বিজেপির এই মুকুলকে দরকার নেই, তবে মুকুলের কি বিজেপিকে দরকার? - nagariknewz.com

বিজেপির এই মুকুলকে দরকার নেই, তবে মুকুলের কি বিজেপিকে দরকার?


ঘরে-বাইরে চাপ ও হুমকিই কি মুকুল রায়ের মানসিক স্থিতি নষ্ট হ‌ওয়ার অন্যতম কারণ? মুকুলের কথায় কিন্তু তেমনই ইঙ্গিত। একটি রাজনৈতিক বিশ্লেষণ-

মুকুল রায় যে অন্তরাল থেকে বেরিয়ে এসে এ’ভাবে তৃণমূলকে অপদস্থ আর বিজেপিকে বিড়ম্বনায় ফেলে এই ঘোর গরমে প্রাইম টাইমে মিডিয়ার ফুটেজ খাবেন, তা কে ভেবেছিল? কিন্তু অঘটন আজ‌ও ঘটে। সোমবার সন্ধ্যা থেকেই মিডিয়া-সোস্যাল মিডিয়া মুকুলময় এবং বাংলার রাজনৈতিক মহলে তোলপাড়। ছেলে মিসিং ডায়েরি করার কিছুক্ষণের মধ্যেই দিল্লি বিমানবন্দরে মুকুলোদয়। ভ্যানিশ মুকুলকে খুঁজে পাওয়ার সাথে সাথেই মুকুলপুত্রের করা ‘মিসিং ডায়েরির’ স্থান হ‌ওয়ার কথা থানার বাজে কাগজের ঝুড়িতে। এরপর পারলে বিজেপির বিরুদ্ধে তাঁর অসুস্থ বাপকে অপহরণ করার অভিযোগ আনেন শুভ্রাংশু রায়। স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে দিল্লি আসার দাবি করে পুত্রের সেই অভিযোগে জল ঢেলে দিয়েছেন মুকুল স্বয়ং।

তৃণমূলে ফিরে ছেলের হিল্লে হয়েছে, বাপের নয়

মুকুল রায় সুস্থ না অসুস্থ। মুকুলের মাথা বিগড়েছে না ঠিক আছে। মুকুল তৃণমূলে না বিজেপিতে- এই সব নিয়ে চারদিকে জোর জল্পনা। মুকুল দিল্লিতে বসে মুখ খুলেছেন এবং তাতে আপাতদৃষ্টিতে মুখ পুড়েছে তৃণমূলের‌ই। মুকুলের প্রসঙ্গ উঠলে বরাবরই খ্যাঁক করে ওঠেন তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ। এ’বার‌ও তার ব্যতিক্রম কিছু হয় নি। অভিষেককে বিপদে ফেলতেই অসুস্থ বাবাকে বগলদাবা করে দিল্লি নিয়ে গেছে বিজেপি- শুভ্রাংশুর এই অভিযোগ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উড়িয়ে দিয়েছেন কুণাল। একুশের বিধানসভা নির্বাচনে অমিত শাহের চাপে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই কৃষ্ণনগর উত্তর থেকে দাঁড়িয়ে বড় মার্জিনে জিতেছিলেন মুকুল রায়। বীজপুরে ছেলেকে মনোনয়ন পাইয়ে দিয়েছিলেন। যদিও বড় ব্যবধানে হেরেছিলেন শুভ্রাংশু। তৃণমূলে ফিরে মুকুলের কোন‌ও লাভ না হলেও ছেলের একটা হিল্লে হয়েছে। বীজপুর পুরসভার ভাইস চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব পেয়েছেন শুভ্রাংশু রায়। এখন দিল্লিতে বসে মুকুল ছেলেকে পরামর্শ দিচ্ছেন- নিজের ও পরিবারের ভালোর জন্য তুই‌ও বিজেপিতে চলে আয়!

মুকুলের কথায় অসংলগ্নতা আছে

শুভ্রাংশু রায় সংবাদ মাধ্যমকে বাবার রোগের যা ফিরিস্তি দিয়েছেন, সব যদি সত্যি হয় তবে মুকুলের অসুস্থতা রীতিমতো গুরুতর। পারকিনসন্স ও ডিমনেশিয়ার রোগীর পক্ষে আর যাই করা সম্ভব হোক, রাজনীতি করা সম্ভব নয়। যদিও মঙ্গলবারের পর বুধবার‌ও মুকুল রায় দাবি করেছেন, এই মুহূর্তে পুরোপুরি সুস্থ তিনি। এদিকে সংবাদ মাধ্যমকে দেওয়া মুকুলের বক্তব্যে অসংগতি ও অসংলগ্নতার ছাপ স্পষ্ট। এই অসংলগ্ন কথাবার্তা রোগের কারণে না ইচ্ছাকৃত- প্রশ্ন উঠেছে। মুকুল রায় কোনও দিন‌ই জননেতা ছিলেন না। কিন্তু রাজনৈতিক কৌশল রচনা, আড়াল থেকে প্রশাসনকে পরিচালনা ও সংগঠন তৈরি- এই তিন কাজে মুকুল রায়ের দক্ষতা প্রশ্নাতীত। মুকুল মিডিয়ার সামনে বা মঞ্চে বেফাঁস বলেছেন- এমন নজির নেই। প্রবল আশা জাগিয়েও একুশে বাংলায় বিজেপির পরাজয়ের পর মুকুল রায় দেড় মাস‌ও অপেক্ষা করেন নি। ছেলেকে বগলে নিয়ে তড়িঘড়ি কালীঘাটে গিয়ে তৃণমূলে ফেরেন। তৃণমূলে ফেরাটা যে মমতা-অভিষেকের কাছে আত্মসমর্পণের তুল্য হবে, তৃণমূলে যে তিনি আর হৃত সম্মানের জায়গা কোনও দিন‌ই ফেরত পাবেন না, তা কি ঝানু মুকুল জানতেন না? সব জেনেও স্ত্রী বিয়োগের ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই কেন মুকুল সাত তাড়াতাড়ি তৃণমূলে ফিরলেন, তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। বিজেপি থেকে তৃণমূলে ফেরার পর মুকুল রায় একাধিকবার সংবাদ মাধ্যমের সামনে এমন সব মন্তব্য করেছেন, যা তাঁর মানসিক স্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।

বিজেপির এই মুকুলকে দরকার নেই

একুশের পরাজয়ের পর মুকুলের দেখানো লাইনে দলের আর‌ও বিধায়ক এবং নেতা, যাঁরা মুকুলের প্রভাবে বিজেপিতে এসেছিলেন, তাঁরা তৃণমূলে ফিরে গেছেন। সেই ধাক্কা সামলে বাংলায় বিজেপি অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে বলা যায়। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী ও রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার মাঠঘাট চষে বেড়াচ্ছেন। বরং এখন নিয়োগ কেলেঙ্কারি সহ নানা দুর্নীতির অভিযোগে জড়িয়ে গিয়ে শাসক তৃণমূল‌ই মহা বিপাকে। দলটির এক প্রাক্তন হেভিওয়েট মন্ত্রী, তিন বিধায়ক এবং একজন মহা পরাক্রমশালী জেলা সভাপতি জেলে। নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় আরও কয়েকজন তৃণমূল বিধায়ক গ্রেফতার হতে পারেন বলে গুঞ্জন। এমনকি দলের সেকেন্ড ইন কমান্ড অভিষেককে পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়ে সিবিআই-এর জিজ্ঞাসাবাদ থেকে বাঁচতে হচ্ছে। দলত্যাগ বিরোধী আইন অনুযায়ী মুকুল রায়ের বিধায়ক পদ খারিজের দাবি মুকুল তৃণমূলে ফেরার পরের দিন থেকেই করে আসছে রাজ্য বিজেপি পরিষদীয় দল। স্পিকারের উপর ভরসা রাখতে না পেরে এই দাবিতে হাইকোর্টে মামলা পর্যন্ত করেছেন শুভেন্দু অধিকারী। মুকুল রায়কে পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান করার প্রতিবাদেও কম সরব ছিল না বিজেপি। রাজ্য রাজনীতির পরিসর থেকে প্রায় উধাও হয়ে গিয়েছিলেন মুকুল রায়। দলত্যাগ বিরোধী আইনের হাত থেকে বাঁচাতে তাঁকে খাতায়-কলমে বিজেপির বিধায়ক‌ই করে রেখেছেন স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূলের কর্মসূচি থেকেও মুকুল থাকতেন দূরে দূরে। মুকুলকে নিয়ে যে টুকু খবর মিডিয়ায় হতো, তার বেশিরভাগটাই তাঁর অসুস্থতা নিয়ে। বার কয়েক “যা তৃণমূল, তাই বিজেপি” বলেও চর্চায় এসেছেন তিনি। এহেন মুকুল রায়ের ঘর ওয়াপসিতে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে কেন উদগ্রীব হয়ে উঠবেন, তা সঙ্গত কারণেই রাজনৈতিক মহলের বোধগম্য হচ্ছে না।

চাপে পড়ে তৃণমূলে, জানালেন মুকুলই

ভারতীয় রাজনীতিতে বিভিন্ন সময়ে যাঁরা লোকমুখে ‘চাণক্য’ উপাধি পেয়েছেন, মুকুল রায় তাঁদের অন্যতম। মুকুল রায়ের রাজনৈতিক জীবন বিতর্কিত। তাঁর সততা নিয়েও অনেক প্রশ্ন। কিন্তু মুকুলের ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট, কূটকৌশল ও সংগঠন তৈরিতে দক্ষতা নিয়ে তাঁর রাজনৈতিক শত্রুদের‌ও কোন‌ও সংশয় নেই। ঘোড়েল বা ধুরন্ধর রাজনীতিক বলতে যা বোঝায়, মুকুল তাই। এ’জন্য মুকুলের অসংলগ্ন কথাবার্তাকে‌ও হালকাভাবে নিচ্ছে না রাজনৈতিক মহল। বিজেপি থেকে তৃণমূলে ফিরে যাওয়া কোন‌ও নেতার‌ই দলের ভেতরে অবস্থান শক্ত নয়। দাম বা সম্মান না পেলেও একটা পদ অথবা অন্য কোনও লোভে তৃণমূলে পড়ে আছেন অনেকে। কিন্তু মুকুল রায়ের মতো নেতার পক্ষে, যিনি নিজে হাতে তৃণমূলের সংগঠন তৈরি করেছেন, অপমান ও তাচ্ছিল্য সহ্য করে দল করা সম্ভব নয়। এই গ্লানি শরীরের পাশাপাশি মুকুলের মানসিক স্বাস্থ্যের‌ও অবনতি ঘটার একটা বড় কারণ হতে পারে। বুধবার মুকুল রায় স্বীকার‌ও করেছেন যে, মানসিক চাপের মুখে বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি।

এখন কি অপমানের বদলা চান মুকুল?

চাণক্য মুকুল যে মানসিক চাপে চাপে বিধ্বস্ত হয়ে গেছেন, তা বুঝতে এখন আর কারও কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। এই চাপের একটা উৎস যে রায়সাহেবের নিজের পরিবার, সেই ইঙ্গিত‌ও মিলতে শুরু করেছে।‌ মুকুল রায়ের কথা শুনে এখন মনে হচ্ছে, তিনি হয়তো হুমকির মুখে তৃণমূলে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন। তৃণমূলের রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশে দুর্যোগ ফের ঘনিয়ে আসছে, এটা অনুমান করতে পেরেও মুকুল বিজেপিতে ফেরার কথা ভাবতে পারেন। তিনি হয়তো সুযোগ খুঁজছিলেন মমতা-অভিষেকের দুর্দিনের। মুকুল কি কার‌ও রাজনৈতিক বিপর্যয় দেখতে চান? নাকি মুকুল বর্তমানে নেই, কেবলই সোনালি অতীতে বিচরণ করছে তাঁর স্মৃতি? মুকুলকে নিয়ে অনেক প্রশ্ন। অনেক রহস্য।

তবে মুকুল রায়ের শারীরিক ও মানসিক স্থিতি যদি সত্যিই উদ্বেগজনক হয়ে থাকে, তবে রাজনীতি নয় তাঁর পূর্ণ বিশ্রামের প্রয়োজন। এবং দিল্লিতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার আগেই বুঝিয়ে শুনিয়ে তাঁকে কলকাতায় ফেরত পাঠিয়ে দেওয়াই বিজেপির জন্য ভাল।

Feature Image is representational.


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *