অন্য যে কোনও রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে ভোট পরিচালনা করা নির্বাচন কমিশনের জন্য চ্যালেঞ্জিং। দেশের বাকি রাজ্যগুলিতে দুই প্রতিদ্বন্দ্বি দলের মধ্যে সহিংসতার ঘটনা অনেক কমে এসেছে। এমনকি বিহার-ইউপির মতো একদা খতরনাক রাজ্যও শুধরে গেছে। দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে ভোটারদের হাত করতে টাকা-মদ বিলোনোর রেওয়াজ অনেক দিনের। তামিলনাড়ু, অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা ও কর্নাটকে কমিশনকে তাই সে’দিকেই বেশি নজর রাখতে হয়। কিন্তু বাংলায় নির্বাচন কালে মূল সমস্যাটা আইনশৃঙ্খলার। আমাদের রাজ্যে এমনিতেই রাজনীতি ঘিরে সারা বছর চাপান-উতর। ভোটের সময় দলের সদস্য-সমর্থকদের আরও বেশি করে হুলিয়ে দেন নেতারা।
শান্তিপূর্ণভাবে ভোট প্রচার করার অধিকার সমস্ত প্রার্থীর আছে। অথচ আমাদের রাজ্যে একটা কমন দৃশ্য হয়ে গেছে, এক দলের প্রার্থী প্রচারে গেলে তাঁকে ঘিরে ধরে আরেক দলের কর্মী-সমর্থকদের বিক্ষোভ। তৃণমূল তো এটাকে রাজনৈতিক কৌশলে পরিণত করে ফেলেছে। বিরোধী নেতাদের বাধা দিতে গ্রামের মহিলাদের সামনে এগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মঞ্চ থেকে ঘরের মেয়ে-বউদের প্ররোচিত করেন, যাতে ভোটের প্রচারে ও ভোটের দিন তারা কেন্দ্রীয় বাহিনীর সঙ্গে ঝামেলায় জড়ায়। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত অঞ্চলে মানুষকে কেন্দ্রীয় বাহিনীর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার পরিণামে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেলে তা তাদের জন্য লাভদায়ক বলে মনে করে একটি দল। একুশের বিধানসভা নির্বাচনে কোচবিহারের শীতলকুচির ঘটনায় তা প্রমাণিত।
শনিবার লোকসভার ষষ্ঠ দফা ভোটে প্ররোচনার কোনও অভাব ছিল না। বিরোধী প্রার্থীর গাড়ি ভাঙচুর। রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ। কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানের গায়ে হাত। এমনকি কর্তব্যরত জওয়ানের আগ্নেয়াস্ত্র কেড়ে নেওয়ার চেষ্টার মতো বিস্ফোরক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল একটি জায়গায়। নির্বাচনের সময় রাজ্য পুলিশকে দ্বিমুখী চাপের মধ্যে কাজ করতে হয়। অন্য সময় শাসকদলের হুকুম তামিল করলেই হল। ভোটের সময় নিরপেক্ষ পদক্ষেপ করতে পুলিশের উপর নির্বাচন কমিশনের চাপ থাকে। আবার কালীঘাটের বিষনজরে পড়লেও তো পুলিশকর্তাদের চলে না। সারা বছর যাঁর মন জুগিয়ে চলতে হবে, নির্বাচনের সময় তিনি অখুশি হন, এমন কাজ করা পুলিশের জন্য মোটেই সহজ ব্যাপার নয়। কমিশনের চাপে কড়া পদক্ষেপ করে পুলিশের আধিকারিকেরা পরে ফাঁপরে পড়েছেন, এমন নজির এই রাজ্যে আছে। রাজ্য পুলিশের কাছে বেশি নিরপেক্ষতা আশা না করাই ভাল। তারপরেও ষষ্ঠ দফা পর্যন্ত পুলিশের ভূমিকা যতটুকু দৃশ্যমান, তা মোটের উপর সন্তোষজনক।
একটি লোকসভা কেন্দ্রে ভোট পরিচালনা করা খুবই কঠিন কাজ। এই রাজ্যে সাতটা বিধানসভা নিয়ে একটি লোকসভা। এক-একটি বিধানসভাতেই ৩০০-৩৫০ বুথ থাকে। তাহলে সাতটি বিধানসভা মিলিয়ে কতগুলি বুথ চিন্তা করুন। একটা-দুটো দূরের কথা পনেরো-বিশটা বুথে ছাপ্পা করেও জনাদেশকে প্রভাবিত করা সম্ভব নয়। সার্বিক ভোটগ্রহণ যদি সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হয়, তবে নির্বাচনে মানুষের মতের প্রতিফলন ঘটতে বাধ্য। শনিবার প্ররোচনায় পা না দিয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনী দাঁতে দাঁত চেপে ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে ভাল কাজ করেছে। ঘাটালের কেশপুর ও ঝাড়গ্রামের গড়বেতায় যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানেরা চাইলে পিটিয়ে দুষ্কৃতীদের পাছার হাড্ডি ভেঙে দিতেই পারতেন। যাঁরা ভোটপ্রক্রিয়া ব্যাহত করে, তারা জনগণের অংশ হলেও দুষ্কৃতী ছাড়া আর কিছু নয়।
ষষ্ঠ দফায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর কড়া পদক্ষেপের জেরে কিছু ঘটে গেলে সপ্তম দফার ভোটের আগে কেউ কেউ আবার ইস্যু পেয়ে যেতেন। খলকে ছল করার সুযোগ না দেওয়াই কৌশল হিসেবে সর্বোত্তম। সপ্তম তথা শেষ দফায় রাজ্যে নয়টি কেন্দ্রে ভোট; সাতটিই যথেষ্ট স্পর্শকাতর এবং বহু জায়গায় গোলমাল পাকানোর লোকের অভাব নেই। তবে অষ্টম দফা যখন নেই, শেষ দিন কেন্দ্রীয় বাহিনী ও নির্বাচন কমিশনের সামনে অনেক বেশি কঠোর হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তাঁদের লাঠৌষধি যে রোগ সারাতে যথেষ্টই কার্যকর, পয়লা জুন বাহিনীর জওয়ানেরা যেন তা প্রমাণ করতে দ্বিধায় না ভোগেন।