ট্রেন যাত্রাকে বলা হয়ে থাকে সবথেকে নিরাপদ ও আমারদায়ক। ভারতীয় রেলে আরাম বা যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্য নিঃসন্দেহে বেড়েছে। কিন্তু নিরাপত্তা? আমরা কি প্রতি হপ্তায় ঘুম থেকে উঠে একটা রেল দুর্ঘটনার জন্য অপেক্ষা করব? ২০২৩-এর ২ জুন ওড়িশার বালেশ্বরে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রায় ৩০০ যাত্রীর মৃত্যু হয়েছিল। এতবড় দুর্ঘটনার পর ট্রেন চলাচল নিরাপদ রাখতে সরকার, রেল মন্ত্রক সর্বোতভাবে সদা সচেষ্ট থাকবে, এটাই ছিল নাগরিকদের স্বাভাবিক প্রত্যাশা। কিন্তু সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান তা বলছে না।
বৃহস্পতিবার (২৯ জুলাই,২০২৪) ভোর পৌনে চারটা নাগাদ ঝাড়খন্ডের চক্রধরপুরের কাছে মুম্বাইগামী হাওড়া-সিএসএমটি এক্সপ্রেসের ১৮টি কামরা লাইনচ্যুত হলে দুই যাত্রী মারা যান। এই দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ২৩ যাত্রী আহত। এই নিয়ে গত ছয় সপ্তাহে তিনটি যাত্রীবাহী ট্রেন দুর্ঘটনাগ্রস্ত হল। ৪২ দিনে তিনটি দুর্ঘটনায় ১৭ মৃত্যু! রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবের জন্য এই পরিসংখ্যান কি খুব স্বস্তিদায়ক? ২৭ র্যাঙ্ক করা এই প্রাক্তন আইএএস খুবই মেধাবী মানুষ। কানপুর আইআইটির এমটেক। আমেরিকার পেনসিলভানিয়া ইউনিভার্সিটির এমবিএ। অর্থাৎ প্রযুক্তিবিদ্যার পাশাপাশি ব্যবস্থাপনাশাস্ত্রেও তাঁর অগাধ পান্ডিত্য।
কিন্তু রেলমন্ত্রীর মেধা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা যদি রেলের সার্বিক উন্নয়নে কাজে না লাগে, তখন কি তাঁর মেধা-পান্ডিত্য ধুয়ে মানুষ জল খাবে? জুনের ১৭ তারিখ এনজেপির কাছে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের সঙ্গে মালগাড়ির সংঘর্ষ। জুলাইয়ের ১৮ তারিখ উত্তরপ্রদেশের গোন্ডায় চন্ডিগড়-ডিব্রুগড় এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত। সবশেষে জুলাইয়ের ৩০ তারিখ লাইনচ্যুত ঝাড়খন্ডের চক্রধরপুরে হাওড়া-সিএসএমটি এক্সপ্রেস। তিনটি দুর্ঘটনায় সবমিলিয়ে ১৭ জনের মৃত্যু ও একশোর বেশি আহত। তিনটি দুর্ঘটনার কারণ হয় সিগন্যালিং ব্যবস্থার ত্রুটি নয়তো লাইনে গন্ডগোল। কোনও কোনও মহল নাশকতার অভিযোগও তুলছে।
দুর্ঘটনার খবর পাওয়া মাত্রই রেলমন্ত্রী ঘটনাস্থলে ছুটে যান। উদ্ধারকাজেও হাত লাগান। মিডিয়ায় সেই ছবি ওঠে। দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে রেল মন্ত্রক তদন্তের নির্দেশ দেয়। সেই তদন্তের ফল কী জনগণ জানতে পারে না। এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে এক দুর্ঘটনার তদন্ত শেষ না হতেই আরেকটা দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছে! বলতে গেলে রোজই কোনও না কোনও রুটে সেমি হাইস্পিড বন্দেভারত এক্সপ্রেস যুক্ত হচ্ছে। বুলেট ট্রেন নিয়েও নাকি প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহের শেষ নেই। কিন্তু যাত্রী সুরক্ষাকে উপেক্ষা করে কি ভারতের জীবনরেখাকে উজ্জ্বল করা যাবে? ভারতীয় রেলে জনবলের অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ। দশ বছর ধরে কর্মী নিয়োগ কার্যত বন্ধ!
লোকো পাইলট, সহকারী লোকো পাইলট এবং ট্রেন ম্যানেজারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে পর্যন্ত কর্মীর ঘাটতি। রেলের ট্র্যাফিক কন্ট্রোল ও লাইন পর্যবেক্ষণের কাজেও লোকের টানাটানি। অ্যান্টি কলিশন ডিভাইস বা ‘কবচ’ নিয়ে মেলা কচকচানি আমরা শুনেছি। অথচ যখনই দুটি ট্রেনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে, তখনই শোনা যাচ্ছে, ওই ট্রেনে সেই প্রযুক্তি ছিল না। শুধু বাগাড়ম্বর আর প্রচারের চড়া আলো দিয়ে সত্য ঢেকে রাখা যায় না। কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী ভারতীয় রেলের সর্বোচ্চ কর্তা। রেলের ভালোটা যেমন তাঁর গৌরব বৃদ্ধি করে। তেমনি খারাপটার দায়ও তিনি বারে বারে অস্বীকার করতে পারেন না। এই দেশেই একটি দুর্ঘটনার পর সব দায় মাথায় নিয়ে রেলমন্ত্রী পদত্যাগ করেছিলেন।
Feature image is representational and designed by NNDC.