তৃণমূলের এক প্রার্থীকে ভুয়ো ওবিসি শংসাপত্র পাইয়ে দেওয়ায় উলুবেড়িয়া- ১ ব্লকের বিডিও, উলুবেড়িয়ার মহকুমা শাসক এবং এসসি-এসটি ও ওবিসিদের শংসাপত্র প্রদানকারী দফতরের এক আধিকারিককে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। উলুবেড়িয়া-১ এর বিডিও নিলাদ্রীশেখর দে শুধু এতেই থামেন নি। ওবিসিদের জন্য সংরক্ষিত ওই আসনে ভুয়ো শংসাপত্র পাওয়া শাসকদলের প্রার্থী যাতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে পারেন, সেই লক্ষ্যে বিরোধী দুই প্রার্থীর মনোনয়নপত্রও জোর করে বাতিল করে দেন। তিনি বিরোধী প্রার্থীদের মনোনয়নের সঙ্গে জমা দেওয়া নথিতে বিকৃতি ঘটিয়েছেন বলে আদালত নিযুক্ত তথ্যানুসন্ধান কমিটি মেনে নিয়েছে।
কী ভয়ঙ্কর অভিযোগ! শুধু অভিযোগ বললে ভুল হবে। কেননা, তাঁদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ ডিভিশন বেঞ্চে প্রমাণিত হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার পর দোষী আধিকারিকদের আর এক মুহূর্তও পদে বহাল রাখা চলে না। সেই রকমই নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। উত্তর চব্বিশ পরগনার মিনাখাঁর কুমারজোল গ্রাম পঞ্চায়েতের এক তৃণমূল প্রার্থী মক্কায় বসে। অথচ মিনাখাঁ ব্লক অফিসে তাঁর মনোনয়ন জমা পড়ে গেছে। আদালতের নির্দেশে রাজ্য নির্বাচন কমিশন ভোটের আগেই ওই প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করেছিল বটে কিন্তু বিডিওর মদত বিনা যে এই দুষ্কর্ম সাধন সম্ভব নয়, তা বোঝার জন্য ‘জেমস বন্ড’ না হলেও চলে। মিনাখাঁর ঘটনাতেও হাইকোর্টের নির্দেশে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি দেবীপ্রসাদ দে-র নজরদারিতে তদন্ত চালাচ্ছে সিআইডি। মিনাখাঁর বিডিও শেখ কামরুল ইসলামের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, প্রতারণা-সহ একাধিক ধারায় মামলা রুজু করে পুলিশ। পশ্চিমবঙ্গে এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে শাসকদলের থেকেও বেশি অভিযোগ প্রশাসনের আধিকারিকদের বিরুদ্ধে। উলুবেড়িয়া ও মিনাখাঁর ঘটনা আদালতের চোখে ধরা পড়েছে। কিন্তু আরও একাধিক বিডিও-এসডিওর বিরুদ্ধে অনুরূপ অভিযোগ আদালতে দায়ের করেছেন বিরোধী প্রার্থীরা।
প্রশাসনের আধিকারিকেরা ইচ্ছেয় হোক আর চাপে পড়ে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করে শুধু পঞ্চায়েত নির্বাচনের স্বচ্ছতাই নষ্ট করেন নি তাঁরা তাঁদের উপর ন্যস্ত সাংবিধানিক দায়িত্বও লংঘন করেছেন। পঞ্চায়েত ভোটকে ঘিরে বিডিও, এসডিও-র মতো আমলা এবং রাজ্য পুলিশের আধিকারিকদের বিরুদ্ধে যে স্তরের অভিযোগ উঠেছে তারপরে রাজ্য প্রশাসনের উপর শুধু বিরোধীদের নয় জনগণেরও আস্থা থাকার কথা নয়। বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা হলে, উপেক্ষা করার কারণ ছিল। কিন্তু এই রাজ্যে প্রশাসনের যে ভাবে দলীয়করণ ঘটে গেছে, তারপরেও চুপ করে বসে থাকলে বাঙালির জীবনে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সর্বাত্মক অবক্ষয় অনিবার্য।
কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের কাছে রাজ্যের পঞ্চায়েত ভোটের সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরা প্রয়োজন। পশ্চিমবঙ্গে কীভাবে সরকারের ‘মেশিনারি’ শাসকদলের ব্যাক অফিসে পরিণত হয়েছে, তা বিস্তারিত তথ্য সহ জাতীয় নির্বাচন কমিশনের নজরে আনতে হবে। কোন কোন আমলা, আধিকারিক এবং পুলিশের ছোটবড় অফিসার পঞ্চায়েত ভোটে কীভাবে নিরপেক্ষতা জলাঞ্জলি দিয়েছেন, সেই সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য দেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সামনে রাখা দরকার। জাতীয় নির্বাচন কমিশন পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি নিয়ে এমনিতেই যথেষ্ট ওয়াকিবহাল, সজাগ ও সতর্ক। কিন্তু তারপরেও সদ্য সমাপ্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজ্যে যা যা কান্ড ঘটে গেছে, তার সবকিছুই জাতীয় নির্বাচন কমিশনের কানে তুলতে হবে।
নির্বাচন সংক্রান্ত কিছু অনিয়ম দেশের অন্যান্য প্রদেশেও মোকাবিলা করে থাকে কমিশন। কিন্তু ইদানিং বাংলার সঙ্গে কারও তুলনা হয় না। পশ্চিমবঙ্গে প্রশাসনের বৃহদাংশ রাজ্যের শাসকদলের প্রতি ‘কমিটেড’ হয়ে গেছে। এঁদের কাছে সরকার আর সরকারি দল সমার্থক। ফলে সরকারি দলের কাছে আত্মসমর্পণ করতে গিয়ে এঁরা সংবিধানের প্রতি আনুগত্য জলাঞ্জলি দিয়েছেন। পঞ্চায়েত ভোটে প্রশাসনের যে আধিকারিকেরা শাসকদলের অনিয়ম দেখে শুধু নিষ্ক্রিয়ই থাকেন নি স্বয়ং নিজেরাই শাসকদলের হয়ে অনিয়ম করেছেন, তাঁদের তালিকা জাতীয় নির্বাচন কমিশনের কাছে থাকা উচিত। এই ‘কমিটেড’ আমলা-আধিকারিক, আইএএস-আইপিএস ক্যাডারদের রাজ্যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ‘ক্ষতিকারক’ হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁদের ভবিষ্যতে সমস্ত রকমের নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে।
Feature image is representational.