পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের অধঃপতনের সবথেকে বড় কারণ যে তৃণমূল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে কংগ্রেসের রক্ত-মাংস-মজ্জার প্রায় সবটুকুই শুষে নিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২৫ বছর আগে কংগ্রেসের বিভাজনে সবথেকে খুশি হয়েছিল সিপিএম। গণতন্ত্রে শত্রু শিবির আড়াআড়ি ভাগ হয়ে গেলে কোন দল না পুলকিত হয়। ২০০৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে বিরোধী ভোট ভাগাভাগির ফায়দা তুলেছিল বামফ্রন্ট। ২০০৯ থেকে ১১- তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেস হাত মিলিয়ে না চললে পালা বদল খুব সহজ হত না বলেই অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের ধারণা। ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তির মতো ফালতু ইস্যু নিয়ে বামেরা ইউপিএ সরকারের উপর থেকে সমর্থন না তুললে কংগ্রেসকে মমতা থেকে দূরে রাখা সম্ভব হত বলে অনেক বামপন্থী মনে করেন। এই জন্য মালওয়ালি প্রকাশ কারাতকে এখনও আড়ালে কাঁচা খিস্তি মারেন তাঁর বাঙালি কমরেডরা।
২০১১ সালে বাম পতনের পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্ত্রিসভায় কংগ্রেসের স্থান হয়েছিল। কিন্তু তৃণমূলের সঙ্গে প্রদেশ কংগ্রেসের রাজনৈতিক দাম্পত্যের মেয়াদ দেড় বছরও স্থায়ী হয় নি। ছাড়াছাড়ি হতেই কংগ্রেসকে নিঃস্ব করতে যা যা করার দরকার তার কোনটাই করতে বাকি রাখেন নি মমতা। যখন যেই প্রদেশ কংগ্রেস নেতাকে কেনার কিনেছেন। কংগ্রেসের বিধায়ক ভাঙাতে সেই সময় মুকুল রায়ের মতো দক্ষ ভাঙারিকে মাঠে নামিয়েছেন। বিভিন্ন পুরসভায় ও পঞ্চায়েতে কংগ্রেসের বোর্ড রাতারাতি তৃণমূলের হয়ে গেছে। পদ ও পয়সায় কাজ না হলে মামলা মোকদ্দমা দিয়ে হলেও কংগ্রেসের জনপ্রতিনিধিদের দলে টেনেছে তৃণমূল।
রাজ্যের যে সব পকেটে বিক্ষিপ্তভাবে কংগ্রেসের শক্তি অবশিষ্ট ছিল সে সব পকেটের অধিকাংশ জনপ্রিয় কংগ্রেস নেতা তৃণমূলের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। বাম আমলেও কংগ্রেসের বলার মতো জনভিত্তি ছিল সংখ্যালঘু অধ্যুষিত দুটি জেলায়। সিপিএম অনেক চেষ্টা করেও মালদহের কংগ্রেস গড় ভাঙতে পারে নি। অথচ তৃণমূলের আমলে গণির রেখে যাওয়া সাম্রাজ্যে ভাঙন ধরাতে মমতার সময় লাগে নি। একা কুম্ভ হয়ে মুর্শিদাবাদে নিজের গড় অনেক দিন আগলে রেখেছিলেন অধীররঞ্জন চৌধুরী। কিন্তু মুর্শিদাবাদে মমতার আগ্রাসনের সামনে কংগ্রেসের আজ কী পরিণতি হয়েছে, তা সবাই চাক্ষুষ করতে পারছেন।
প্রদেশ কংগ্রেসের নেতারা যখন বুঝলেন মমতার রাজত্বে দলের সাইনবোর্ড পর্যন্ত টেকানো মুশকিল, তখন বামেদের সঙ্গে হাত মেলানো ছাড়া তাদের সামনে আর কোনও গত্যন্তর রইল না। রাজনীতিতে সবই সম্ভব! নইলে কে কবে ভেবেছিল বাংলায় অস্তিত্ব বাঁচাতে বাম ও কংগ্রেস এক ছাতার তলায় আশ্রয় নেবে। এক ছাতার তলায় এসেও অবশ্য বাম-কংগ্রেসের হাল শেষ পর্যন্ত ফেরে নি। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে বাম-কংগ্রেসের জোট তৃণমূলকে পর্যুদস্ত করতে গিয়ে নিজেরাই পর্যুদস্ত হয়ে যায়। এর পর থেকে বাংলার বিরোধী পরিসর বিজেপির দিকে সরতে শুরু করে। আঠারোর পঞ্চায়েত ভোটে বিজেপির ‘সেকেন্ড পজিশন’ দিয়ে রাজ্য রাজনীতির চরিত্র বদলের পূর্বাভাস। উনিশের লোকসভা নির্বাচনে বাম শূন্য কংগ্রেস দুই। ৪০.১৩ শতাংশ ভোট টেনে নিয়ে বিজেপির আসন দুই থেকে আঠারো! একুশের বিধানসভা নির্বাচনে বাম ও কংগ্রেস উভয়েই শূন্য। ৩৮.১৪ শতাংশ ভোট পেয়ে রানার্স বিজেপি তিন থেকে সাতাত্তর। তারপরেও রামের ভোট বামে ফিরবে- এই আশা তো মরে না। কথায় আছে আশায় বাঁচে চাষা। ফের জোট হলে হাল ফিরবে- এই প্রত্যাশাতেই তো আলিমুদ্দিনে আশার আলো এখনও নিভে নাই। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে যেন মুজাফফর আহমেদ ভবনে লাল বাতি না জ্বালিয়েই ছাড়বেন না মমতা।
চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনের আগে ফের তৃণমূলের প্রণয় লাভের সৌভাগ্য কংগ্রেসের। রাহুল-সোনিয়ার ২৬ দলের মোদী বিরোধী জোটের সব থেকে বড় সহায় নাকি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বেঙ্গালুরু থেকে দিল্লি ফিরে মা-বেটার খুশি আর ধরে না। কে না জানে, কংগ্রেস মানেই হাইকমান্ড আর হাইকমান্ড মানেই গান্ধী পরিবার। আনন্দে প্রেমিক কংগ্রেস গাহিতেছে- “মনে চায়, প্রাণে চায় দিল চায় যারে/ তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো, আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে।” আঁধার মুখে অধীর কেবল ভাবিতেছেন, “এই ভীষণ প্রেমে মরিয়া ডুবিব না ডুবিয়া মরিব! তৃণমূলের সহিত নিকাহ হইয়া গেলে সতীন সিপিএমকে লইয়া কীভাবে ঘর করিব?”
Feature image is representational.