বিশেষ প্রতিবেদন : বজ্রপাত এবং বজ্রপাতে হতাহতের ঘটনা বাড়ছে ভারতে । গত দশ বছরে বজ্রপাত জনিত মৃত্যুর পরিসংখ্যান যাচাই করে দেখা গেছে আমাদের দেশে বছরে গড়ে ২৩৬০ জন করে মানুষের মৃত্যু হয় বজ্রাঘাতে । গত পাঁচ বছরের মধ্যে বাজ পড়ে সবথেকে বেশি মৃত্যু হয়েছে ২০১৬য় । সংখ্যাটা ছিল তিন হাজার । একদিনে বজ্রাঘাতে সর্বাধিক মৃত্যু বিহারে । ২০২০ এর ২৫ জুন বিহার জুড়ে বাজ পড়ে মারা গিয়েছিল ৯৮ জন মানুষ । বিশে বিহারে বাজ পড়ে মোট মারা গিয়েছে ৪৫৯ জন । দিন কয়েক আগে ( ৭ জুন , ২০২১ ) পশ্চিমবঙ্গে একদিনে বাজের ছোবলে মৃত্যু হয়েছে ২৭ জনের । দেশের মধ্যে বজ্রপাত জনিত মৃত্যুর ঘটনা সবথেকে বেশি ঘটে বিহার ও ঝাড়খণ্ডে । পশ্চিমবঙ্গ , অসম , ওড়িশা সহ পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারত জুড়ে এবং প্রতিবেশী বাংলাদেশে প্রাক বর্ষা এবং বর্ষা মরশুমে বজ্রপাতে মৃত্যু উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে ।
বজ্রপাত মানে যে বিদ্যুত আকাশ থেকে ধরিত্রীতে নেমে আসে । তবে সব বাজই মাটিতে আঘাত করে না। আকাশে বিদ্যুতের সৃষ্টি হয় মূলতঃ উলম্ব মেঘে । যাকে বলা হয় কিউমুলোনিম্বাস ক্লাউড । এই মেঘের গভীরতা বেশি থাকে । আবহবিদেরা এই মেঘকে বজ্রগর্ভ মেঘও বলে থাকেন । বায়ুমন্ডলের নিচের স্তর থেকে ওপরের স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত উলম্ব মেঘের গভীরতার দৈর্ঘ্য ১২-১৩ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে । বায়ুমন্ডলের ওপরের দিকে মেঘের দুটি স্তরের মধ্যে বজ্রপাত হলে সেই বিদ্যুৎ মাটিতে নেমে আসে না । কিন্তু ভূপৃষ্ঠের কয়েক শো মিটার উচ্চতায় বজ্রগর্ভ মেঘে বজ্রপাত হলে বাজ মাটির দিকে নেমে আসে । এই ধরণের বজ্রপাতেই মানুষ থেকে গবাদিপশু এমনকি বনের জন্তুদেরও মৃত্যু হয় । গত ১৩ জুন অসমের নওগাঁওয়ের জঙ্গলে বাজ পড়ে এক সাথে ১৮টি হাতির মৃ্ত্যুর ঘটনা ঘটেছে । বাজ পড়ে অনেক উঁচু গাছেরও ক্ষতি হয় ।
পূর্ব ভারতে এপ্রিলের শেষ থেকে জুলাই পর্যন্ত আকাশে ঘন ঘন বজ্রগর্ভ মেঘের সঞ্চার হয় । মে-জুন মাসের প্রাক বর্ষা মরশুম থেকে জুলাই পর্যন্ত বজ্রপাত জনিত দুর্ঘটনার খবর বেশি পাওয়া যায় । বায়ুদূষণের ফলে বজ্রপাতের ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে বলে অনেকে মনে করেন । যদিও এই মত নিয়ে বিতর্ক আছে । যারা মনে করেন দূষণের জেরে বজ্রপাত বাড়ছে তাঁরা বলেন, লাগামছাড়া দূষণের জেরে বায়ুতে গরম ধূলিকণা বেড়েই চলেছে , যা ঘন ঘন বজ্রপাতের উপযুক্ত পরিসর তৈরি করছে । এদিকে বাতাসের উপরের পরিমণ্ডলে প্রাক বর্ষা ও বর্ষার যখনই গরম বাতাস উপর দিকে উঠছে , তখনই বায়ুমন্ডলের ঊর্ধ্বস্তরে জলীয়কণার সঙ্গে ঘর্ষণের ফলে বিদ্যুৎ তৈরি হচ্ছে এবং বজ্রপাত ঘটছে ।
বছরে মেঘ থেকে যত বাজ মাটিতে পড়ে তার মাত্র দশ শতাংশ মানুষ ও গবাদিপশুকে আঘাত করে । বজ্রপাতের হাত থেকে বাঁচতে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ভবন ও পরিকাঠামোর ছাদে বজ্রনিরোধক যন্ত্র বসানো হয় । বজ্রপাত জনিত মৃত্যুর নব্বুই শতাংশই গ্রামাঞ্চলে ঘটে থাকে । তালগাছকে বলা হয় প্রাকৃতিক বজ্র নিরোধক । অনেক উঁচু হওয়ার কারণে তালগাছ বাজ টেনে নেয় । গ্রামাঞ্চলে তালগাছ রোপণ বজ্রপাত জনিত ক্ষয়ক্ষতি রোধের একটা উপায় হতে পারে । তবে বজ্রপাত প্রবণ অঞ্চলে বজ্রপাত নিরোধক যন্ত্র স্থাপন বাজে মানুষ ও গবাদিপশুর মৃত্যু ঠেকানোর সবথেকে কার্যকরী রাস্তা বলে মনে করেন অনেকে । বজ্র নিরোধক যন্ত্রকে টাওয়ারের মতো করে গ্রামে গ্রামে বসানো যেতে পারে । বজ্র নিরোধক যন্ত্রের তিনটি অংশ । একটির সঙ্গে আরেকটি যুক্ত থাকে। একটি হল লম্বা ধাতব দণ্ড, যা বজ্রবিদ্যুৎ আকর্ষণ করে। আরেকটি অংশ পরিবাহী তার, যা বায়ুমণ্ডলীয় রডে ধারণকৃত বজ্রবিদ্যুৎ পরিবহন করে থাকে । শেষ অংশটি ভূগর্ভস্থ ধাতব রড, যা তার দিয়ে পরিবাহিত বজ্রবিদ্যুতকে মাটির মধ্যে সঞ্চালিত করে বাজকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়।
সবথেকে আকস্মিক মৃত্যু গুলির মধ্যে বজ্রপাতে মৃত্যু একটি । আকাশে বজ্রগর্ভ মেঘের সঞ্চার হলে একাধিক সতর্কতা মূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করতে মানুষকে পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা । প্রাক বর্ষা ও বর্ষা কালে আকাশে কালো মেঘ জমতে দেখলেই খোলা জায়গা ছেড়ে দ্রুত কোনও শক্তপোক্ত কাঠামোর নিচে আশ্রয় নেওয়া উচিত । ক্ষেতে থাকতে থাকতেই বজ্র বিদ্যুৎ সহ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলে গাছের নিচে আশ্রয় না নিয়ে দুই পায়ের আঙ্গুলে ভর দিয়ে কানে আঙ্গুল দিয়ে উপুড় হয়ে বস পড়াই ভাল । জরুরী প্রয়োজনে ঘরের বাইরে বেরোলে রাবারের স্যান্ডেল পরা দরকার । বাজ পড়তে শুরু করলে পুকুর বা নদীর জলে নামা থেকে বিরত থাকতে হবে । বজ্রপাত শুরু হলে বিদ্যুতের তার এবং খুঁটি , মোবাইল টাওয়ার ও উঁচু গাছ থেকে দূরে থাকতে হবে । ঘন ঘন বজ্রপাত হচ্ছে , এই রকম পরিস্থিতির মধ্যে একাধিক মানুষ খোলা আকাশের নিচে পড়ে গেলে একসাথে না থেকে প্রত্যেককে ৫০ থেকে ১০০ ফুট করে দূরে সরে যেতে হবে । বজ্রপাত কালে ঘরে থাকলেও যে কোনও ধরণের ধাতব বস্তু থেকে নিজের শরীরকে দূরে রাখাই বাঞ্ছনীয় । বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকাও নিরাপদ নয় । প্রকৃতির আঘাতকে আমরা রোধ করতে পারব না কিন্তু কিছু সতর্কতা অবলম্বন করলে আঘাত থেকে অনেকটাই নিজেদের রক্ষা করতে পারে মানুষ ।
Photo Credits – sluthstock.com , Pinterest , AFP