কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে ‘ফ্রেশার’-দের যূথবদ্ধভাবে উৎপীড়ন করে মজা নেওয়ার যে নিষ্ঠুর খেলা, তার নামই ‘র্যাগিং’। র্যাগিং-কে এর ঊর্ধ্বে আর কোন মহত্তর সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা যায়, আমার জানা নেই। লিখলেন উত্তম দেব-
অপরকে অপদস্থ করার মধ্যে মানুষের একটা আদিম ও সহজাত আনন্দ আছে। মনস্তত্ত্বে যা ‘স্যাডিজম’ বা ধর্ষকাম নামে পরিচিত। ধর্ষকামের স্থূল অর্থ যদিও অন্যকে পীড়ন করে যৌন সুখানুভূতি লাভ কিন্তু ধর্ষকামের পরিধি তার স্থূল সংজ্ঞার চাইতে অনেক বড় এবং আমরা কেউই পুরোপুরি এই প্রবৃত্তির বাইরে নই। অন্যকে উত্যক্ত করে মজা পাওয়ার অভ্যেস শৈশব -কৈশোরেই তৈরি হয়ে যায়। দলবদ্ধ হলে যে এই আনন্দ চতুর্গুণ বৃদ্ধি পায়, এই শিক্ষাও পাঠশালা থেকেই যুগে যুগে রপ্ত করে সবাই। বদভ্যাসের দমন ও সদভ্যাসের বিকাশ সাধন করে নিজেকে শোধন করার নামই সংস্কার। তাই বড় হওয়ার সাথে সাথে অন্যকে পীড়া দিয়ে আমোদ পাওয়ার অভ্যেসটিকে যথাসাধ্য নিয়ন্ত্রণ করতে শিখতে হয় আমাদের। এই শেখাটা ঐচ্ছিক নয় বাধ্যতামূলক। কারণ সমাজে একসাথে বাঁচতে গেলে নিজেকে ঘষেমেজে মার্জিত করা জরুরী।
র্যাগিং ধর্ষকাম ছাড়া আর কিছু নয়
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে ফ্রেশার-দের যূথবদ্ধভাবে উৎপীড়ন করে মজা নেওয়ার যে নিষ্ঠুর খেলা, তার নামই ‘র্যাগিং’। র্যাগিং-কে এর ঊর্ধ্বে আর কোন মহত্তর সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা যায়, আমার জানা নেই। মানুষ তো বটেই পৃথিবীতে এমন কোনও প্রাণী নেই, যে উৎপীড়িত হতে ভালবাসে। তবে অন্যকে উৎপীড়ন করতে একটা বিড়ালেরও মন্দ লাগে না। এর নামই ধর্ষকাম। ধর্ষকাম তাড়িত র্যাগিং যদি সমর্থনযোগ্য হয় তবে ‘তাহারুশ’ কী দোষ করল? মনের কুপ্রবৃত্তিকে সংযত করে আমরা সমাজে চলি; একে চাগিয়ে তোলে যে সংস্কৃতি, তাকে নির্মূল করাই তো একটা সভ্য সমাজের দায়িত্ব। ‘র্যাগিং’ আমাদের কাছে নতুন কোনও শব্দ নয়। র্যাগিং ক্যাম্পাস-হস্টেল জীবনের একটা বাজে পরম্পরা, নিঃসন্দেহে যার বিবর্তনের ইতিহাস আছে।
ইংরেজি অভিধানে র্যাগিং-এর হালকা থেকে গুরুগম্ভীর অনেক প্রতিশব্দ আছে। তবে র্যাগিং-এর সবথেকে জুতসই প্রতিশব্দ একটাই- ‘অ্যাবিউজ’। অ্যাবিউজ শব্দ ও তার নিহিতার্থ আদ্যন্ত নেতিবাচক। অ্যাবিউজ মানে ‘ইনসাল্ট’ বা অবমাননা। এই ইনসাল্ট যখন ‘টরচার’ বা নির্যাতনে পরিণত হয়, তখন ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে ‘র্যাগিং’। শুরুতে র্যাগিং ছিল নবাগতদের সঙ্গে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সিনিয়র’-দের আপাত নির্দোষ হাসি-ঠাট্টা, মশকরা। স্বাধীনতার আগে খ্রিস্টান মিশনারি পরিচালিত কয়েকটি এলিট কলেজ ও ‘আর্মি ইনষ্টিটিউট’ গুলিতে মজাচ্ছলে নতুনদের সঙ্গে এই জিনিস চলত বলে জানা গেছে। যদিও র্যাগিং-এর কারণে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রথম ছাত্র মৃত্যুর ঘটনা আমেরিকাতে ঘটেছিল ১৮৭৩ সালেই। নিউইয়র্কের কর্ণেল ইউনিভার্সিটির ভবন থেকে পড়ে মারা গিয়েছিল একজন ছাত্র। ষাটের দশক পর্যন্ত ভারতের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের ‘র্যাগিং’ নামক দুঃসহ কোনও পরিস্থিতির সামনে পড়তে হত না। ডেঁপো সহপাঠীর পাল্লায় পড়ে গোল্লায় যাওয়ার ঘটনা চিরকাল ছিল। সে অন্য জিনিস। কিন্তু তখনও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক জীবনে র্যাগিং নামক সংগঠিত নির্যাতনের চল হয় নি।
আশীর দশকে শুরু, নব্বুইয়ের দশকে চরমে
সত্তরের দশকের সূচনায় রাজনৈতিক কারণে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক পরিচয় ভিন্ন; সেই হেতু সহপাঠীকে মারধর এমনকি খুন পর্যন্ত করা চলে, নকশাল আন্দোলনের হাত ধরে এই দর্শন আত্মস্থ করে পড়ুয়ারা। সত্তর-একাত্তর-বাহাত্তরের অশান্ত সময়ে র্যাগিং নয় সন্ত্রাস ও বোমা-পাইপগানের ছাত্র রাজনীতির কারণে কলেজ, ইউনিভার্সিটির আবাসিক জীবন ভীতিকর হয়ে উঠেছিল। আশীর দশক পড়তেই ছাত্রদের বৃহদাংশ রাজনীতি বিমুখ হল বটে কিন্তু রাগ-ক্ষোভ-হিংস্রতা তাদের মনের গভীরে স্থায়ী ছাপ ফেলে দিল। ৮০-৮১ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেডিকেল কলেজগুলির হস্টেলে যে র্যাগিং শুরু হয়েছিল, পদ্ধতিতে তা আর নিরীহ থাকল না। নব্বুইয়ের দশকে এসে ‘র্যাগিং’ শব্দটা মধ্যবিত্ত সমাজের সঙ্গে জুড়ে যায়। যত নামী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান, তার হস্টেল র্যাগিং-এর জন্য তত কুখ্যাত হয়ে ওঠে। বিভিন্ন আইআইটি থেকে শুরু করে দেশের নামডাক ওয়ালা ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেডিকেল কলেজগুলিতে র্যাগিং ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে ৯৪ থেকে ৯৭-এর মধ্যে। বহু মেধাবী ছেলেমেয়ের ভবিষ্যত নষ্ট হয়ে যায়। অবসাদে কেউ মানসিক ভারসাম্য হারায়। অপমানে কয়েকজন আত্মহত্যা করে। নির্যাতনে মৃত্যু পর্যন্ত হয়।
আইনের চোখে র্যাগিং ফৌজদারি অপরাধ
দেশের মধ্যে তামিলনাড়ু প্রথম রাজ্য, যেখানে ১৯৯৭ সালে আইন এনে রাজ্যের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে র্যাগিং নিষিদ্ধ করে সরকার। ২০০১-এ সারা দেশে র্যাগিং নিষিদ্ধ করে সুপ্রিম কোর্ট। ২০০৯ সালে দেশের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় এবং নিয়ামক সংস্থাকে কঠোরভাবে ‘অ্যান্টি র্যাগিং ল’ কার্যকর করার নির্দেশ দেয় শীর্ষ আদালত। একজন ছাত্রের সঙ্গে কী কী আচরণ করলে তা র্যাগিং বলে গণ্য হবে, সেই নিয়ে সুস্পষ্ট গাইড লাইনস আছে ইউজিসির। আইনের চোখে র্যাগিং নিষিদ্ধ এবং ফৌজদারি অপরাধের অন্তর্ভূক্ত। আইন করে যেমন খুন-ধর্ষণ নির্মূল করা যায় না তেমনি র্যাগিংও যায় না বন্ধ করা। কিন্তু র্যাগিংকে ইনিয়ে-বিনিয়ে ন্যায্য প্রমাণ করতে চাইলে খুন-ধর্ষণকেও অন্যায্য বলা যাবে না।
র্যাগিং মানেই এখন যৌন নির্যাতন!
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বপ্নদীপ কুন্ডুর চরম পরিণতির জন্য যে কারণকে দায়ী করা হচ্ছে, তা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ছাপিয়ে যৌন নির্যাতন ছাড়া আর কিছু নয়। এখনকার র্যাগিংয়ে ‘ইন্ট্রো’ বলে যে পর্বটি আছে, তাতে ফ্রেশারদের উপরে যৌন নির্যাতনের বিষয়টাই সব থেকে বড় ‘ইভেন্ট’ বলে শোনা যাচ্ছে। হস্টেলগুলিতে ইন্ট্রোর নামে ছেলেমেয়েদের যে ধরণের যৌন নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হচ্ছে, তা ‘তাহারুশের’ চেয়ে কম কীসে? যারা সহ্য করছে, তাদের মনের অবস্থাটা ভাবুন। বিষয়টিকে বেশিরভাগই হয়তো হালকাভাবে নিচ্ছে, সামলে নিচ্ছে অথবা শুনতে খারাপ লাগলেও পরের বছর সেও এই সুযোগ পাবে ভেবে স্বেচ্ছায় সম্মতি দিচ্ছে। কিন্তু যে ছেলেমেয়েরা এই ‘সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ’ কোনও মতেই নিতে পারছে না, তারা কোন ‘ট্রমা’র মধ্যে গিয়ে পড়ছে, তা আমরা তলিয়ে ভাববো না? স্বপ্নদীপ যে সামান্য কয়দিনের আবাসিক জীবনেই ‘ট্রমাটাইজ’ হয়ে পড়েছিল, ছেলেটির বাবা-মায়ের কথায় তা স্পষ্ট।
চক্রটাকে ভাঙো
র্যাগিং এমনিতেই একটা ভয়ঙ্কর চক্র। এই বছরে ফ্রেশার হয়ে যে নির্যাতন সহ্য করছে, আগামী বছর সে-ই ‘র্যাগার’ হয়ে নতুন একজনকে নির্যাতন করে পৈশাচিক আনন্দ পাবে। আর কোনও স্বপ্নদীপ এই চক্রের মধ্যে পড়ে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় সহ সর্বত্র চক্রটাকে ভেঙে দেওয়া প্রয়োজন।
Feature image is representational.