শ্যামপুর বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সদস্যরা আবেগের আতিশয্যে একটা ছোট্ট ভুল নিঃসন্দেহে করেছিলেন। সেই আবেগটা সম্প্রীতির আবেগ। পুজো উপলক্ষে আয়োজিত বসে আঁকো প্রতিযোগিতার ‘থিম’ ছিল মনীষীদের ছবি ও বাণী দিয়ে সম্প্রীতির বার্তা দেওয়া। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী কোনও বাচ্চা এমন একজন ধর্মপ্রচারকের ছবি এঁকে ফেলেছে, সেই ধর্মের অনুসারীরা মনে করে তাদের পয়গম্বরের ছবি আঁকা বা ছাপা তাদের ভাষায় একেবারেই ‘জায়েজ’ নয়।
অতীতে এ নিয়ে অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। এমনকি ‘কল্লা’ অব্দি পড়ে গেছে। শ্যামপুর বাজারের পুজো উদ্যোক্তারা কীভাবে সেই কথা বিস্মৃত হলেন, তা ভেবে আমরা আশ্চর্য হচ্ছি। সেই ধর্মাবলম্বীদের কাছ থেকে প্রতিবাদ আসা মাত্রই ভুল স্বীকার করে পয়গম্বরের ছবি সরিয়ে ফেলেছিলেন পুজো কমিটির সদস্যরা। বিষয়টা এখানেই মিটমাট হয়ে যেতে পারত। হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু হয় নি। পরিবর্তে কী ঘটেছে, মূলধারার অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম চেপে যাওয়ার পরেও আমরা সকলে তা জেনে ফেলেছি।
যে ভুলের সংশোধন হয়ে গেছে, সেই ভুলকে হাতিয়ার করে সেই সম্প্রদায়ের শত শত লোক রে রে করতে করতে শ্যামপুর ব্যবসায়ী সমিতির পুজোমন্ডপে ঢুকে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করেই সন্তুষ্ট হল না, বাঙালিহিন্দুর পরমারাধ্যা দেবীদুর্গার পবিত্র প্রতিমা ভেঙেচুরে মাটিতে মিশিয়ে দিল! কালাপাহাড়দের তান্ডব শুধু শ্যামপুর বাজারেই সীমাবদ্ধ থাকল না। শ্যামপুর এলাকায় যেখানেই দুর্গাপুজো হয়েছে, সেখানেই হামলা চালিয়ে মন্ডপ ভাঙচুর ও দেবীপ্রতিমা নষ্ট করল তারা। এই ধরণের ঘটনা দুই বছর আগে মহাষ্টমীর দিন বাংলাদেশের কুমিল্লা শহরে ঘটেছিল। এখন পশ্চিমবঙ্গে বসেও আমাদের এই দৃশ্য চাক্ষুষ করতে হবে!
দুর্গাপুজো বাঙালিহিন্দুর এবং পশ্চিমবঙ্গের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব। ইউনেস্কো একে স্বীকৃতি দিয়েছে। শারোদোৎসব ঘিরে বাঙালির আবেগই আলাদা। বাঙালি শক্তির উপাসক। মাদুর্গাকে আমরা বলি জগতের আদি শক্তি- আদ্যাশক্তি মহামায়া। যাকে আমরা জগজ্জননী বলে পুজো করি, আজকে তার প্রতিমা ভেঙে গুঁড়িয়ে অপবিত্র করতে তাদের হাত কাঁপল না, বুক কাঁপল না; যাদের আমরা ভাই ও সুপ্রতিবেশী বলে এতদিন মনে করে এসেছি। পশ্চিমবঙ্গেও চাইলেই তারা দুর্গা-কালীর বিগ্রহ ভাঙতে পারে, এত স্পর্ধা তাদের হয় কীভাবে?
একটু রাগ উঠল, আর মন্ডপে-মন্দিরে ঢুকে প্রতিমা ভেঙে দিয়ে এলাম! বাঙালিহিন্দু স্বভাবে বিশ্ব মানবতাবাদী, উদারতার পরাকাষ্ঠা ও অতি সহিষ্ণু। তাই বলে বাঙালিহিন্দুর রাজ্যে বাঙালিহিন্দু যাকে জগজ্জননী বলে হৃদয়ে ধারণ করে, তার মূর্তি ভেঙে ফেলে দেবে? এত জাঁক করে শক্তি সাধনার ফল যদি হয় ক্লীবত্ব, তবে সাধনা তো পুরাই বৃথা। প্রতিমা ও পুজোমন্ডপ ভাঙচুরের সঙ্গে জড়িত সকলকে অবিলম্বে গ্রেফতার করতে হবে। এই দাবি বাঙ্গালিহিন্দুকে তুলতে হবে। পশ্চিমবঙ্গে বসবাসরত যে কোনও ভিন্ন সম্প্রদায় যদি বাঙালিহিন্দুর সুপ্রতিবেশী বলে নিজেদের মনে করে থাকে, তবে তারাও একই দাবি তুলবে বলে আমরা আশা করি।
ভবিষ্যতে কেউ যাতে পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে আমাদের মায়ের প্রতিমা ভাঙচুরের কথা স্বপ্নেও চিন্তা না করে, সেই পরিবেশ সৃষ্টি করার দায়িত্ব মায়ের উপাসক বাঙালিকেই নিতে হবে।