যাঁরা ইসলাম ধর্মের অনুসারী নন, তাঁদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের আমন্ত্রণ জানানো ইসলাম ধর্ম পালনেরই একটা অঙ্গ। ইসলাম ধর্মের ভাষায় এই আমন্ত্রণ জানানোকে বলা হয় দ্বীনের দাওয়াত দেওয়া। ‘দ্বীন’ শব্দের একটি অর্থ আনুগত্য। অর্থাৎ অমুসলিমদের ইসলামের আনুগত্য স্বীকারের আমন্ত্রণ জানানোকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা তাঁদের উপর ন্যস্ত ঈমানী দায়িত্ব বলেই মনে করে থাকেন। দাওয়াত আরবি শব্দ, এর অর্থ ডাকা বা আহ্বান জানানো বা আমন্ত্রণ জানানো। ঈমান শব্দের অর্থ বিশ্বাস করা। ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’, অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত কোনও উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ তাঁর প্রেরিত একমাত্র রসুল- এই কালেমার প্রতি যার বিশ্বাস নেই, ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী তিনিই বেঈমান ও কাফের। এইসব কথার অবতারণা করার কারণ সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ২ মিনিট ২২ সেকেন্ডের একটি ভিডিও। ভিডিওটিতে রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, কলকাতা শহরের মেয়র, তৃণমূল কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের অন্যতম এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অত্যন্ত আস্থাভাজন ফিরহাদ হাকিমকে একটি সভায় ভাষণ দিতে দেখা যাচ্ছে। সভাটি সম্ভবত মুসলমান সম্প্রদায়ের ধর্মবেত্তাদের কোনও সংগঠনের।
সভায় ফিরহাদ হাকিমকে যা বলতে শোনা যাচ্ছে, তা হুবহু নিচে দেওয়া হল-
“ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষেরা, তারা যদি তেলাওয়াতের সাথে সাথে তার মানে, এইটাকে যারা ইসলাম ধর্মাবলম্বী নয়, তাদের মধ্যে ছড়াতে হবে। কারণ, আমরা নিজেদের আল্লাহ তায়ালার রহমত আমাদের আছে। আমরা জন্মগতভাবে ইসলাম নিয়ে জন্মেছি। এবং ইসলাম নিয়ে জন্মানোর মানে আমাদের রসুল আমাদের জান্নাতের পথ সুদৃঢ় করে দিয়েছে। যদি বড় কোনও অন্যায় না করি, তাহলে ইসলাম নিয়ে জন্মানোর মানে জান্নাতে পৌঁছে যাওয়া। কিন্তু আল্লাহ সেই রহমত যাদের দেন নি, তারা যদি তেলাওয়াত এবং কোরআন শরীফের মানে বুঝতে পারেন, এবং একজনকেও যদি আমরা ঈমান দিতে পারি, তাহলে আমরা আমাদের জান্নাতের পথ একেবারে সুদৃঢ় হয়ে যাবে।”
“আমরা নিজেরা মুসলিম। মুসলিম ঘরে জন্মে বড় হয়েছি, আমাদের নামাজ, আদব কায়দা সব আমাদের বেশিরভাগ মানুষেরই জানা। কিন্তু যারা দুর্ভাগ্য নিয়ে জন্মেছে, যারা ইসলাম নিয়ে জন্মায় নি, তাদেরও দাওয়াতে ইসলাম। অর্থাৎ ইসলামের দাওয়াত দিয়ে তাদের মধ্যে ঈমান নিয়ে আসলে এটা আল্লাহতায়ালাকে খুশি করা হবে। আমাদের ইসলামের রাস্তা, আমাদের বাণীটাকে চারিদিকে ছড়িয়ে দিয়ে যদি একজনকেও আমরা ঈমানের দিকে নিয়ে আসতে পারি, তাহলে সত্যিকারের ইসলাম ধর্মের বৃদ্ধি হবে এবং সেটা বিস্তারিত হবে।”
ধর্মান্তরণ অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি বিষয়। পৃথিবীতে দুটি ধর্মের প্রচারকেরা ধর্মান্তরণে অসির ব্যবহারে যথেষ্ট পারদর্শীতা দেখিয়েছেন অতীতে। জোর করে, ভুল বুঝিয়ে বা লোভ দেখিয়ে কাউকে ধর্মান্তরিত করা দেশের বর্তমান আইন অনুযায়ী নিষিদ্ধ। তার পরেও নিজ ধর্মের প্রচার-প্রসার বেআইনি নয়। ইসলাম ধর্মে যেহেতু অন্য ধর্মের লোকদের দাওয়াত দিয়ে দলে টানার বিধান আছে, তাই ইসলাম ধর্মের প্রচারক অর্থাৎ মোল্লা- মৌলানা-মৌলভিদের মুখে ধর্মান্তরণের কথা উঠলে তাও মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু ফিরহাদ হাকিম ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিতে বিশ্বাস করে থাকেন বলে নিজে দাবি করে থাকেন। ফিরহাদ জাকির নায়েকের মতো ধর্ম প্রচারক নন। তিনি ভারত নামক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সংবিধানের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করা একজন জনপ্রতিনিধি ও মন্ত্রী। তিনি কলকাতা মহানগরীর মেয়র। ফিরহাদ অন্য ধর্মের লোকেদের ধর্মান্তরিত করতে তাঁর ধর্মের অনুসারীদের উষ্কানি দেন কোন আক্কেলে?
এটা ঠিক, ফিরহাদ হাকিম তাঁর পাড়ার ক্লাব চেতলা অগ্রণী সংঘের দুর্গা পুজোর সবথেকে বড় মাথা। ফিরহাদকে হোলিতে রঙ মাখতে কিম্বা শিবরাত্রিতে জল ঢালতেও দেখা যায়। কিন্তু এখন বিরোধীরা যদি বলেন, এ’সবই ববির মুখোশ, আল-তাকিয়া; তাহলে তাঁদের কথা ববি খন্ডন করবেন কীভাবে? বকধার্মিক বলে একটা কথা আছে বাংলায়। বকধার্মিক মানে ভন্ড, ধার্মিকের বেশে অধার্মিক। ববি হাকিম কি আসলে বক ধর্মনিরপেক্ষ? ভিডিওতে ফিরহাদ হাকিমকে বলতে শোনা যাচ্ছে, যারা মুসলমান হয়ে জন্মগ্রহণ করে নি, তারা দুর্ভাগা! ফিরহাদের এই কথাকে ‘হেট স্পিচ’ বা ঘৃণা ভাষণ ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে? নিজের ধর্মকে মহান প্রতিপন্ন করতে গিয়ে অপরাপর ধর্মকে নিচু প্রমাণ করার চেষ্টার নামই ধর্মান্ধতা। যে কারণে জাকির নায়েক দেশ থেকে নির্বাসিত। ভিন্ন ধর্মের মানুষকে দুর্ভাগা, হতভাগা, অভিশপ্ত বলা কি পরধর্ম সহিষ্ণুতার পরিচায়ক?
যাঁরা জন্মসূত্রে মুসলমান নন, ফিরহাদ হাকিম মনে করেন সেটা তাঁদের জন্য দুর্ভাগ্য। তারপরেই ফিরহাদ ঝোলা থেকে বিড়াল বের করেছেন, “যারা দুর্ভাগ্য নিয়ে জন্মেছে, যারা ইসলাম নিয়ে জন্মায় নি, তাদেরও ‘দাওয়াতে ইসলাম’। অর্থাৎ ইসলামের দাওয়াত দিয়ে তাদের মধ্যে ঈমান নিয়ে আসলে এটা আল্লাহতায়ালাকে খুশি করা হবে। আমাদের ইসলামের রাস্তা, আমাদের বাণীটাকে চারিদিকে ছড়িয়ে দিয়ে যদি একজনকেও আমরা ঈমানের দিকে নিয়ে আসতে পারি, তাহলে সত্যিকারের ইসলাম ধর্মের বৃদ্ধি হবে এবং সেটার বিস্তার হবে।” অন্য ধর্মে জন্মগ্রহণ করাটাই পাপ এবং সেই পাপ খন্ডনের একমাত্র রাস্তা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ- ফিরহাদের বক্তব্য তন্ন তন্ন করে বিশ্লেষণ করেও এর অতিরিক্ত কোনও নির্যাস খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে কি?
অনেকেই বলবেন, ফিরহাদ হাকিম যা বলেছেন, তা ইসলাম ধর্মেরই কথা। তাহলে ফিরহাদ হাকিম স্বীকার করে নিন, ইসলাম ধর্মের মৌলানা-মৌলভিদের সভায় তিনি ভুল কিছু বলেন নি, তাঁর ধর্মে যা করণীয় ও পালনীয়, সেটাই তিনি বলেছেন। ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী ভিডিওতে প্রচারিত ফিরহাদ হাকিমের বক্তব্য ‘জায়েজ’ হলেও দুটো কথা বাকি থাকে। ফিরহাদ হাকিম ইসলাম ধর্মের কোনও ইমাম নন। তিনি ভারতের সংবিধানের প্রতি শপথবদ্ধ মন্ত্রী, বিধায়ক ও মেয়রের চেয়ার অলঙ্কৃত করে ধর্মান্তরণ ও অন্য ধর্মকে হেয় প্রতিপন্ন করার মতো ঘৃণা ভাষণ দিতে পারেন না। জাকির নায়েকের মতো ধর্ম প্রচারক হতে চাইলে ফিরহাদের জন্য সেই রাস্তা খোলাই আছে।
Feature image : NNDC