বিশেষ প্রতিবেদন: ভাইজানের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বে ইতি বামপন্থীদের। ভাইজান মানে ফুরফুরা শরিফের আব্বাস সিদ্দিকি। আব্বাসের ভাই নৌশাদ ভাঙর থেকে জিতে বিধায়ক। একুশের বিধানসভা নির্বাচনে বাম-কংগ্রেস ও ভাইজানের সদ্য গঠিত দল আইএসএফ-এর মধ্যে জোট হয়েছিল। আইএসএফ-কে জোটে নেওয়ার মূল উদ্যোক্তা ছিল সিপিএম। সিপিএমের মধ্যে আবার সবথেকে বেশি গরজ ছিল মহম্মদ সেলিমের। সেলিম তখনও দলের রাজ্য সম্পাদক হন নি। সিপিএমের ভেতর কারও কারও ফুরফুরা শরিফের হুজুর আব্বাসের সঙ্গে এক ঘাটে পানি খাওয়া নিয়ে আপত্তি থাকলেও সেলিমের দাপটে তাদের আপত্তি পাত্তা পায় নি।
একুশে বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ জোটের একমাত্র বিজয়ী প্রার্থীর নাম নৌশাদ সিদ্দিকি। ভাঙর থেকে বেশ বড় ব্যবধানেই তৃণমূলের প্রার্থীকে হারিয়ে বিধানসভায় ঢুকে জোটের মান রক্ষা করেছিলেন নৌশাদ। নৌশাদ ভাইজানকে নিয়ে এই সে’দিন পর্যন্ত বাংলার বামপন্থীদের বৈপ্লবিক উদ্দীপনার শেষ ছিল না। ব্রিগেডে বামেদের সভায় আব্বাস সিদ্দিকিকে নিয়ে সিপিএমের লোকেদের উচ্ছ্বাসের দৃশ্য ভিডিও ফুটেজে সংরক্ষিত আছে। ভাইজানের মন রাখতে সেদিনের সভায় অধীর চৌধুরীর মতো নেতাকে পর্যন্ত মাঝপথে ভাষণ বন্ধ রাখতে বাধ্য করেছিলেন মহম্মদ সেলিম। অধীর রেগেমেগে মঞ্চ থেকে নেমে যান। কিন্তু ভাইজান আব্বাস তখন আলিমুদ্দিনের কাছে ‘আনমল রতন’। সেই রতন বগলদাবা রাখতে অধীর চৌধুরীকে ঘাড়ধাক্কা দিতেও সিপিএমের দ্বিধা ছিল না।
সংখ্যালঘুদের ভোটের জোরে আবার ভাঙা মাজা সোজা করে দাঁড়ানো যাবে, এই ভরসায় আব্বাস সিদ্দিকির মতো সাম্প্রদায়িক ব্যক্তির মধ্যেও ধর্মনিরপেক্ষতার পূত-পবিত্র বিগ্রহ দর্শন করা সিপিএমের কপালে শেষ পর্যন্ত সংখ্যালঘুদের লাথিই জুটেছিল। একুশের নির্বাচনে রাজ্যের মুসলমানরা তৃণমূলকে এতটাই হাত উপুড় করে ভোট দিয়েছিল যে মালদা-মুর্শিদাবাদেও খাতা খুলতে পারে নি বামেদের জোট শরিক কংগ্রেস। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এই দুই জেলা স্বাধীনতার পর থেকেই কংগ্রেসের গড় হিসেবে পরিচিত। তবে আব্বাস-নৌশাদের সঙ্গে সেলিমদের মোহাব্বতের কাল এখন অতীত। নিকাহর মাত্র দুই বছরের মধ্যেই তালাকনামায় দস্তখত করা সারা। ভাইজানেরা তলে তলে তৃণমূলের প্রেমে দিওয়ানা, বাজারে এমনই গুঞ্জন।
লোকসভা নির্বাচনের চতুর্থ দফার ভোটগ্রহণ শেষ। পঞ্চম দফার ভোট সামনে। সপ্তম তথা শেষ দফার ভোটের মনোনয়ন পর্ব সমাপ্ত। লোকসভা নির্বাচনের এই শেষ মুহূর্তে একটা বিষয় পরিষ্কার যে, বামেদের কলা দেখিয়েছে আইএসএফ। বাম-কংগ্রেসের সঙ্গে জোটে না গিয়ে এককভাবে ২৪টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে আইএসএফ। এমনকি সেলিম-অধীরের আসনে প্রার্থী দিতেও দ্বিধা করেন নি আব্বাস সিদ্দিকি। বিধায়ক নৌশাদ আইএসএফ-এর মুখ হলেও দলের রাশ তাঁর দাদা পীরজাদা আব্বাসের হাতে। ফুরফুরার আরেক পীরজাদা ত্বহা বহুদিন ধরেই তৃণমূলের তামাক সেবন করেন। এখন আব্বাসের হাতেও শাসকদল হুঁকো ধরায় নি, এই কথা অবিশ্বাস করার মতো কোনও জোরালো কারণ দেখা যাচ্ছে না। বরং লোকসভা ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই আইএসএফ-এর নানা পদক্ষেপে তৃণমূল তৃণমূল গন্ধ!
ডায়মন্ডহারবার কেন্দ্রে জোটের পক্ষে নৌশাদ দাঁড়িয়ে গিয়ে অভিষেককে বড় বেগ দেবেন, এমন কথা হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, তৃণমূলের সংখ্যালঘু ভোটে যাতে ভাগ না বসে, তেমন প্রার্থীই ডায়মন্ডহারবারে দাঁড় করিয়েছে আইএসএফ। এখন ক্ষেপে গিয়ে হাটে হাঁড়ি ভাঙছেন মহম্মদ সেলিম; গত দু’মাস ধরেই নাকি বিমান বসুর ফোন তুলেন না আব্বাস-নৌশাদ। অর্থাৎ আসন সমঝোতা নিয়ে সিপিএমের গরজ থাকলেও অনেক আগে থেকেই মন স্থির করে ফেলেছিল আইএসএফ। সেলিমের অভিযোগ, আইএসএফ নেতৃত্বের আগ্রহের অভাবেই সমঝোতা ভেস্তে গেছে।
সংখ্যালঘু অধ্যুষিত বহু আসনে বাম-কংগ্রেসের প্রার্থীদের হার নিশ্চিত করতে নিজেদের প্রার্থী দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আইএসএফ। যাদবপুর নিয়ে আলিমুদ্দিনের বড় আশা, সেখানেও প্রার্থী দিয়ে রেখেছেন আব্বাস ভাইজান। এমনকি সেলিম জিতুক, সেটাও চান না পীরজাদা। কাঁচা পিরিত চটকে গেলে আশেকানরা এই ভাবেই পরস্পরের দুষমন হয়ে ওঠে।
Feature graphic is representational and created by NNDC.