আন্তর্জাতিক ডেস্ক: বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে শেখ হাসিনার সরকারকে বেশি চাপাচাপি না করতে আমেরিকাকে বলল ভারত। আগামী জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে বিএনপি সহ একাধিক বিরোধী দল। বিরোধীদের আন্দোলনের জেরে ইতিমধ্যেই উত্তপ্ত বাংলাদেশের রাজনীতি। নিজেদের লক্ষ্য পূরণে অনেকদিন ধরেই আমেরিকাকে পাশে চাইছে হাসিনা বিরোধীরা। সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচন নিয়ে আমেরিকার পররাষ্ট্র দফতরের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ায় হাসিনা সরকার বেশ বিব্রতও। সাউথ ব্লকও বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন দেখতে চায় তবে বিষয়টি নিয়ে অন্য কোনও রাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারের উপর চাপ অব্যাহত রাখুক, তা ভারতের নাপসন্দ। শুক্রবার দিল্লিতে আমেরিকার পররাষ্ট্রসচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনকে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের মনোভাব স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর।
দুই দেশের বাংলাদেশ নীতিতে ভিন্নতা এসেছে
পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে ‘টু প্লাস টু’ বৈঠক করতে ভারত সফরে এসেছেন আমেরিকার পররাষ্ট্রসচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও প্রতিরক্ষাসচিব লয়েড অস্টিন। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চিনের প্রভাব হ্রাস করতে ভারতকেই সবথেকে বড় কৌশলগত মিত্র বলে এখন মনে করছে ওয়াশিংটন প্রশাসন। বাংলাদেশ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই দিল্লির একটা শক্ত অবস্থান আছে। এই মুহূর্তে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের সব থেকে বড় বন্ধু বাংলাদেশ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামি লিগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অতীতের যে কোনও সময়ের তুলনায় অনেক বেশি দৃঢ় হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে উঠুক, নয়াদিল্লি তা চায় না। বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের এই স্পর্শকাতরতা আমেরিকারও অজানা নয়। ২০১৩ থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ভোটের দাবি জানিয়ে আসছে বিএনপি ও তার জোটসঙ্গীরা। ১৩ ও ১৮-য় বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচন নিয়ে হোয়াইট হাউসের বিশেষ আগ্রহ ছিল না। বাংলাদেশ নিয়ে ভারত ও আমেরিকার অভিন্ন অবস্থানই এর কারণ বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের বাংলাদেশ নীতিতে কিছুটা ভিন্নতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
জো বাইডেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ওভাল অফিসের আগ্রহ অত্যধিক বেড়েছে। বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসায় ভারত-আমেরিকার ‘টু প্লাস টু’ বৈঠকে বাংলাদেশ প্রসঙ্গের উত্থাপন অনিবার্যই ছিল। বৈঠকে বাংলাদেশ বিষয়ে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট করে দিয়েছেন জয়শঙ্কর। বৈঠক শেষে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় কোয়াত্রা সাংবাদিকদের বলেছেন, “বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি খুব স্পষ্ট করেই আমেরিকাকে জানিয়েছি আমরা। বাংলাদেশের নির্বাচন তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার একমাত্র অধিকার সে’দেশের জনগণের। তৃতীয় কোনও দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যায় নাক গলানোর জায়গায় নেই আমরা।” কোয়াত্রা আরও বলেন, “বন্ধু ও সহযোগী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সবসময়ই সম্মান জানাই আমরা। একটি স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ তাঁদের দেশকে দেখতে চান। বাংলাদেশের জনগণের এই দৃষ্টিভঙ্গিকে ভারত দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে যাবে।”
দিল্লি চায় না বেজিংয়ের খপ্পরে পড়ুক ঢাকা
তাঁর সরকারের উপর আমেরিকার চাপ লাঘব করতে শেখ হাসিনার একমাত্র অবলম্বন বন্ধু ভারত। আগামী দু-এক দিনের মধ্যেই বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচনের নির্ঘন্ট ঘোষণা হওয়ার কথা। এদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ভোট বর্জনের ডাক দিয়েছে বিএনপি ও তার সহযোগী দলগুলি। দাবি আদায়ে টানা অবরোধ ও হরতালের ডাক দিয়েছে বিরোধীরা। আন্দোলন সহিংস রূপ ধারণ করায় বিএনপির শীর্ষ নেতাদের জেলে ভরেছে সরকার। বিরোধীদের দাবিকে আমেরিকা সরাসরি সমর্থন না করলেও নির্বাচন নিয়ে শেখ হাসিনার সরকারকে চাপে রেখেছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের পররাষ্ট্র দফতর ধারাবাহিকভাবে বলে চলেছে, বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও সব দলকে নিয়ে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায় তারা। দিল্লির ভয়, আমেরিকার চাপের কারণে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে উঠলে ভারত বিরোধী মৌলবাদী শক্তি সেই সুযোগে ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। শেখ হাসিনার সরকার ভারতের প্রত্যাশা অনুযায়ী বাংলাদেশের মাটি থেকে যাবতীয় ভারত বিরোধী শক্তিকে উৎখাত করেছে। ফলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে শান্তি ফিরিয়ে আনা দিল্লির জন্য সহজ হয়েছে। ভারত কখনোই চাইবে না, আমেরিকার চাপে বাংলাদেশ কোনও রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়ুক।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আমেরিকার হস্তক্ষেপকে ভাল চোখে দেখছে না চিনও। দু’দিন আগে ঢাকায় নিযুক্ত চিনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনও বলেছেন, “বাংলাদেশের নির্বাচন তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের মানুষই সিদ্ধান্ত নেবে। বাইরের কেউ এতে হস্তক্ষেপ করুক- চিন তা চায় না।” এই দুঃসময়ে ভারত পাশে না দাঁড়ালে শেখ হাসিনার সরকার চিনের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা আছে সাউথ ব্লকের। বাংলাদেশে চিনের বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে এবং বাংলাদেশে ভারতের স্বার্থের হানি করা বেজিংয়ের লক্ষ্য। ভূ-রাজনৈতিক কারণেই যে কোনও মূল্যে তার সবথেকে ভাল প্রতিবেশী মিত্র রাষ্ট্রে চিনের প্রভাব সীমিত রাখতে চায় ভারত।
ভারত ক্ষুণ্ণ হয়, এমন নীতিতে অটল থাকা বাইডেনের জন্য সহজ নয়
বাংলাদেশ চিনের বলয়ে ঢুকে পড়লে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে আমেরিকার স্বার্থও যে ক্ষুণ্ণ হবে, ব্লিঙ্কেনেরও তা না বোঝার কারণ নেই। তবে বাংলাদেশ নিয়ে ভারত তার অবস্থান পরিষ্কার করলেও আমেরিকার মনোভাব জানা যায় নি। ‘টু প্লাস টু’ বৈঠকে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ যে উঠেছিল, ভারতের দিক থেকে সংবাদ মাধ্যমের কাছে তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন পররাষ্ট্রসচিব বিনয় কোয়াত্রা। কিন্তু অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের মুখে কুলুপ। পঞ্চম বার্ষিক ‘ইন্দো-ইউএস’ টু প্লাস টু মন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনার উপর আমেরিকান সরকারের তরফে যে ‘জয়েন্ট স্টেটমেন্ট’ প্রকাশ করা হয়েছে তাতে বাংলাদেশ প্রসঙ্গের উল্লেখ নেই। ভারতের প্রভাবে বাইডেন প্রশাসনের বাংলাদেশ নীতিতে বড় কোনও পরিবর্তন এসেছে কিনা, তা দেখার জন্য আরও কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হবে বলে মনে করছেন দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞরা। তবে ভারত দৃঢ়ভাবে বাংলাদেশ সরকারের পাশে দাঁড়ানোয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে আশ্বস্ত হয়েছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বর্তমান আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পরিস্থিতিতে ভারত ক্ষুণ্ণ হতে পারে, বাংলাদেশ নিয়ে এমন কোনও শক্ত পদক্ষেপ করা ওভাল অফিসের জন্য মোটেই সহজ নয়।
Feature graphic is representational.