কুণালকেই খেদিয়েছিল তৃণমূল। যদিও কুণালকে তৃণমূল থেকে ‘সাসপেন্ড’ করার কোনও ‘পর্চা’ আছে কিনা সন্দেহ। অবশ্য দলিল-দস্তাবেজ নিয়ে খামোখা মাথা ঘামান না তৃণমূল নেতৃত্ব। এই দলে মুখের কথাই যথেষ্ট। দশ বছর আগে আজকের দিনেই সারদা মামলায় গ্রেফতার হয়েছিলেন কুণাল ঘোষ। কুণাল তখন তৃণমূলের মনোনয়নে নির্বাচিত রাজ্যসভা সাংসদ, সাংবাদিকের পাশাপাশি শাসকদলের নেতাও। গ্রেফতারির দশ বছর পূর্তিতে সামাজিক মাধ্যমে রহস্যে ভরা পোস্ট করেছেন রহস্যময় কুণাল।
সারদা ঘোটালা ফাঁস হওয়ার পর কুণাল ঘোষই প্রথম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। সারদা মামলা সিবিআই-এর হাতে যাওয়ার বহু আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশই কুণালকে গারদে ভরেছিল। সাড়ে তিন বছর জেল খেটে বেরিয়ে তৃণমূল ও মমতাকে বিস্তর কটাক্ষ-টটাক্ষ শেষে ফের তৃণমূলেই ভেড়েন কুণাল। ততদিনে কালীঘাটের আদিগঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। মুকুল রায় ঘাসফুল ছেড়ে পদ্মফুলে। মেয়রত্ব-মন্ত্রিত্ব, বউ-বাচ্চা ও দলকে বিসর্জন দিয়ে বৈশাখীতে বুঁদ হয়ে গেছেন শোভন। উনিশের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির কাছে অনেক সিট হারিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিশেহারা। ঠিক কোন শর্তে বা কী উদ্দেশ্যে মমতার সঙ্গে রফা করে কুণাল তৃণমূলে ফেরেন, তা কুণালই জানেন। কুণালের বরাবরের দাবি, তিনি ভালবেসে তৃণমূল করেন, ভালবেসেই কালীঘাটে ফিরেছেন। বৃহস্পতিবারের পোস্টেও কুণাল ঘোষ লিখেছেন, “আমি তৃণমূল কংগ্রেস করছি শুধু এটা প্রমাণ করতে যে মন থেকেই দলটা করে এসেছি, আমি একজন সৈনিক এবং কুণাল ঘোষ বেইমান নয়।”
এত বড় সারদা কেলেঙ্কারিতে কুণাল ঘোষ ও মদন মিত্র ছাড়া তৃণমূলের আর কোনও নেতাকেই গ্রেফতার হতে হয় নি। বন্দিজীবনের সিংহভাগ ‘এসএসকেএম’-এ তোফা কাটিয়েছেন মদন। শুধু দুর্ভোগ থেকে রেহাই পান নি একা কুণাল। কাঁদতে কাঁদতে রাজ্য পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন। মমতার পুলিশ নাকে রশি দিয়ে তাঁকে রাজ্যের এক আদালত থেকে আরেক আদালতে টেনে নিয়ে গেছে। প্রিজন ভ্যানের ভেতর থেকে কুণাল চিৎকার করে বলতে চেয়েছেন সাংবাদিকদের। ভ্যানের গায়ে চাপড় মেরে মেরে কুণালের গলার আওয়াজ ঢেকে দিয়েছেন কনস্টেবলেরা। জেলবাসের জ্বালা জুড়োতে নিভৃত সেলে ঘুমের বড়ি খেয়ে আত্মহত্যা পর্যন্ত করেতে গিয়েছিলেন কুণাল ঘোষ। চিটফান্ড কেলেঙ্কারির সব জানেন মুখ্যমন্ত্রী- এই অভিযোগ করা কুণাল ঘোষ এখন তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্য সম্পাদক ও মুখপাত্র। নিজের গ্রেফতারির দশ বছর পূর্তিতে কুণাল যে পোস্ট করেছেন, তার শুরুতেই তিনি লিখেছেন, “ঠিক দশ বছর আগে আজকের তারিখে বিনা দোষে চক্রান্তমূলকভাবে আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।”
সারদা ঘোটালা ফাঁস হওয়ার পর থেকেই কুণাল ঘোষের এক কথা- আমি সুদীপ্ত সেনের মিডিয়া হাউজে চাকরি করতাম মাত্র, টাকাপয়সা লেনদেনের কিছুই জানতাম না। দলের মধ্যে যাঁরা সারদা কোম্পানির ঘাঁতঘোঁত সব জানতেন, তাঁরাই তাঁকে ষড়যন্ত্র করে বলির পাঁঠা করেছেন বলে একাধিকবার ইঙ্গিত দিয়েছেন কুণাল। বৃহস্পতিবারের পোস্টেও কুণাল ঘোষ লিখেছেন, “অনেকে ভেবেছিল আমি ধ্বংস হয়ে যাব। ঈশ্বরের আশীর্বাদে এখনও আছি। মিথ্যা সাক্ষী, মিথ্যা মামলায় জর্জরিত থেকেও আইনে লড়ছি।… আমার এবং আমার ঘনিষ্ঠদের সেদিনের চোখের জল, আর্তনাদ বৃথা যাবে না। সময় তা প্রমাণ করবে। ঈশ্বরের বিচার থেকে ষড়যন্ত্রীরা বাদ যাবে না।”
পোস্টেই স্পষ্ট যে কুণাল ঘোষ মনে করেন দুর্দিন কেটে গিয়ে তাঁর এখন সুদিন চলছে। কুণালের যে পোয়াবারো তা অবশ্য চর্মচক্ষেই সকলে দেখতে পাচ্ছেন। দলের ভেতরে তাঁর শত্রুরা প্রায় সবাই রাজনৈতিকভাবে নাশ হয়েছেন। মুকুল শারীরিক ও মানসিকভাবে ‘আউট অব অর্ডার’। পার্থ জেলে। রাজনীতি থেকে বহু দূরে শোভন চট্টোপাধ্যায়ের একমাত্র লক্ষ্য ডিভোর্স পেয়ে গেলে দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ করা। কুণাল ঘোষকে যখন অশ্রুপাত করতে করতে জেলে যেতে হয়েছিল, মুকুল রায় তখন তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কমান্ড। মমতার পরেই দলে, সংগঠনে এমনকি প্রশাসনে মুকুলই ছিলেন শেষ কথা। মূলতঃ মুকুলের অঙ্গুলিহেলনেই যে সারদা কেলেঙ্কারির কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়ে তিনি সাড়ে তিন বছর জেলের ঘানি টেনেছেন, একাধিকবার ঠারেঠোরে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন কুণাল ঘোষ। রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন, তৃণমূলে এখন মুকুলের জায়গা কুণালের দখলে। যদিও কুণাল মুখে বলছেন, “আমি তৃণমূল কংগ্রেস করছি শুধু এটা প্রমাণ করতে যে মন থেকেই দলটা করে এসেছি, আমি একজন সৈনিক এবং কুণাল ঘোষ বেইমান নয়। আমি দলের এমপি, এম এল এ হব না। দলের তরফে জনপ্রতিনিধি হব না। যতদিন ইচ্ছে থাকবে সসম্মানে দলের সাংগঠনিক কাজ করব। তারপর জীবন যেভাবে বলবে, সেইভাবে চলব।”
জেলফেরত কুণালের তৃণমূলে দ্রুত উত্থানের রহস্য কী তা এখনও উদ্ঘাটিত হয় নি। অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, কালীঘাট তৃণমূলের ভিত্তি কিন্তু ক্যামাক স্ট্রিটই তৃণমূলের ভবিষ্যৎ। ক্যামাক স্ট্রিটের অনেক ‘স্ট্রাটেজি’র উৎসই যে কুণাল ঘোষের মস্তিষ্ক এমন গুঞ্জন তৃণমূলের অন্দরমহলে কান পাতলেই শোনা যায়। গ্রেফতার হওয়ার দশ বছর পর সামাজিক মাধ্যমে কুণাল মান-অভিমান, ক্ষোভের কথা লিখেছেন। কুণালের গ্রেফতারের পেছনে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কোনওই ভূমিকা ছিল না, কুণাল নিজেও কি তা মন থেকে বিশ্বাস করেন? পোস্টের শেষ লাইনে তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক লিখেছেন, “গ্রেপ্তারের দিনগুলো এবং আমার ঘাড়ে কলঙ্ক চাপানোর পর্ব ভুলিনি, ভুলব না।” আঘাত পেয়ে যে ভোলে না সে অনেকভাবেই প্রতিশোধ নেয়, ইতিহাসে দেখা যায়। কুণাল কি কোনও আভাস দিলেন?
Feature graphic- NNDC.