কলকাতা হাইকোর্ট নির্বাচন কমিশনকে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনে বাধ্য করল বটে কিন্তু আদালতের মহামান্য বিচারপতিরাও কি আরও একটু ‘প্র্যাক্টিকাল’ হতে পারতেন না? লিখলেন উত্তম দেব-
হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি থেকে রাজ্যপাল- যতই চেষ্টা করুন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে অনিশ্চয়তা দূর হওয়ার বদলে শেষ মুহূর্তে আরও জেঁকে বসেছে। শনিবার ৬১ হাজার ১০৮টি বুথে ভোটগ্রহণ। অথচ বৃহস্পতিবার গভীর রাতেও হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে সব বুথে দু’জন করে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান মোতায়েন করার পরিস্থিতি নেই। কেন্দ্রীয় বাহিনীর নিয়ম অনুযায়ী প্রতি বুথে ‘হাফ সেকশন’ অর্থাৎ চারজন করে সদস্য মোতায়েন রাখতে হবে। পঞ্চায়েত ভোটে ৮২২ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করার কথা। ৮২২ কোম্পানি মানে ৮২ হাজার জওয়ান। যদিও এর মধ্যে ৬৫ হাজারের বেশি বুথে নিরাপত্তার কাজে মোতায়েন করার সুযোগ নেই। এই পরিস্থিতিতে ৬১ হাজার ১০৮টি বুথের প্রতিটিতে কেন্দ্রীয় বাহিনী ও রাজ্য পুলিশ আধাআধি করে মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। কিন্তু তাতেও জটিলতা কাটছে না।
পঞ্চায়েত ভোটে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোটেই ভাল ঠেকছে না বিএসএফ সহ বিভিন্ন কেন্দ্রীয় বাহিনীর ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের। ভোটের দিন বাংলায় ব্যাপক গন্ডগোল হতে পারে বলে তাদের আশঙ্কা। এই পরিস্থিতিতে রাজ্য পুলিশের ভরসায় বুথে বুথে মাত্র একজন-দু’জন করে জওয়ান মোতায়েনের ঝুঁকি নিতে চাইছেন না কেন্দ্রীয় বাহিনীর আধিকারিকেরা। ভোটের দিন বাহিনীর সদস্যদের প্রাণহানির আশঙ্কা করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে বিএসএফ-এর তরফ থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে। প্রশ্ন- তাহলে শেষ পর্যন্ত কী হবে? শনিবার ভোট। হাতে আর একদিন মাত্র সময়। কেন্দ্রীয় বাহিনীর কর্তৃপক্ষ প্রতি বুথে একজন-দু’জন করে সদস্য মোতায়েনে রাজি না হলে ভোটের দিন বুথে বুথে কীভাবে নিরাপত্তা সাজাবে রাজ্য নির্বাচন কমিশন?
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নির্দেশে যদি শেষ পর্যন্ত প্রতি বুথে একজন-দু’জন করে সদস্য মোতায়েনে কেন্দ্রীয় বাহিনীর আধিকারিকেরা রাজি হয়েও যান, তারপরেও কিন্তু সমস্যা মিটছে না। কারণ, নির্বাচন কমিশন চেয়েছে ৮২২ কোম্পানি বাহিনী। প্রথম দফায় ২২, দ্বিতীয় দফায় ৩১৫ কোম্পানি রাজ্যে এসে পৌঁছালেও তৃতীয় দফার ৪৮৫ কোম্পানি বৃহস্পতিবার গভীর রাতেও এসে পৌঁছায় নি। গত ৪ জুলাই ৪৮৫ কোম্পানি বাহিনী বাংলায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্র। এক লপ্তে কোনও একটি রাজ্যে ৮২২ কোম্পানি বাহিনী মোতায়েন দুরূহ ব্যাপার। হাইকোর্টের নির্দেশের প্রেক্ষিতে শেষ পর্যন্ত কমিশনের চাহিদা মতো পুরো ৮২২ কোম্পানি বাহিনী পাঠাতেই রাজি হয় কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু এত স্বল্প সময়ের মধ্যে দূরের বিভিন্ন রাজ্য থেকে বাহিনী জোগাড় করে শুক্রবারের মধ্যে বাংলায় পাঠানো কার্যত অসম্ভব। এমনকি শুক্রবার দুপুরের মধ্যে ৮২২ কোম্পানি বাহিনীর সব সদস্য রাজ্যে পা রাখলেও শনিবার সকালের মধ্যে বিভিন্ন জেলার বুথে বুথে তাদের পাঠানো অসাধ্য।
পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছে তাতে বলার অপেক্ষা রাখে না, পঞ্চায়েত ভোটের নিরাপত্তা নিয়ে একটা বড় রকমের জট পাকাতে যাচ্ছে। অসংখ্য বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠানোই সম্ভব নয়। আবার বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী না থাকলে আদালতের নির্দেশ লংঘিত হবে। সুষ্ঠু ও অবাধ ভোট নিয়ে বিরোধী দল থেকে সাধারণ জনগণ- সবার মধ্যে আশঙ্কা। শঙ্কিত ভোটের ডিউটি নিতে চলা সরকারি কর্মচারীরাও। যে আশঙ্কা দূর করতে বারে বারে আদালতের দরজায় কড়া নাড়া, আদালতের নির্দেশের পরেও সেই নিরাপত্তাই যদি নিশ্চিত না হয়, তবে মানুষ কার ভরসায় শনিবার ভোট দিতে ঘর থেকে বেরোবেন?
পঞ্চায়েত ভোট কয়েক দফায় ভাগ করে দিলে নিরাপত্তা নিয়ে এত অনিশ্চিয়তার কারণ থাকত না বলে নাগরিক সমাজের ধারণা। কিন্তু রাজ্য সরকার ও নির্বাচন কমিশন প্রথম থেকেই নিরাপত্তার বিষয়টিকে লঘু করে দেখেছে। কোন উদ্দেশ্য পূরণে নবান্ন পঞ্চায়েত ভোটের নিরাপত্তা নিয়ে উদাসীন আর কোন উদ্দেশ্যেই বা নবান্নের নির্দেশ মতো ভোটের সূচি তৈরি করল নির্বাচন কমিশন?
কলকাতা হাইকোর্ট নির্বাচন কমিশনকে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনে বাধ্য করল বটে কিন্তু আদালতের মহামান্য বিচারপতিরাও কি আরও একটু ‘প্র্যাক্টিকাল’ হতে পারতেন না? বিরোধীরা তো পঞ্চায়েত ভোট কয়েক দফায় ভাগ করে দেওয়ার আর্জি নিয়ে তাঁদের দরজায় গিয়েছিলেন। কোনটা সম্ভব আর কোনটা সম্ভব নয় বিবেচনা করে আদালত যদি ভোটটা কয়েক দফায় ভাগ করে দিত, তবে নিরাপত্তা নিয়ে এই জটিলতা তৈরিই হত না। মানুষের প্রাণের মূল্য কেউই হৃদয় দিয়ে বুঝলেন না!
Feature image is representational.