রাজধর্ম পালন কালে বাস্তববুদ্ধি পরিহার করে দুষ্টুবুদ্ধিকে প্রশ্রয় দেওয়ার পরিণাম সব সময় ভাল হয় না। রাজ্যের পঞ্চায়েত নির্বাচন তার সাক্ষাৎ প্রমাণ। পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে জট যেন কিছুতেই কাটছে না। রাজ্য সরকারের অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট করার সদিচ্ছা থাকলে জটিলতা তৈরি হত না। কিন্তু সরকারের কি আদৌ সেই সদিচ্ছা ছিল বা আছে? নবান্নের পঞ্চায়েত ভোট সংক্রান্ত পদক্ষেপের দিকে তাকালে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর সদিচ্ছা নিয়েই সংশয় জাগা স্বাভাবিক। এই রাজ্যে পুরসভা বা পঞ্চায়েত এমন একটি নির্বাচন, যেখানে ভোটের দিনক্ষণ, দফা ঠিক করতে নির্বাচন কমিশনের কার্যত কোনও ভূমিকা থাকে না। এই সংক্রান্ত আইনের মধ্যেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত ত্রুটি আছে। আইনটি বাম জামানায় করা। কিন্তু মমতাও তার সুযোগ নিতে দ্বিধা করছেন না। পঞ্চায়েত আইনে বলা আছে সরকার ভোটের দিনক্ষণ জানানোর পর রাজ্য নির্বাচন কমিশন ভোটের বিজ্ঞপ্তি ঘোষণা করবে।
এইবারও আইনের সুযোগ নিয়ে পঞ্চায়েত ভোটের ব্যাপারে যেমন খুশি তেমন পদক্ষেপ করেছে সরকার। একে রাজনৈতিক কারণে অতি বিলম্বে এবং অসময়ে পঞ্চায়েত নির্বাচন করার কৌশল নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তার উপর যে ভোটে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করাটাই প্রশাসনের কাছে সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ, সেই ভোট একদিনে করার মতো হঠকারি সিদ্ধান্ত সরকারের! ৬১ হাজার ৬৩৬টি ভোটকেন্দ্রে রাজ্য পুলিশ দিয়ে একদিনে ভোট করার সর্বনাশা সিদ্ধান্ত যে দিন নবান্ন নিয়েছিল, সে দিনই পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে জটিলতার সুত্রপাত। ৬১ হাজার ৬৩৬টি ভোটকেন্দ্রে মাত্র দু’জন করে সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন করার মতো জনবল যে প্রশাসনের নেই, সেই প্রশাসনের মাথা কীভাবে এমন অবিমৃষ্যকারিতার পরিচয় দিতে পারলেন?
রাজ্য নির্বাচন কমিশনার পদে দায়িত্ব গ্রহণের ২৪ ঘন্টার মধ্যেই আচমকা এক দফায় পঞ্চায়েত ভোটের সূচি ঘোষণা করে বসেন রাজীব সিনহা। ঘোষণা মাত্রই হাইকোর্টের শরণাপন্ন হন বিরোধীরা। এই ধরণের পরিস্থিতিতে বিরোধীরা যে আদালতে যেতে পারেন, যাবেন, পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে মুখ্যমন্ত্রীর তা অজানা থাকার কথা নয়। তারপরেও একজন বশংবদ প্রাক্তন আমলাকে কমিশনের মাথায় বসিয়ে একদিনে পঞ্চায়েত ভোট সেরে ফেলার দুরভিসন্ধি কেন মাথা থেকে দূর করে দিতে পারলেন না তিনি? আজকে হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্টে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তি ধুলোয় লুটোচ্ছে। রাজ্য নির্বাচন কমিশন যে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অক্ষম, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করানোর ব্যাপারে কমিশনের যে সদিচ্ছার অভাব আছে, এটা আদালতও উপলব্ধি করেছে। মনোনয়ন পর্বে ব্যাপক অনিয়ম, পেশী শক্তির আস্ফালন, সন্ত্রাস, রক্তপাত এবং মৃত্যুর ঘটনা বিচারপতিদের বাধ্য করেছে বিরোধীদের দাবি মেনে নিতে। নিতান্তই অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাইকোর্টের নির্দেশে কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে পঞ্চায়েত ভোট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য নির্বাচন কমিশন।
আদালতের নির্দেশ রক্ষা করতে ৮২২ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে চিঠি পাঠায় নির্বাচন কমিশন। ৮২২ কোম্পানি মানে ৮২ হাজার ২০০ জনের ফোর্স। হঠাৎ করে একসঙ্গে এত বাহিনী বাংলায় পাঠানো মুখের কথা নয়। প্রথমে চাওয়া ২২ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী ইতিমধ্যেই জেলায় জেলায় মোতায়েন হয়ে গেছে। আরও ৩১৪ কোম্পানি বাংলার জন্য বরাদ্দ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কিন্তু তারপরেও আরও ৪৮৬ কোম্পানির ঘাটতি থাকে। এদিকে বরাদ্দ হওয়া ৩১৪ কোম্পানি বাহিনী কোন জেলায় কত সংখ্যায় মোতায়েন করা হবে, তার কোনও পরিকল্পনা এখনও রাজ্য নির্বাচন কমিশন করে উঠতে পারে নি বলে অভিযোগ। এই পরিস্থিতিতে এখন কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্য নির্বাচন কমিশনে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে।
কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত ৮২২ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী রাজ্যে পাঠাতে পারবে কিনা তা নিয়ে গভীর সংশয় তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক মহলে। এমতাবস্থায় পঞ্চায়েত ভোট একাধিক দফায় ভাগ করে দেওয়ার চাপ বাড়ছে কমিশনের উপর। এই দাবি নিয়ে ইতিমধ্যেই হাইকোর্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন বিরোধীরা। বাহিনী মোতায়েনের সুবিধার জন্য লোকসভা, বিধানসভা ভোট একাধিক দফায় ভাগ করে দেয় কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন। পঞ্চায়েত নির্বাচনও তিন-চার দফায় ভাগ করে দিলে অনেক কম কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়েই অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট করিয়ে নিতে পারত রাজ্য নির্বাচন কমিশন। ২০১৩ সালে সরকারের সঙ্গে আইনি সংঘাতে গিয়েও পাঁচ দফায় পঞ্চায়েত নির্বাচন করিয়ে নিয়েছিলেন প্রাক্তন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পান্ডে।
যে হেতু পঞ্চায়েত ভোটের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করে রাজ্য সরকার, তাই ভোট নিয়ে জটিলতার দায় নিতে হবে সরকারকেই। আর রাজ্য সরকার মানেই রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন নি দেখেই একদিনে পঞ্চায়েত ভোট করার নির্দেশ কমিশনের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। ২০১৮-র পঞ্চায়েত ভোট ঘিরে বাংলায় যে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছিল তার পুনরাবৃত্তি রোধের কোনও আন্তরিক তাগিদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আছে বলে মনে হয় না। রাজধর্ম মানে হীন রাজনৈতিক ছলচাতুরি নয়। নাগরিক স্বার্থে প্রশাসনের অভিভাবককে ক্ষুদ্রবুদ্ধি, ক্ষুদ্রস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে হয়।
Feature Image is Representational.