শোকোচ্ছ্বাস বলে কিছুর অস্তিত্ব ছিল না মানুষটার জীবনে। অথচ শোকসাগরে ভেসে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি কবির জীবনে তৈরি হয়েছিল বারে বারে। বাইশে শ্রাবণে কবিগুরুকে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিলেন উত্তম দেব-
প্রবল প্রতিভাধরদের চিত্ত সদা অচঞ্চল, অবিচল থাকে, এমন কথা নেই। বরং প্রতিভার ভার অনেক সময় অধিক চিত্ত বৈকল্যের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ব্যক্তিজীবনের জ্বালা-যন্ত্রণা, শোক-তাপ অভাব-অভিযোগের অভিব্যক্তি মানুষ মাত্রেই এক-একজনের এক-একরকম। সংসারে যাঁদের ‘জিনিয়াস’ বলা হয়, তাঁদের ব্যক্তিগত জ্বালা-যন্ত্রণা, শোক-তাপের অভিব্যক্তির মধ্যেও ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। ৮২ বছর আগে আজকের দিনে যে মানুষটির জীবনাবসানে গোটা বঙ্গদেশের জনচিত্ত উদ্বেলিত হয়েছিল, সেই মানুষটি শোক-তাপ, জ্বালা-যন্ত্রণার মধ্যেও কীভাবে নিজের চিত্তকে আপন কর্মে আমৃত্যু স্থির রেখেছিলেন, ভাবলে আশ্চর্য লাগে। স্বজাতির গড় চরিত্রের সঙ্গে এই জায়গাতেও একটি বড় পার্থক্য গড়ে রেখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ভেতরের কিম্বা বাইরের আঘাতে রবীন্দ্রনাথের মন কখনও এমন বিক্ষিপ্ত হয় নি, যা তাঁর সৃজনশীলতাকে ব্যাহত, বিকৃত করেছে। স্বজাতির গালমন্দ, সাংসারিক ঝামেলা, অর্থকষ্ট, ঋণগ্রস্ততা, এবং পরমাত্মীয়দের বিয়োগ ও তজ্জনিত শোক কবির মনকে ভারাক্রান্ত করত বটে; কিন্তু সেই ভার নিশ্চুপে কখন তিনি নামিয়ে রাখতেন, তাঁর খুব ঘনিষ্ঠরাও তা টের পেত না। ‘শোকোচ্ছ্বাস’ বলে কিছুর অস্তিত্ব ছিল না মানুষটার জীবনে। অথচ শোকসাগরে ভেসে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি কবির জীবনে তৈরি হয়েছিল বারে বারে। মায়ের যখন মৃত্যু হয়, রবীন্দ্রনাথ ১৪ বছরের কিশোর। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে মায়ের সঙ্গে সন্তানদের যোগাযোগ কেমন ছিল, সেই চিত্র ‘জীবনস্মৃতি’তে লিখে গেছেন রবীন্দ্রনাথ। ছোটবেলায় মাকে নিবিড়ভাবে না পাওয়ায় দুঃখ জীবনভর বয়ে বেড়িয়েছেন কবি। পরিণত বয়সে আক্ষেপ করে তিনি লিখেছেন, “মা যে কী জিনিস তা জানলুম কই আর!” শৈশব-কৈশোরে মায়ের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগের সুযোগ হয়ে ওঠে নি। তাই মায়ের অকাল ও আকস্মিক মৃত্যুতে কিশোর রবির মনে হঠাৎ অনুভূত শোক দূরীভূত হতে সময় নেয় নি। জীবনস্মৃতিতে ঘটনাটিকে রবীন্দ্রনাথ বর্ণনা করেছেন এইভাবে- “…জীবনে প্রথম যে মৃত্যু কালো ছায়া ফেলিয়া প্রবেশ করিল, তাহা আপনার কালিমাকে চিরন্তন না করিয়া ছায়ার মতোই একদিন নিঃশব্দ পদে চলিয়া গেল।”
যে মৃত্যুশোক রবীন্দ্রনাথের জীবনে স্থায়ী প্রভাব ফেলে, তা এসেছিল কবির ২৪ বছর বয়সে। জ্যোতিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী কাদম্বরী দেবী- যাকে রবি নতুন বৌঠান বলে ডাকতেন। মাতৃহীন রবির জীবনে নিঃসন্তান কাদম্বরী দেবী কোন বহুমাত্রিক স্থানটি নিয়েছিলেন, তা নানা পরিপ্রেক্ষিতে একাধিকবার বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। কবিগুরু লিখেছেন, “বাংলাদেশে বৌদি সম্পর্কটি বড় মধুর। এমনটি আর কোনো দেশে নেই। মনে পড়ে আমার নতুন বৌঠানের কথা…খুব ভালবাসতাম তাকে, তিনিও খুব ভালোবাসতেন। এই ভালবাসায় নতুন বৌঠান বাঙ্গালী মেয়েদের সঙ্গে আমার প্রাণের তার বেঁধে দিয়ে গেছেন। আমার সকল আবদারের ঐ একটাই স্থান ছিলো- নতুন বৌঠান। কত আবদার করেছি,কত যত্ন, ভালোবাসা পেয়েছি।” রবির যখন মাত্র সাত বছর, তখন নববধূ রূপে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে প্রবেশ নয় বছরের বালিকা কাদম্বরীর। পুতুল খেলার সঙ্গী থেকে আবদারের জায়গা এবং তা ছাড়িয়ে সাহিত্য জীবনের প্রথম প্রভাতে প্রেরণার অন্যতম উৎস নতুন বৌঠানের অপঘাতে আকস্মিক মৃত্যু নাড়িয়ে দিয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে। জীবনস্মৃতি-তেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “আমার চবিশ বছর বয়সের সময় মৃত্যুর সঙ্গে যে পরিচয় হইল, তাহা স্থায়ী পরিচয়। তাহা তাহার পরবর্তী প্রত্যেক বিচ্ছেদশোকের সঙ্গে মিলিয়া অশ্রুর মালা দীর্ঘ করিয়া গাঁথিয়া চলিয়াছে।”
৪১ বছর বয়সে পত্নীবিয়োগ। ১৯০২-এর ২৩ নভেম্বর রাতে মৃণালিনী দেবী যখন দেহ রাখলেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র ঊনত্রিশ। স্ত্রীর অন্তিম মুহূর্ত আসন্ন বুঝতে পেরে পুত্র রথীকে পুরোনো বাড়ির তেতলায় পাঠিয়ে দিয়ে জোড়াসাঁকোর নতুন বাড়ির ছাদে নিজে সারারাত পায়চারি করেন রবীন্দ্রনাথ। ভোররাতে চলে গেলেন মৃণালিনী। দুপুরে শেষকৃত্য শেষে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবেরা ফিরে যান। শূন্যগৃহে রথীন্দ্রনাথকে ডেকে স্ত্রীর চটিজোড়া হাতে তুলে দিয়ে কবি বলেন, “এটা তোর কাছে রেখে দিস, তোকে দিলুম।” ভেতরের শোক-তাপ-জ্বালা কখনও সোচ্চারে বাইরে প্রকাশ করেন নি রবীন্দ্রনাথ। স্ত্রীর মৃত্যুর বছর না ঘুরতেই যক্ষ্মায় ভুগে কন্যা রেণুকার মৃত্যু মাত্র ১৩ বছর বয়সে। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে ছিল রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর প্রায় নিত্য যাতায়াত। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাহিত্যালাপের ফাঁকে বন্ধুর অসুস্থ কন্যাকে দেখতে ভুলতেন না রামেন্দ্রসুন্দর। সেপ্টেম্বরের একদিন বিকেলে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গল্প করতে করতে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী জানতে চান, “রেণুকা কেমন আছে?।” নিষ্কম্প কন্ঠে রবীন্দ্রনাথ জবাব দেন, “আজ সকালে সে মারা গেছে।” বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেই স্থানুবৎ হয়ে যান রামেন্দ্রসুন্দর। এরপর কোনও কথা না বলে সিঁড়ি বেয়ে নেমে সোজা প্রস্থান করেন তিনি।
কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ছায়া দেখতে পেতেন কবির ঘনিষ্ঠরা। কনিষ্ঠ পুত্রকে খুব ভালোও বাসতেন কবি। বন্ধুদের সঙ্গে মুঙ্গের ভ্রমণে গিয়ে ১৯০৭-এর ২৩ নভেম্বর কলেরায় মৃত্যু হল তাঁর। ছেলের অসুস্থতার খবর পেয়েই কলকাতা থেকে চিকিৎসক নিয়ে মুঙ্গেরে ছুটে যান রবীন্দ্রনাথ। প্রিয় পুত্রের মৃত্যুর মুহূর্তে পাশের ঘরে রবীন্দ্রনাথ ধ্যানমগ্ন। শেষকৃত্য সেরে ফিরে আসেন বোলপুরে। বারো বছরের কনিষ্ঠ পুত্রের মৃত্যুতে তাঁর অন্তরাত্মার অনুভূতি কেমন হয়েছিল, অনেক বছর পরে পুত্র শোকাতুর কন্যা মীরাকে চিঠিতে বর্ণনা করেছিলেন গুরুদেব- “শমী যে রাত্রে গেল তার পরের রাত্রে রেলে আসতে আসতে দেখলুম জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্চে, কোথাও কিছু কম পড়েচে তার লক্ষণ নেই। মন বললে, কম পড়েনি- সমস্তর মধ্যে সবই রয়ে গেছে, আমিও তারই মধ্যে। সমস্তর জন্যে আমার কাজও বাকি রইল । যতদিন আছি সেই কাজের ধারা চলতে থাকবে । সাহস যেন থাকে, অবসাদ যেন না আসে, কোনোখানে কোনো সূত্র যেন ছিন্ন হয়ে না যায়— যা ঘটেচে তাকে যেন সহজে স্বীকার করি, যা কিছু রয়ে গেল তাকেও যেন সম্পূর্ণ সহজ মনে স্বীকার করতে ত্রুটি না ঘটে।”
শমীর মৃত্যুর পরে পরেই কাদম্বিনী দত্তকে একটি পত্রে কবি লিখেছিলেন, “ঈশ্বর আমাকে বেদনা দিয়াছেন কিন্তু তিনি তো আমাকে পরিত্যাগ করেন নাই- তিনি হরণও করিয়াছেন পূরণও করিবেন। আমি শোক করিব না- আমার জন্যও শোক করিয়ো না।” ১৯১৮-র ১৬ সেপ্টেম্বর বড়মেয়ে মাধুরীলতাকে হারান রবীন্দ্রনাথ। কবি ডাকতেন ‘বেলা’। বেলা কলকাতায় মৃত্যু শয্যায়। শান্তিনিকেতনে কর্মযজ্ঞে ব্যস্ত গুরুদেব। পুত্র রথীকে লিখছেন- “জানি বেলার যাবার সময় হয়েচে। আমি গিয়ে তার মুখের দিকে তাকাতে পারি এমন শক্তি আমার নেই। এখানে জীবন-মৃত্যুর উপরে মনকে রাখতে পারি, কিন্তু কলকাতায় সে আশ্রয় নেই। আমি এইখান থেকে বেলার জন্যে যাত্রাকালের কল্যাণ কামনা করচি। জানি, আমার আর কিছু করার নেই।”
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু ভাবনা, মৃত্যু দর্শন কেমন ছিল, দৌহিত্র নীতিন্দ্রনাথের মৃত্যুর (১৯৩২-এর ৭ অগাস্ট) পর মীরাকে লেখা পত্রেই তার নিদর্শন মেলে। পুত্র শোকাতুর কন্যাকে কবি লিখেছেন, “যে রাত্রে শমী গিয়েছিল সে রাত্রে সমস্ত মন দিয়ে বলেছিলুম বিরাট বিশ্বসত্তার মধ্যে তার অবাধ গতি হোক, আমার শোক তাকে একটুও যেন পিছনে না টানে। তেমনি নীতুর চলে যাওয়ার কথা যখন শুনলুম তখন অনেকদিন ধরে বারবার করে বলেচি, আর তো আমার কোনো কর্তব্য নেই, কেবল কামনা করতে পারি এর পরে যে বিরাটের মধ্যে তার গতি সেখানে কল্যাণ হোক।”
আমরা বুঝতে পারি, ধারাবাহিক মৃত্যুশোক, বিরহ-বেদনা, শত যাতনাতেও অচঞ্চল, অবিচল রবি ঠাকুর কেন জীবনদেবতার উদ্দেশ্যে বলতে পারেন-
এই করেছ ভালো, নিঠুর হে, নিঠুর হে, এই করেছ ভালো।
এমনি ক’রে হৃদয়ে মোর তীব্র দহন জ্বালো॥
আমার এ ধূপ না পোড়ালে গন্ধ কিছুই নাহি ঢালে,
আমার এ দীপ না জ্বালালে দেয় না কিছুই আলো॥
যখন থাকে অচেতনে এ চিত্ত আমার
আঘাত সে যে পরশ তব, সেই তো পুরস্কার।
Feature & other images source- archives.