পঞ্চায়েত ভোট শাসকদলের জন্য হয়ে দাঁড়িয়েছে উভয় সঙ্কট! লিখলেন নির্বাণ রায়-
উনিশের লোকসভা নির্বাচনের পর বিশে কলকাতা কর্পোরেশন সহ শতাধিক পুরসভার ভোট মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য ছিল বড় রাজনৈতিক পরীক্ষা। ঠিক যখন পুরভোটের দামামা বাজবে বাজবে, তখনই দেশে করোনার হানা। লকডাউন ঘোষিত হওয়ায় সবাই ঘরে ঢুকে যায়। নির্বাচন করার মতো পরিস্থিতি থাকে না। পুরভোট স্থগিত করে দিতে বাধ্য হয় রাজ্য নির্বাচন কমিশন। কলকাতা সহ রাজ্যের একশোরও বেশি পুরসভার বকেয়া ভোট যখন নেওয়া হয়েছিল, তখন বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি পুরোপুরি মমতার মুঠোয়। একুশের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির কাছ থেকে যে ফাঁড়া ছিল, তা কেটে যাওয়ার পর মমতা তখন ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় ফিরে আসা তৃণমূলের কাছে পুরভোটে জেতাটা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার চেয়ে বেশি কিছু ছিল না। এবং পুরভোটে কার্যত উড়েই গিয়েছিল বিরোধীরা।
বিশে পুরভোট না হওয়ায় লাভ হয়েছিল মমতার
যথা সময়ে অর্থাৎ ২০২০-এর এপ্রিল-মে মাসে পুরভোট হলে কিন্তু তৃণমূলের জন্য লড়াইটা তরলবৎ সরল থাকত না। উনিশের লোকসভা নির্বাচনে আশাতিরিক্ত সাফল্যের পরে বিজেপি যে উদ্যম নিয়ে একুশের বিধানসভার দিকে তাকিয়ে বিশে পুরভোট করতে নামত; একুশের বিধানসভা নির্বাচনে বিধ্বস্ত হওয়ার পরে বিজেপির সামনে পুরভোটে সেই উদ্যম ধরে রাখার সুযোগ ছিল না। কাজেই করোনার সৌজন্যে ২০২০-এ পুরভোট স্থগিত হয়ে যাওয়াটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য আশীর্বাদ হয়েই দেখা দিয়েছিল। রাজনৈতিক অশান্তি এড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গে পুরসভা-পঞ্চায়েত নির্বাচন কার্যত অসম্ভব। সরকার-শাসকদল ও নির্বাচন কমিশনের সেই সদিচ্ছা আছে বলেও মনে হয় না। ২০২১-এর ডিসেম্বরে কলকাতার পুরভোট এবং ২২-এর ফেব্রুয়ারিতে শিলিগুড়ি ও আসানসোল কর্পোরেশন সহ শতাধিক পুরসভার নির্বাচনে তৃণমূলের বিশাল জয় নিয়ে কারও কোনও সংশয় ছিল না। কিন্তু তারপরেও পেশীশক্তির আস্ফালন থেকে শাসকদল বিরত থাকে নি। বহু জায়গায় মানুষ ভোট দিতে পারে নি। বিরোধীরা তো বটেই এমনকি তৃণমূলের বিক্ষুব্ধরা পর্যন্ত নিগ্রহের হাত থেকে রেহাই পান নি।
আঠারোয় ছাপ্পা-সন্ত্রাসের মূল্য উনিশে চোকায় তৃণমূল
রাজনৈতিক পরিস্থিতি শাসকের প্রতিকূল ও প্রতিপক্ষের দিক থেকে শাসকদলের প্রতি শক্ত চ্যালেঞ্জ থাকলে ভোটে গোলমালের আশঙ্কা বেশি থাকে। ২০-এর গরমে রাজ্য জুড়ে পুরভোট হলে তৃণমূলকে বিজেপির শক্ত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি পড়তে হত। এমন পরিস্থিতিতে অবাধ ও সুষ্ঠু ভোটে পরাজয় অথবা ছাপ্পা ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে বিজয়- উভয়েরই একটা রাজনৈতিক ঝুঁকি থাকে। বিশেষ করে লোকসভা বা বিধানসভা নির্বাচনের আগের বছর স্থানীয় নির্বাচন থাকলে ঝুঁকিটা একটু বেশিই। সে’বার করোনার কারণে পুরভোট না হওয়ায় দু’দিক দিয়েই ঝুঁকিমুক্ত থাকতে পেরেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আঠারোর পঞ্চায়েত ভোটে শাসকদল হিংসা ও সন্ত্রাসকে এমন মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিল যে তেইশে আঠারোর রিপিট টেলিকাস্ট আটকাতে পারলে তৃণমূল নেতৃত্ব হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। সে’বার বিরোধীরা মনোনয়ন জমা দিতে না পারায় ৩৪ শতাংশ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছিল তৃণমূল। যে ৬৬ শতাংশ আসনে ভোট হয়েছিল, তার একটা বড় অংশে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করার সুযোগই পান নি গ্রামের মানুষ। ভোটের দিন মৃত্যু হয়েছিল ২৩ জনের।
২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনের বছর তৃণমূলের জন্য এমন কোনও প্রতিকূল পরিস্থিতি ছিল না যে অবাধ ভোট হলেই দলকে বড় পরাজয়ের মুখ দেখতে হবে। কিন্তু ছোট পরাজয় আটকাতে গিয়ে দলের লুম্পেনদের ‘ফ্রি হ্যান্ড’ করে দিয়েছিলেন তৃণমূল সুপ্রিমো। নির্বাচন কমিশন অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র। প্রশাসন দলদাস। পুলিশ শাসকদলের ছত্রধারক। পরিণাম- জনগণের ভোটাধিকার লুঠ। আঠারোর পঞ্চায়েত ভোটের পর সাধারণ মানুষের মনে এমন ধারণা ঢুকে গেছে, তৃণমূলের আমলে রাজ্য পুলিশ বুথের নিরাপত্তায় থাকলে নিজের ভোট নিজে দিয়ে মানে মানে ঘরে ফেরা সম্ভব নয়। আঠারোর দগদগে স্মৃতি উনিশে টাটকাই ছিল, মানুষ ইভিএমে প্রত্যাঘাত করতে ভোলে নি। উনিশের লোকসভা নির্বাচনে দলের খারাপ ফলের একটা বড় কারণ যে আঠারোর পঞ্চায়েত ভোটে বেলাগাম সন্ত্রাস, তৃণমূল নেতারাও তা মেনে নিয়েছেন।
তেইশে আবার পঞ্চায়েত ভোট এবং তৃণমূলের উভয় সংকট
উত্থানের পর পতন প্রকৃতির স্বাভাবিক ধর্ম। রাজনীতি ব্যতিক্রম নয়। একুশে তৃণমূলের বিশাল জয়ের জোশ বাইশের মধ্যভাগ থেকেই ফিকে হতে শুরু করে। একুশে জুলাইয়ে ধর্মতলার বাৎসরিক সভার পরের দিন পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর বান্ধবী অর্পিতার ঘরে ইডি হানা দেয়। মমতার ক্যাবিনেটের দুই নম্বর মন্ত্রীর বান্ধবীর ঘরে টাকার পাহাড় দেখে জনগণের চোখ কপালে ওঠে। এরপরে এগার মাসে রাজ্যে কী কী ঘটেছে সবার জানা। সব মিলিয়ে আঠারোর থেকে অনেক খারাপ তেইশের পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রাক্কালে তৃণমূলের হাল। কোনও সন্দেহ নেই যে, পঞ্চায়েত নির্বাচন বিলম্বের একটা বড় কারণ মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্তহীনতা। ঠিক কোন সময়ে পঞ্চায়েত ভোট ডাকলে অ্যাডভান্টেজ পাওয়া যাবে, ভাবতে ভাবতেই রাজ্যের আকাশে বর্ষা ঢুকে গেছে। পঞ্চায়েত নির্বাচন উভয় সংকটে ফেলে দিয়েছে তৃণমূলকে। সন্ত্রাস-ছাপ্পা করে ৮০-৮৫ শতাংশ আসনে জেতাই যায় কিন্তু তাতে অদূর ভবিষ্যতে ঝুঁকি আছে। মানুষ বদলা নেবে। যেমন নিয়েছিল উনিশে। আবার নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হতে দিলে বড় সংখ্যায় আসন হারানোর আশঙ্কা।
মনোনয়ন পর্বে পরিস্থিতি আঠারোর তুলনায় ভাল
পঞ্চায়েত মধুর হাড়ি। শীর্ষ নেতৃত্ব কিছু আসনে হারতে চাইলেও প্রার্থীরা তো সবাই জিততেই চান। দলের টিকিট নিয়ে তৃণমূল ভার্সেস তৃণমূল সংঘর্ষ এড়ানোই এখন জোড়াফুল শিবিরের কান্ডারীর বড় দায়। মনোনয়ন বঞ্চিত বিক্ষুব্ধদের নির্দল প্রার্থী হওয়া কিম্বা অন্য দলে যাওয়া ঠেকাতে নানা কৌশল নিতে হচ্ছে তৃণমূল নেতৃত্বকে। মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ দিন ১৫ জুলাই। শেষদিনে বড় সংখ্যায় দলীয় প্রার্থীদের মনোনয়ন জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তৃণমূল নেতৃত্ব, যাতে বঞ্চিতরা নির্দল বা অন্য দলের হয়ে দাঁড়ানোর সময় না পান। তারপরেও শাসকদলে ভাঙন অব্যাহত। টিকিট পাবেন না, আঁচ করেই অনেক এলাকায় তৃণমূলের স্থানীয় নেতারা ঝান্ডা বদল করছেন। মনোনয়ন পর্বে বিভিন্ন জায়গায় বিরোধীদের বাধা দেওয়ার ঘটনা বন্ধ নেই। তবে আঠারোর তুলনায় অপ্রীতিকর ঘটনার সংখ্যা অনেক কম। মনোনয়ন জমা দেওয়ার পঞ্চম দিন পর্যন্ত ত্রিস্তর মিলিয়ে তৃণমূলের জমা পড়েছে ৪৯ হাজার ৪৯১টি, বিজেপির ৪৬ হাজার ৩০৮টি, সিপিএমের ৩৮ হাজার ৩৯টি এবং কংগ্রেসের ১১ হাজার ৮২৩টি। শেষ পর্যন্ত কতগুলি আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শাসকদল বের করে নেবে তা মনোনয়ন পর্ব শেষ না হওয়া পর্যন্ত জানা সম্ভব নয়। তবে মনোনয়ন জমা দেওয়ার সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলে দিচ্ছে, অন্তত মনোনয়ন পর্বে পরিস্থিতি আঠারোর মতো জঘন্য নয়।
Feature Image is Representational.