আদালত কড়া পদক্ষেপ না করলে এই আমলে কেন রাজ্যে পুর ও পঞ্চায়েত ভোটে স্বচ্ছতার আশা শেষ, বিশ্লেষণ করলেন নব্যেন্দু মৌলিক-
যে নির্বাচনের স্বচ্ছতা আদালতের চোখে প্রশ্নবিদ্ধ এবং নির্বাচন ঘিরে যাবতীয় অনাচার মানুষের স্থূলচক্ষেই ভীষণভাবে প্রকটিত, সেই নির্বাচনে ৮০ শতাংশ গ্রাম পঞ্চায়েত, ততোধিক পঞ্চায়েত সমিতি এবং শতভাগ জেলা পরিষদ দখল করে তৃণমূল নেতৃত্ব কোন আত্মশ্লাঘায় আক্রান্ত? ফল ঘোষণার পর দেখতে পাচ্ছি, তৃণমূলকে হাওয়া দিচ্ছে কোনও কোনও সংবাদ মাধ্যমও! মানুষকে কি গাধা মনে করে তৃণমূল ও সেইসব সংবাদমাধ্যম? লোকসভা নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠিত এই ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ভোটে অবশ্যই জনমতের গতিপ্রকৃতি বুঝে নেওয়ার একটি সুযোগ ছিল যদি নির্বাচনটা মোটের উপর অবাধ ও সুষ্ঠু হত। যদি… যদিটা কিন্তু হয় নি।
রাজ্যে পুর ও পঞ্চায়েত ভোটে স্বচ্ছতার আশা কি শেষ?
পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলায় হিংসা-হানাহানি নতুন নয়। বাম জামানায় গায়ের জোরে গ্রাম দখল সিপিএমের ক্যাডাররাও করত। কিন্তু মমতার আমলে সার্বিক জোচ্চুরিতে আগের পঞ্চায়েত ভোট থেকে পরের পঞ্চায়েত ভোটকে ছাপিয়ে যাচ্ছে শাসকদল। তাই তেইশের পঞ্চায়েত ভোটের দুষ্কর্ম আঠারোর পঞ্চায়েত ভোটকেও ছাপিয়ে গেছে। অথচ নির্বাচনের আগে তৃণমূলের থেকেই আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, এবারের পঞ্চায়েত ভোট সেবারের মতো হবে না। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে আরও একবার প্রমাণিত হল, বাংলায় কোনও স্থানীয় নির্বাচনই স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু করার সদিচ্ছা নেই তৃণমূল নেতৃত্বের। শাসকদল যদি ভোটে অনিয়ম করতে নাছোড়বান্দা হয় এবং প্রশাসন যদি হয় শাসকদলের তল্পিবাহক, তবে স্বচ্ছ ভোট কার্যত অসম্ভব। পশ্চিমবঙ্গে লোকসভা-বিধানসভা নির্বাচন এমনকি উপনির্বাচন অবাধ ও শান্তিপূর্ণ রাখতে যথেষ্ট ক্ষমতা সম্পন্ন কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনেরই কালঘাম ছুটে যায়। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য নির্বাচন কমিশন তো আইনগতভাবেই ঠুঁটো। তার উপর প্রতিষ্ঠানটির মাথায় যদি একজন মার্কামারা তাবেদারকে পরিকল্পনা মাফিক বসিয়ে দেওয়া হয় তবে নির্বাচনকে জলাঞ্জলি দিতে আর কী লাগে সরকারি পার্টির।
আদালত চেষ্টা করেছিল, জল ঢেলে দিলেন আমলারা
পঞ্চায়েত নির্বাচনকে শান্তিপূর্ণ ও নিয়মের মধ্যে রাখতে আদালত একটা চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আইনকে, আদালতের নির্দেশকে বাস্তবে প্রয়োগ করবে যে সংস্থাগুলি, তারা যদি নির্বাচনকে কলুষিত করতে শাসকদলের সহযোগী হয়ে দাঁড়ায়, তবে আদালতের সেই মুহূর্তে কিছুই করার থাকে না। পঞ্চায়েত ভোটে থাকেও নি। কেন্দ্রীয় বাহিনীর মোতায়েন নিয়ে যে একটা তামাশা হতে চলেছে, তা ভোটের আগের দিনই বোঝা গিয়েছিল। নির্বাচন কমিশনের প্রত্যেকটি বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের না ছিল কোনও সদিচ্ছা না ছিল কোনও পরিকল্পনা। নেহাতই আদালতের নির্দেশ, তাই ঢেঁকি গিলতে বাধ্য হয়েছে কমিশন। বাকি খচরামিটা গুছিয়ে করেছে নিচের তলার আমলাতন্ত্র ও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ আধিকারিকেরা। স্থানীয় প্রশাসন যদি কেন্দ্রীয় বাহিনীকে গাইড করে বুথে বুথে না পৌঁছে দেয় তবে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের পক্ষে শিবিরে বসে সময় কাটানো ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। পঞ্চায়েত ভোটে বাহিনী মোতায়েনে রাজ্যের প্রশাসন কতটা অসহযোগিতা করেছে হাইকোর্টের কাছে সেই বিষয়ে রিপোর্ট জমা দিয়েছে বিএসএফ। ভোটগ্রহণের পরের দিনই বিএসএফ-এর ডিআইজি এসএস গুলেরিয়া অভিযোগ করেছেন, রাজ্য পুলিশের কাছে চেয়েও পাওয়া যায় নি সংবেদনশীল বুথের তালিকা।
আদালতকে রুষ্ট করেও শাসকদলকে কেন তুষ্ট করলেন আধিকারিকেরা?
হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চের স্পষ্ট নির্দেশিকা ছিল, কীভাবে কেন্দ্রীয় বাহিনী ও রাজ্য পুলিশ সমন্বয় করে কাজ করবে এবং বুথে বুথে বাহিনী মোতায়েন করতে হবে। আদালত অবমাননার ঝুঁকি মাথায় নিয়েও বুথে নিরাপত্তার প্রশ্নে রাজ্য প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন কীভাবে খামখেয়ালিপনা করেছে ভাবলে আশ্চর্য লাগে। শাসকদলকে রুষ্ট করার চাইতে হাইকোর্টের নির্দেশকে অগ্রাহ্য করা অধিক নিরাপদ- হয়তো এই অভিজ্ঞতা থেকেই এমন বেপরোয়া আচরণ রাজ্যের আমলা ও পুলিশ আধিকারিকদের। জোর করে বুথে ঢুকে ছাপ্পা কোনও নতুন ঘটনা নয়। এটা করার অভিজ্ঞতা কম বেশি সব দলের আছে। বুথের নিরাপত্তা শক্ত করতে পারলে এই ধরণের ছাপ্পাবাজি অনেকটা আটকানো যায়। কিন্তু নির্বাচনকে কলুষিত করার মেকানিজমের সঙ্গে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন থেকে অধস্তন স্তরের ইচ্ছেয় হোক আর অনিচ্ছায় সংশ্লিষ্ট থাকার ঘটনা অভিনব এবং তেমনটি ঘটে থাকলে তা প্রতিহত করা বিরোধীদের পক্ষে কার্যত দুঃসাধ্য।
স্থানীয় নির্বাচনগুলিতে আমলারা তৃণমূলের ‘ব্যাক অফিস’ সামলান
নির্বাচনের মনোনয়ন পর্বেই প্রতিদ্বন্দ্বীদের রিংয়ের বাইরে ছিটকে ফেলার কৌশলটা তৃণমূল প্রথম প্রয়োগ করে আঠারোর পঞ্চায়েত ভোটে। এই কদর্য খেলায় শাসকদলের স্থানীয় নেতাদের ‘কোলাবরেটর’ হয়ে ওঠেন পুলিশ ও আমলাতন্ত্রের নিম্ন ও মাঝারি স্তরের আধিকারিকেরা। এবং পেছন থেকে ভালমানুষ সেজে এঁদের মদত দেওয়ার কাজটি করে থাকেন আরও উপরের স্তরের আধিকারিকেরা। বিরোধীদের মনোনয়ন জমায় শাসকদলের লোকজন বাধা দিলে সেটা আইন বিরুদ্ধ হলেও আমাদের সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে তাজ্জব হওয়ার মতো কিছু নয়। কিন্তু পুলিশের একজন ডিএসপি কত বড় নির্লজ্জ হলে শাসকদলের নেতার অঙ্গুলি হেলনে তাঁর অপছন্দের নির্দল প্রার্থীকে বারে বারে জাপটে ধরে আটকে দেন, যাতে তিনি মনোনয়ন জমা দেওয়ার জায়গায় সময়ে পৌঁছাতে না পারেন! পশ্চিমবঙ্গে হাইকোর্টের নির্দেশের পরেও পুলিশের বাধায় ও নির্বাচন আধিকারিকের ষড়যন্ত্রে বিরোধী বা নির্দল প্রার্থীর মনোনয়ন জমা দিতে না পারার ঘটনা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। কার আস্কারায় নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা বিডিও, এসডিও, ডিএম, ডিএসপি, এসপিরা আদালতের নির্দেশ অগ্রাহ্য করার স্পর্ধা পান? নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নষ্টের ষড়যন্ত্র সংবিধানকেই অবমাননার সামিল। কেন অভিযুক্ত আধিকারিকদের বিচারের আওতায় আনা হবে না?
নাগরিকদের ভোটের অধিকার বিপন্ন তাই সংবিধানও বিপন্ন
বাম জামানাতেও ভোটে কারচুপি হত কিন্তু তা বুথেই সীমাবদ্ধ ছিল। এই আমলে কারচুপি বুথ ছাড়িয়ে গণনাকেন্দ্রেও সংক্রমিত হয়েছে এবং গণনাকেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা নির্বাচন আধিকারিকেরা ঘটনার সঙ্গে জড়িত। পঞ্চায়েত ভোটের গণনায় বহু জায়গায় ফলাফল পাল্টে দেওয়া হয়েছে বলে বিরোধী প্রার্থীদের অভিযোগ। এইসব অভিযোগ যে অসার নয়, তার একাধিক প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। ছোটখাটো বিচ্যুতি থাকেই, তা গণতন্ত্রকে কাবু করতে পারে না। কিন্তু যে সব প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতার উপর গণতন্ত্রের স্বচ্ছতা নির্ভর করছে, সেখানে যদি ঘুণ ধরে, তবে বিপর্যয় অনিবার্য। শুধু নির্বাচন কমিশনই নয় সমগ্র আমলাতন্ত্র ভোট প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আমলাতন্ত্র যদি গণহারে নিরপেক্ষতা হারায় তবে নির্বাচনের স্বচ্ছতা রসাতলে যেতে বাধ্য। রেফারি দুই নম্বরি হলে ম্যাচের বারোটা বাজা ঠেকায় কে! রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোট ঘিরে রাজনৈতিক সহিংসতা ও অর্ধশতাধিক মানুষের মৃত্যু নিঃসন্দেহে উদ্বেগের কিন্তু তার চেয়েও বড় উদ্বেগের কারণ- নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠানগত বিচ্যুতি চরমে ওঠায় পশ্চিমবঙ্গে কার্যত সাংবিধানিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আদালতের হস্তক্ষেপ ব্যতীত ব্যবস্থার শুদ্ধিকরণ সম্ভব নয়। মানুষ অনেক আশা নিয়ে ১৮ জুলাইয়ের দিকে তাকিয়ে।
Feature image is reresentational.
- লেখক পরিচিতি- যুব কংগ্রেস নেতা। প্রতিবাদী মুখ ও সামাজিক আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক।