আদালতের রায়ে মহা ফাঁপরে মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। চিকিৎসক ডিসচার্জ সার্টিফিকেট লিখে দিলেই বাইপাসের ধারের বেসরকারি হাসপাতাল থেকে ছুটি। গেটের বাইরেই দাঁড়িয়ে কয়েকটি দু পেয়ে বাঘ থুরি এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট-এর ঘাঘু অফিসারেরা। হাসপাতাল থেকে বাইরে পা ফেলা মাত্রই জ্যোতিপ্রিয়র ঘেটি ধরবেন তাঁরা। বালুর জন্য শাঁখের করাত হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যাঙ্কশাল আদালতের নির্দেশ। পূজা শেষ হতে না হতেই দুর্গতিনাশিনী যে তাঁর কপালে এমন দুর্গতি লিখে রেখেছেন, তা কি স্বপ্নেও ভেবেছিলেন জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক? যদিও ১৪ অক্টোবর বাকিবুর রহমানের গ্রেফতারের পর বালুর বাড়িতে ইডি না পড়লেই বাঁকাকথা বলতে শুরু করতেন রাজ্যের সাধারণ মানুষ।
খাদ্য দফতর মধুর হাঁড়ি। সেই হাঁড়ির হেফাজতকারী হিসেবে বালুবাবু কতটা চালু, আম জনতার তা অজানা নয়। এই জামানায় কোন মন্ত্রীর হজমশক্তি কেমন, তা বঙ্গীয় সমাজে ‘ওপেন সিক্রেট’, বাজারে চাউর হয়ে যাওয়া গুপ্তঘটনা মাত্র। রেশনে ঘাপলা রাজ্যে নতুন কোনও ঘটনা নয়। রেশন দুর্নীতির অভিযোগের প্রথম তদন্ত শুরু করেছিল রাজ্য পুলিশই। তবে মামলা ইডির হাতে না গেলে বাকিবুরের ১০০ কোটি টাকার সাম্রাজ্যের হদিস মিলত না। মাথায় কার কার হাত থাকলে বাকিবুরদের আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়, পুলিশের চেয়ে ভাল তা আর কার জানা আছে। খাদ্যমন্ত্রী একটু-আধটু খাবেন, এতে আশ্চর্যের কী! বাম জামানায় দীর্ঘদিন খাদ্য দফতর সামলেছেন পরেশ অধিকারী। কলকাতার খাদ্যভবনে বাকিবুরের দহরম-মহরমের শুরু বাম আমলেই। শোনা কথা, জামানা বদলের পর চাপের মুখে আইনি ঝুটঝামেলা থেকে বাঁচতেই ফরওয়ার্ড ব্লক ছেড়ে তৃণমূলে যোগদান করেছিলেন পরেশ। তবে রক্তে মাত্রাতিরিক্ত শর্করা থাকলেও জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক স্বল্পাহারেই তুষ্ট, এই বদনাম তাঁর চরম শত্রুও দিতে অপারগ।
বাজারের খবর আর ইডি-সিবিআইয়ের তদন্ত এক জিনিস নয়। তদন্তকারীদের আদালতের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। তাই আঁটঘাট না বেঁধে কাউকে ধরে আনতে যান না এজেন্সির আধিকারিকেরা। শক্ত কিছু তথ্যপ্রমাণ হাতে পাওয়ার পরেই বৃহস্পতিবার (২৬ অক্টোবর) জ্যোতিপ্রিয়র ঘরে ছাপা মারতে নেমেছিল ইডি। বালু নিঃসন্দেহে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ বৃত্তের একজন। তৃণমূলের অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা। দলে পুরোনোদের অন্যতম। তবে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর বেশ দূরত্ব আছে বলেই খবর। এই দূরত্ব ও জ্যোতিপ্রিয়র ইডির খপ্পরে পড়ার মধ্যে যোগসূত্র খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। বালু মুখ্যমন্ত্রীর কিচেন ক্যাবিনেটের সদস্য। বিশ্বস্ত জ্যোতিপ্রিয়র ইডির হাতে গ্রেফতার নিঃসন্দেহে মমতার মন্ত্রিসভাকে দুর্বল করবে, কিন্তু দুয়ে-দুয়ে চার করার সময় এখনও আসে নি।
আমাদের মন্ত্রীরা যে খুবই অসুস্থ অবস্থায় জনগণের কথা ভেবে দফতরের ধকল সামলান, তাঁরা ইডি-সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার না হওয়া পর্যন্ত তা বোঝা যায় না। রাজ্যের বনমন্ত্রীও ইডির হাতে গ্রেফতার হওয়া মাত্রই অসুস্থ হয়ে পড়েন। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক আদালতে সংজ্ঞা হারালে তাঁকে বাইপাসের ধারে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তবে তার আগেই ধৃত মন্ত্রীর দশদিনের ইডি হেফাজতের নির্দেশ দেন ব্যাঙ্কশাল কোর্টের বিচারক। আদালতের নির্দেশ, সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া মাত্রই জ্যোতিপ্রিয়কে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিজেদের হেফাজতে নিতে পারবে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট। অসুস্থ থাকতে কারোরই ভাল লাগে না। কিন্তু বালুর উভয় সঙ্কট। হয় সত্যি সত্যি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হবে। নয় অসুস্থতার ভান করে হাসাপাতালের কেবিনে শুয়ে থাকতে হবে। আর তবিয়ত ঠিকঠাক থাকলে ইডির হেফাজতে গমন করতে হবে কমপক্ষে দশদিনের জন্য।
সোমবার জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত রিপোর্ট আদালতে জমা করার নির্দেশ ছিল ইডির উপর। সন্ধ্যায় জানা গেল, শরীরের যাবতীয় ‘প্যারামিটার’ নিয়ন্ত্রণে থাকায় মন্ত্রীকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাঁর চিকিৎসায় নিয়োজিত হাসপাতালটির মেডিকেল বোর্ড। ঠিক কোন মাহেন্দ্রক্ষণে মন্ত্রীমশাইকে ইডির হেফাজতে তুলে দেওয়া হবে, তা এখনও জানা যায় নি। শেষ মুহূর্তে হার্টবিট অস্বাভাবিক বেড়ে গেলে অথবা সুগার লেভেল অস্বাভাবিক নেমে গেলে বালুদাকে কেবিন থেকে বের করে হাসপাতালের গেটের বাইরে পাঠানোর কাজটা চাঁদে বিক্রমের ‘সফ্ট ল্যান্ডিং’-এর থেকেও চ্যালেঞ্জিং হতে পারে।
Feature graphic is representational.