সাতচল্লিশে আমাদের নেতাদের কেউ অনুশোচনায় গলায় দড়ি দিলেন না কেন!

সাতচল্লিশে আমাদের নেতাদের কেউ অনুশোচনায় গলায় দড়ি দিলেন না কেন!


TRAIN TO INDIA: Written by Maloy Krishna Dhar.

বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশক নিঃসন্দেহে বিশ্ব জুড়েই ভয়াবহ এক মানবিক বিপর্যয়ের দশক। অ্যান্টনি বিভোরের ‘দ্য ফল অব বার্লিন- নাইন্টিন ফর্টিফাইভ’ কিছুদিন আগে পড়লাম। পিঁপড়ের বাসায় আগুন ধরিয়ে কিংবা কেরোসিন ছিটিয়ে দিলে পিঁপড়েরা যেভাবে পিল পিল করে মারা যায়, সেইভাবে মানুষের মৃত্যুর মর্মন্তুদ কাহিনী। পরাভূত, বিধ্বস্ত, ধ্বংসপ্রাপ্ত জার্মানিতে কফি কাপে চুমুক দেওয়া চেয়েও সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল জার্মান নারীদের বলাৎকার। ছেচল্লিশ-সাতচল্লিশে আমাদের ভাগ্যে যা যা ঘটেছিল, তা জার্মানদের থেকে কোন‌ও অংশে কম কীসের।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত জাপান কার্যত মাটিতে মিশে গিয়েছিল। আমেরিকার কাছে আত্মসমর্পণের পর জাপানি জেনারেলরা, নেতারা লজ্জায়, অপমানে, গ্লানিতে আত্মহত্যা করেছিলেন। তাদের জন্য দেশবাসীর এত কষ্ট, এত লাঞ্ছনা, এই অনুতাপে তাঁরা ‘হারিকিরি’ করে মরেছিলেন। আমি ভাবি, সাতচল্লিশে আমাদের মহান নেতাদের একজন‌ও দেশের মানুষের দুঃখকষ্ট দেখে অনুশোচনায় গলায় দড়ি দিলেন না কেন? দাঙ্গা, গণহত্যা, নারীর সম্মান নাশ, লুটপাট দেশভাগ, দলে দলে মানুষের দেশত্যাগ, অসহায় উদ্বাস্তুদের স্রোত- কোন‌ও কিছুই আমাদের মহান নেতাদের ততটা মর্মাহত করতে পারে নি, যতটা করলে প্রাণত্যাগের সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়।

দেশভাগ বাঙালিহিন্দুর ধন-প্রাণ-মান, সব শেষ করেছে।

দেশভাগ ছিল আমাদের জীবনে মহাজাগতিক ‘বিগ ব্যাং’-এর মতো।‌ একটা জোরালো বিস্ফোরণের পর যেভাবে স্প্লিন্টারগুলি প্রচন্ড গতিতে দশ দিকে ছিটকে যায়, আমরা ঠিক সেই ভাবে ছিটকে পড়েছিলাম। আমাদের বাপ-কাকারা, তাঁদের বাপ-কাকারা তো কেউ এই বিপর্যয়ের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। প্রস্তুত থাকার কথাও নয়। টেবিলের উপর ম্যাপ বিছিয়ে রাতারাতি দেশভাগ! মানবসভ্যতার ইতিহাসে এত বড় ‘ক্রাইম’ আর ঘটেছে? সমাজের ম্যাক্রো লেভেল থেকে মাইক্রো লেভেল- দেশভাগের যে কত বহুমাত্রিক অভিঘাত, এই ব‌ইটা পড়লে তার খানিকটা ৭৮ বছর পরেও উপলব্ধি করা যায়। আমরা যারা উদ্বাস্তু, সেই গনগনে আঁচে পুড়েছি, আমাদের সকলের কাহিনীই কমবেশি একই রকম।

Feature graphic is representational and designed by NNDC.


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *