মুকুল রায় নিজে ছিলেন ঘুঁটিবাজির দক্ষ খেলোয়াড়। তিনি কি নিজেই আজ অন্যের হাতে ঘুঁটি? লিখলেন নির্বাণ রায়-
বঙ্গের রাজনীতিতে এখন রঙ্গের অভাব নেই। দুয়ারে সিবিআই দেখে বাড়ির পেছনের পাঁচিল টপকে বিধায়কের পলায়নের চেষ্টা থেকে পুকুরে মোবাইল ফেলে দেওয়া, সবই সম্ভব বাংলায়। সোমবার সন্ধ্যে থেকে সেই রঙ্গে যোগ হয়েছে আবার রহস্য। মুকুল ভ্যানিশ! মিডিয়া-সোস্যাল মিডিয়ার কল্যাণে এই বার্তা মুহূর্তেই রটে গেল গোটা রাজ্যে। বাপের খোঁজ না পেয়ে বীজপুর ও বিমানবন্দর থানায় মিসিং ডায়েরি পর্যন্ত করে ফেললেন শুভ্রাংশু। যদিও রাতে শুতে যাওয়ার আগেই জনগণ জানতে পারল, মুকুলের খোঁজ মিলেছে দিল্লিতে।
কলকাতায় অন্তর্ধানের পর মুকুল রায় দিল্লিতে! কেন? এখন এই প্রশ্নেই শতেক জল্পনা রাজনৈতিক মহলে। দিল্লির দরবারি রাজনীতির অলিগলি নিজের হাতের তালুর মতোই চেনেন মুকুল রায়। যদিও পুত্র শুভ্রাংশু বলছেন, “এই মুকুল সেই মুকুল নয়।” মঙ্গলবার সংবাদ মাধ্যমের সামনে বাবার গুচ্ছের ব্যামোর তালিকা পেশ করে শুভ্রাংশুর অভিযোগ, “অসুস্থ লোকটাকে নিয়ে নোংরা রাজনীতি করছে বিজেপি।” অস্ত্রোপচারের পর মুকুলের মস্তিষ্কে ‘চিপস’ বসেছে, এই খবর সংবাদ মাধ্যম মারফত আমরা আগেই জেনেছি। কিন্তু মুকুল যে বাসায় ‘ডায়াপার’ পরেন, এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাবলিক জানত না। ছেলের দাবি- বাবাকে বাসায় ‘হাগিস’ পরিয়ে রাখতে হয়।
মুকুল দিল্লিতে যাহা বলিলেন
সোমবার রাতেই দিল্লি বিমানবন্দরের বাইরে সংবাদ মাধ্যমের ক্যামেরায় মুকুলের উপস্থিতি ধরা পড়েছে। দুই ব্যক্তি তাঁকে সাংবাদিকদের থেকে আগলে রাখার চেষ্টা করলেও মুকুল কিঞ্চিত মুখ খুলেছেন। যতটুকু খুলেছেন, তাতে তাঁকে নিয়ে উৎকণ্ঠার অবসান হলেও রহস্য আরও ঘনীভূত হয়েছে। সাংবাদিকেরা জানতে চান তিনি কেন দিল্লি এসেছেন? মুকুল রায়ের জবাব, “এমনিই এসেছি। দিল্লিতে কি আমি আসতে পারি না? আমি তো আগেও অনেকবার দিল্লি এসেছি। এ’বার একটু দেরি হয়ে গেল আসতে। আমি তো এখানকার এমএলএ। এখানকার এমপি! যত দিন প্রয়োজন, তত দিন থাকব। আমি এমনি কাজে এসেছি দিল্লি। কোনও বিশেষ কারণে আসি নি।” তিনি কি চিকিৎসার জন্য দিল্লি এসেছেন? এই প্রশ্নের জবাবে মুকুল জানান, “না, ডাক্তার দেখাতে দিল্লিতে আসতে হবে কেন! আমি প্রয়োজনে এসেছি।”
মুকুলের সব কথা অসংলগ্ন নয়
শুভ্রাংশু রায়ের দাবি, “বাবা পারকিনসন্স রোগে ভুগছেন। কিছু মনে রাখতে পারেন না। অসংলগ্ন কথা বলেন।” স্ত্রীর মৃত্যু, তৃণমূলে প্রত্যাবর্তন ও শারীরিক-মানসিক অবস্থার অবনতি- মুকুল রায়ের জীবনে এই তিনটি ঘটনা যুগপৎ ঘটেছে বললে অতিশয়োক্তি হয় না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জিতে তৃতীয় বারের জন্য ক্ষমতায় ফেরার দেড় মাসের মাথায় ছেলেকে বগলে নিয়ে কালীঘাটে গিয়ে তৃণমূলে প্রত্যাবর্তন করেন মুকুল। যা ছিল কার্যত মমতা ও অভিষেকের কাছে সপুত্র মুকুলের আত্মসমর্পণ। তৃণমূলে যোগদানের মুহূর্তেও মুকুল রায় ছিলেন বিজেপির সর্বভারতীয় সহসভাপতি এবং কৃষ্ণনগর উত্তর থেকে নির্বাচিত বিজেপির বিধায়ক। খাতায় কলমে মুকুল এখনও বিজেপির বিধায়ক। তৃণমূলে ফিরে বিজেপির বিধায়ক হিসেবেই বিধানসভায় পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান হয়েছেন মুকুল। যদিও তৃণমূলে ফিরে আসার পর সে’ভাবে আর সক্রিয় রাজনীতিতে দেখা যায় নি কৃষ্ণনগর উত্তরের বিধায়ককে।
সোমবার রাতে দিল্লি বিমানবন্দরের বাইরে সাংবাদিকদের কাছে মুকুল রায় যতটুকু মুখ খুলেছেন, তাতে দু-একটি বাদ দিলে বাকি কথা অসংলগ্ন মনে হয় নি। “আমি তো এখানকার এমএলএ। এখানকার এমপি”- এই কথা গুলো মুকুল ডিমেনশিয়ার প্রভাবে বলেছেন নাকি সজ্ঞানে বলেছেন- এই নিয়ে ধন্ধ পুরোপুরি কাটছে না রাজনৈতিক মহলের। তৃণমূলে ফিরে আসার পর এই ধরণের রহস্যপূর্ণ কথাবার্তা একাধিকবার বলেছেন তিনি। ‘যা তৃণমূল তাই বিজেপি’ মন্তব্য করে বিজেপি ও তৃণমূল উভয়কেই বাম-কংগ্রেসের নিশানায় ফেলে দিয়েছিলেন মুকুল। মানুষটার নাম মুকুল রায়- তাই অসুস্থ মুকুলের অন্তর্ধান ও দিল্লিতে আত্মপ্রকাশ নিয়ে এত জল্পনা। বাংলার রাজনীতিতে মুকুল দুটি কারণে বিখ্যাত- এক, রাজনৈতিক কূটকৌশল ও পর্দার পেছনে কলকাঠি নাড়ানোর খেলা; দুই, সংগঠন গড়া। তৃণমূলের সংগঠনের প্রায় পুরোটাই মুকুল রায়ের হাতে গড়া। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির চমকপ্রদ সাফল্যের পেছনে যে মুকুলের হাতযশ আছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। দীনদয়াল ভবনের ভেতরে এখনও কাঁচরাপাড়ার রায়সাহেবের যথেষ্ট খুঁটির জোর আছে বলেই খবর।
মুকুল কার ঘুঁটি?
অসুস্থ মুকুল রায়কে টানাহেঁচড়া করে দিল্লি নিয়ে যাওয়া হয়েছে নাকি তিনি স্বেচ্ছায় দিল্লি গিয়েছেন- ঘটনা এখনও স্পষ্ট নয়। নিজের হাতে গড়া দল ফেলে মুকুল রায় কেন পদ্মশিবিরে যোগ দিয়েছিলেন, সেই কারণগুলি কমবেশি সবার জানা। মুকুলের মতো ঠান্ডামাথার রাজনীতিক কেন তড়িঘড়ি মাথা নুইয়ে কালীঘাটে ফিরে গেলেন, এই নিয়েও বাজারে অনেক রকমের কানাঘুষো। মুকুল রায়ের মতো নেতা, যিনি সবসময় ঘটনার নির্ণায়ক ভুমিকায় থাকতে ভালবাসেন, তৃণমূলে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি কেন আড়ালে চলে গেলেন? নীরবে উপেক্ষা ও অপমানের বোঝা বইতে বইতেই কি মানসিক স্থিতি হারিয়ে ফেললেন চাণক্য মুকুল? মুকুল রায় নিজে ছিলেন ঘুঁটিবাজির দক্ষ খেলোয়াড়। তিনি কি নিজেই আজ অন্যের হাতে ঘুঁটি? শুভ্রাংশুর অভিযোগ, “বাবা বিজেপির নোংরা রাজনীতির শিকার।” ঘরে-বাইরে যায় যায় পরিস্থিতি সামাল দিতে মুকুলকে যে প্রভাবশালী আর কেউ দিল্লির দরবারে পাঠান নি, তাই বা কে বলতে পারে? আফটার অল, দিল্লির ক্ষমতার অলিন্দ ‘চাণক্য’ মুকুলের খুবই পরিচিত জায়গা।
Feature image is representational.