মোসাদ ভয়ঙ্কর, কেজিবি দুর্ধর্ষ, সিআইএ সর্বভূতে, 'র'ও কিন্তু ভক্তিগীতি গায় না - nagariknewz.com

মোসাদ ভয়ঙ্কর, কেজিবি দুর্ধর্ষ, সিআইএ সর্বভূতে, ‘র’ও কিন্তু ভক্তিগীতি গায় না


‘র’-এর কাজ ‘র’ করবে, কূটনীতিকদের কাজ কূটনীতিকরা। দিনের শেষে রাষ্ট্র মানেই ‘সাম-দাম-দন্ড-ভেদ’। লিখলেন উত্তম দেব-

বিদেশের মাটিতে দেশের শত্রুর গুপ্তহত্যা ইতিহাসে নতুন কোন‌ও ঘটনা নয়। পৃথিবীর সব শক্তিশালী দেশের‌ই একটি দক্ষ ‘ফরেন ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্ক’ আছে। এদের অনেকেই গুপ্তহত্যার জন্য বিখ্যাত অথবা কুখ্যাত। নিজের অস্তিত্বের প্রশ্নে প্রথম থেকেই আপোষহীন ইহুদিদের জাতিরাষ্ট্র ইজরায়েল। ইজরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থার নাম ‘মোসাদ’, যা দেশটির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মতোই ভয়ঙ্কর। মোসাদের কাজ, পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে ইজরায়েল বিরোধী শক্তিগুলিকে চিহ্নিত করে ধ্বংস করা। ‘টার্গেট কিলিং’-এর মাধ্যমে অন্য রাষ্ট্রের মাটিতে শত্রুনাশ ও নিখুঁত ‘অপারেশন’-এর দ্বারা শত্রুকে জীবিত অবস্থায় ভিনদেশ থেকে অপহরণে মোশাদের জুড়ি নেই। পঞ্চাশের দশক থেকে এখনও পর্যন্ত ৩,০০০ জন মোসাদের হাতে খুন হয়েছে বলে নিজের লেখা ব‌ইয়ে ( The Shadow War, Israel and the Mossad’s Secret Killings) দাবি করেছেন ইজরায়েলি গবেষক ও সাংবাদিক রোনেন বার্গম্যান।

মোসাদের শিকারের তালিকায় আছে পিএল‌ও সহ বিভিন্ন ফিলিস্তিনি সশস্ত্র সংগঠনের বড়-ছোট নেতা, লেবাননের শিয়াপন্থী মিলিশিয়া হিজবুল্লাহর একাধিক শীর্ষনেতা, বিভিন্ন ইসলামিক জঙ্গি সংগঠনের মাথা থেকে ইরানের হাফডজন পরমাণু বিজ্ঞানী। মোসাদের সবথেকে বড় ব্যর্থতা নিঃসন্দেহে অনেক চেষ্টার পরেও পিএল‌ও-র প্রতিষ্ঠাতা ও ফিলিস্তিনি আন্দোলনের সবথেকে ক্যারিশ্মাটিক নেতা ইয়াসির আরাফাতকে ছুঁতে না পারা। ২০০৪ সালের ১১ নভেম্বর প্যারিসের কাছে ক্ল্যামার্টের সামরিক হাসপাতালে ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত আরাফাত যখন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, তখন তাঁর বয়স পঁচাত্তর। ইয়াসের আরাফাতের মৃত্যুর কারণ নিয়ে বিষ প্রয়োগের একটা গুঞ্জন থাকলেও এই দাবির সমর্থনে কোন‌ও জোরালো প্রমাণ উপস্থাপন করা যায় নি।

গুপ্তহত্যায় কম পারদর্শী ছিল না সোভিয়েত ইউনিয়নের সিক্রেট সার্ভিস কেজিবিও। এখন সোভিয়েত ইউনিয়নের মতোই কেজিবিও বিলুপ্ত। কিন্তু তাতে রুশ গোয়েন্দাদের পারফরম্যান্স খারাপ হয়ে যায় নি। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ পুতিন নিজে কেজিবির দুর্ধর্ষ অফিসার ছিলেন। রাশিয়ার প্রবাদ আছে, কেউ পুতিনের অরুচি হলে তার একমাত্র কাজ ঈশ্বরকে স্মরণ করা। দিন কয়েক আগেই রহস্যজনক বিমান দুর্ঘটনায় ভাগনার প্রধান ইয়েভজেনি ভিক্টোরোভিচ প্রিগোঝিনের মৃত্যু হয়েছে। পুতিনের শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সকলেই জানেন, আর কোনও দিন এই রহস্যের কিনারা হবে না। পুতিনের বিরাগভাজন হ‌ওয়ার পর রাশিয়া থেকে পালিয়ে বাঁচার সুযোগ পান নি প্রিগোঝিন। পুতিনের কয়েকজন হতভাগা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ইউরোপে পালিয়েও রক্ষা পান নি। রুশ সিক্রেট সার্ভিসের সদস্যদের হাতের কাজ এতটাই সূক্ষ্ম যে প্রয়োজনে একবিন্দু রক্তপাত ছাড়াই তারা কাউকে চিরদিনের মতো ঘুম পাড়িয়ে দিতে সক্ষম।

পৃথিবীর সবচেয়ে খতরনাক সিক্রেট সার্ভিসের নাম যদি হয় মোসাদ তবে দুনিয়ার সবথেকে চর্চিত গোয়েন্দা সংস্থার নাম সিআইএ। গুপ্তহত্যার চাইতেও সিআইএ-র বেশি দক্ষতা রেজিম চেঞ্জে। যে কোনও দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা এমনকি ডিপ স্টেটে অনুপ্রবেশ করতে আমেরিকার সিআইএ-র থেকে পারদর্শী দ্বিতীয় কোনও সিক্রেট সার্ভিসের জন্ম হয় নি পৃথিবীতে। মোসাদ, সিআইএ কিম্বা কেজিবি; নাম যাই হোক আর যে দেশের‌ই হোক, যে কোনও সিক্রেট সার্ভিসের একটাই উদ্দেশ্য- যে কোনও মূল্যে ভিন্ন দেশের মাটিতে দেশের স্বার্থকে রক্ষা করা। খোলকরতাল নিয়ে কীর্তন গাওয়ার জন্য রাষ্ট্র রাশি রাশি গাঁটের কড়ি গচ্চা দিয়ে দেশে দেশে দুঁদে গোয়েন্দাদের পোষে না। ১৯৬৮ সালে ২১ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠিত ভারতের ফরেন ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির নাম রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংস বা ‘র’। ‘র’-এর কাজ‌ও নিঃসন্দেহে দেশে দেশে ভক্তিগীতি পরিবেশন করা নয়।

জন্ম নেওয়ার মাত্র তিন বছরের মধ্যেই ‘র’ বড় সাফল্যের পরিচয় দেয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল নিজে ‘র’-এর সিক্রেট মিশনে ৭ বছর পাকিস্তানে ছিলেন ‘স্পাই’ হিসেবে। গত ১৮ জুন কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়ার সারে এলাকায় গুরু নানক শিখ গুরুদ্বার সাহিব চত্বরের পার্কিং লটে দু’জন অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতীর গুলিতে নিহত হন হরদীপ সিং নিজ্জর। নিজ্জর ভারতে নিষিদ্ধ সংগঠন খালিস্তান টাইগার ফোর্সের শীর্ষনেতা। ২১ জন ‘ওয়ান্টেড’ খালিস্তানি জঙ্গির নামের যে তালিকা কানাডা সরকারের হাতে তুলে দিয়েছে নয়াদিল্লি, সেই তালিকায় হরদীপ সিং নিজ্জরের‌ও নাম ছিল। নিজ্জর খুনে সরাসরি ভারতকে দায়ী করে অটোয়ার ভারতীয় দূতাবাসের ইন্টেলিজেন্স প্রধান পবনকুমার রাইকে কানাডা থেকে বহিষ্কার করেছে জাস্টিন ট্রুডোর সরকার।

নিজ্জর খুনের তদন্তে নেমে এখনও কাউকেই গ্রেফতার করতে পারে নি কানাডার পুলিশ। ঘটনার তিনমাস পেরিয়ে গেছে। সূত্র খুঁজতে হিমসিম খাচ্ছেন কানাডা পুলিশের গোয়েন্দারা। ট্রুডো পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে দাবি করেছেন, কানাডার নাগরিক হরদীপ সিং নিজ্জরের‌ খুনে ‘র’-এর যোগ থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু কী প্রমাণ কানাডা সরকার পেয়েছে, তা খোলসা করেন নি ট্রুডো। কানাডা আনুষ্ঠানিকভাবে তথ্যপ্রমাণ ভারত সরকারের হাতে তুলে দিয়েছে বলে জানিয়েছেন জাস্টিন ট্রুডো। যদিও নিজ্জর হত্যাকান্ডে ভারতীয় কোনও এজেন্সির যোগ থাকার অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিয়েছে সাউথ ব্লক। একটা ব্যাপার স্পষ্ট, নিজ্জরের খুন পাকা হাতের কাজ। পরিকল্পনা নিখুঁত, তাই তদন্তে নেমে চোখে ধোঁয়া ধোঁয়া দেখছেন ট্রুডো সাহেবের গোয়েন্দারা।

কানাডায় হরদীপ সিং নিজ্জর খুন হ‌ওয়ার দিন কয়েক আগে যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামে মৃত্যু হয়েছে আরেক খালিস্তানি নেতা অবতার সিং খান্ডার। গত ১৫ জুন বার্মিংহামের একটি হাসপাতালে ৩৫ বছরের খান্ডার মৃত্যু হয়েছে। রক্তের ক্যানসারে ভুগে খালিস্তান লিবারেশন ফোর্সের নেতা অবতার সিং খান্ডার মৃত্যু হয়েছে বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে। ব্রিটিশ পুলিশের তদন্তেও এক‌ই দাবি করা হয়েছে। যদিও খান্ডার অনুগামীদের অভিযোগ, বিষ প্রয়োগে তাকে হত্যা করেছে ‘র’। অবতার সিং খান্ডা ছিলেন ধৃত খালিস্তানি নেতা অমৃতপাল সিংয়ের ঘনিষ্ঠ বৃত্তের একজন। লন্ডনের ভারতীয় দূতাবাসে খালিস্তানপন্থী শিখদের বিক্ষোভের সময় যে তোড়ফোড়ের ঘটনা ঘটে খান্ডাই ছিলেন তার মাস্টারমাইন্ড।

চলতি বছরের ৬ মে সকালে পাকিস্তানের লাহোরের জোহার এলাকায় প্রাতভ্রমণে বেরিয়ে আর বাসায় ফেরেন নি ফেরারি খালিস্তানি জঙ্গি পরমজিৎ সিং পাঞ্জোয়ার। অজ্ঞাতপরিচয় দুই আততায়ীর গুলিতে বাড়ির কাছেই রাস্তায় পড়ে মৃত্যু হয় পরমজিতের। খালিস্তান কমান্ডো ফোর্সের প্রধান বছর তেষট্টির পরমজিৎ সিং পাঞ্জোয়ার ভারতের তৈরি মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গিদের তালিকার অন্যতম একজন। ১৯৯৯ সালে চন্ডীগড়ের সেক্টর ৩৪-এ বোমা বিস্ফোরণের ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে তাকে খুঁজছিল পুলিশ।

২০২২-এর জুলাই মাসে কানাডার সারে এলাকায় খুন হয় রিপুদমন সিং মালিক নামে আরও এক কুখ্যাত খালিস্তানি জঙ্গি। ১৯৮৫ সালে এয়ার ইন্ডিয়ার ‘কণিষ্ক’ নামের বিশাল বিমানটি বিস্ফোরণে মাঝ আকাশে উড়িয়ে দিয়েছিল খালিস্তানি জঙ্গিরা। পাইলট,কো-পাইলট ও কেবিন ক্রু সমেত ৩৩১ জন যাত্রীর মৃত্যু হয়েছিল এই নাশকতায়। কণিষ্ক বিস্ফোরণে অভিযুক্তদের একজন হিসেবে রিপুদমনের নাম‌ও ছিল ভারতের মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গিদের তালিকায়। কিন্তু বাব্বর খালসা গোষ্ঠীর এই খতরনাক সন্ত্রাসবাদীকে ২০০৫ সালে নির্দোষ বলে ঘোষণা করে কানাডার আদালত।

২০২০-র জানুয়ারিতে লাহোরের এক গুরুদোয়ারার বাইরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় হারমিত সিং। ওয়ান্টেড খালিস্তানি জঙ্গিদের যে তালিকা ভারত সরকার পাকিস্তানের হাতে তুলে দিয়েছে, তাতে হারমিতের নাম ছিল। পাঞ্জাবের দুই আর‌এস‌এস নেতাকে খুনের অভিযোগে হারমিত সিংকে খুঁজছিল পুলিশ। কোনও মুসলমান নারীর প্রেমে পড়ায় সেই নারীর পরিবারের লোকজন হারমিতকে খুন করে বলে স্থানীয় পুলিশের সন্দেহ। পাকিস্তান পুলিশের কথা সত্যি হলে ধরে নিতে হচ্ছে, হারমিত সিংয়ের হত্যার পেছনে কোন‌ও গূঢ় রহস্য লুকিয়ে নেই।

র’-এর প্রতিষ্ঠাতা প্রধান রামেশ্বর নাথ কাও, যাঁর আরেক নাম ‘স্পাই মাস্টার অব ইন্ডিয়া’। ইলাস্ট্রেটর- ডোমিনিক জেভিয়ার

সিক্রেট সার্ভিস মানেই কথা কম, কাজ বেশি। রাষ্ট্রের তরফে কোন‌ও ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ দেওয়া হলে ‘র’-এর দক্ষ, পেশাদার ও নিবেদিতপ্রাণ সদস্যরা জানেন কীভাবে তা ‘কামিয়াব’ করতে হয়। ‘র’-এর কাজ ‘র’ করবে, কূটনীতিকদের কাজ কূটনীতিকরা। দিনের শেষে রাষ্ট্র মানেই ‘সাম-দাম-দন্ড-ভেদ’।

Feature image is representational.


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *