আমেরিকা বুঝেছে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল রাখা তাদের দিক থেকেও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ভারত-আমেরিকা সম্পর্কের অবনতি হয়েছে নিঃসন্দেহে। কিন্তু এতটা অবনতিও হয় নি যে নয়াদিল্লিকে সমানে অগ্রাহ্য করে যাবে বাইডেন প্রশাসন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ভারতের তথাকথিত নিরপেক্ষ অবস্থানে আমেরিকা ও তার মিত্রদের গাত্রদাহ হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। কিন্তু কৌশলগত কারণেই নিজের অবস্থানে অটল থাকে মোদী সরকার। ওয়াশিংটনের তরফে চাপ ছিল। সেই চাপ সামলে নিয়েছে সাউথ ব্লক। চাপে কাজ না হওয়ার পশ্চিমী শক্তির তরফে ভারতকে খোশামোদেরও অভাব ছিল না। যাই হোক, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বছর গড়িয়ে এখনও চলছে এবং যথারীতি বাইডেন প্রশাসনকে অগ্রাহ্য করে মস্কো থেকে সস্তায় তেল কিনে যাচ্ছে ভারত।
আমেরিকাকে চটিয়েও বড় কোনও ক্ষতির মুখে পড়ে নি ভারত
ভারত-আমেরিকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে গত তিরিশ বছর যাবত উত্তরোত্তর উন্নতি ঘটেছে। এই সময়কালের মধ্যেই আমেরিকা আল-কায়দা পরিচালিত ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের লক্ষ্যে পরিণত হয়। ওয়ান-ইলেভেনের সন্ত্রাসী হামলা ঘটে। এবং চিন কার্যত সুপার পাওয়ার হয়ে ওঠে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলোপের পর ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণেই এই তিরিশ বছরে দুই গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে মিত্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বারাক ওবামার দুই দফার শাসনে ভারত-মার্কিন সম্পর্ক অভূতপূর্ব উচ্চতায় পৌঁছায়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্বভাবচরিত্র যাই হোক, ট্রাম্পের ভারতপ্রীতি নিয়ে কোনও সংশয় ছিল না। বরাবর রিপাবলিকানদের থেকে ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গেই ভারতের খাতির বেশি কিন্তু ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে এসে সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেন।
জো বাইডেন হোয়াইট হাউসে আসার আগে থেকেই পারিপার্শ্বিক কিছু কারণে সাউথ ব্লকের কূটনীতিকদের কিছুটা সংশয় ছিল, হয়তো ওবামা ও ট্রাম্প জামানার মতো আমেরিকার সঙ্গে ভারতের মাখোমাখো সম্পর্কটা বজায় থাকবে না বৃদ্ধ বাইডেন প্রেসিডেন্ট হলে। আজ ভারত-মার্কিন সম্পর্ক যে জায়গায় দাঁড়িয়ে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ না বাঁধলে এই পরিস্থিতি তৈরি হত না। বাণিজ্যিক ও প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত কিছু বিষয়ে দুই দেশে মতৈক্যের অভাব বরাবরই ছিল। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ না বাঁধলে বাইডেন জামানাতেও সে’সব কারণে ভারত-মার্কিন সম্পর্কের এতটা অবনতি ঘটত না। যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকার চাপ কিম্বা উপরোধ- কোনও কিছুতেই মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করে নি নয়াদিল্লি। ওয়াশিংটনকে চটিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে লেনদেন চালু রাখায় ভারতের বড় রকমের স্বার্থহানি ঘটেছে, এখনও পর্যন্ত তেমন প্রমাণ কিন্তু পাওয়া যায় নি। বরং যুদ্ধের সুযোগে রাশিয়া থেকে সস্তায় তেল ক্রয় ভারতকে অনেক স্বস্তি দিয়েছে। এমনকি ঘুরপথে ভারত থেকে রাশিয়ার তেল আমেরিকাও কিনেছে। গত নভেম্বরে ভারত থেকে আমেরিকা ৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পেট্রোলিয়াম জাত পণ্য আমদানি করেছে, যা মূলতঃ রাশিয়া থেকে কেনা ‘ক্রুড ওয়েল’ থেকে প্রস্তুত করা। এরই নাম অর্থনৈতিক বাস্তবতা।
রথ দেখতে এসে কলা বেচার সুযোগ বাইডেনের সামনে
মার্কিন কূটনীতিকরা ভালোই বোঝেন, কোন বাধ্যবাধকতার কারণে ওয়াশিংটনের চাপ সত্ত্বেও ভারত রাশিয়ার সঙ্গে মৈত্রী বজায় রাখে। তাঁরা এটাও ভালো বোঝেন, ভারতের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক ভাল রাখাটা আমেরিকার দিক থেকেও কম দরকারি নয়। শেষ পর্যন্ত আগামী সেপ্টেম্বরে ভারত সফরে আসতে চলেছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। আশা করা যায়, ভারত-মার্কিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে যতটুকু অবনতি হয়েছে, তা মেরামত করার একটা সুযোগ এনে দেবে বাইডেনের ভারত সফর। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সবথেকে ক্ষতি যদি কারও হয়ে থাকে তবে তা ইউক্রেন আর রাশিয়ার। আর রাশিয়ার গ্যাস থেকে বঞ্চিত হয়ে বিস্তর ভোগান্তিতে পড়েছে পশ্চিম ইউরোপ। ইউক্রেনকে অস্ত্র বেচে ভালোই রোজগার করছে আমেরিকা। আমেরিকার আসল মাথাব্যথা অবশ্যই চিন। চিনের ক্রমবর্ধমান হুমকির মুখে ভারতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলা ওয়াশিংটনের জন্য কূটনৈতিক বাধ্যবাধকতা।
এখন জি-২০ কে নেতৃত্ব দিচ্ছে ভারত। ২০২৩- এ বছর জুড়ে ভারতে জি-২০ শিখর সম্মেলন চলছে। জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন সফলভাবে আয়োজন করার জন্য ভারতের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন বাইডেন প্রশাসনের তরফে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু। সেপ্টেম্বরে ভারতে ‘জি-২০ লিডার্স সামিট’। জি-২০ সদস্যভুক্ত দেশগুলির রাষ্ট্রপ্রধানেরা ভারতে আসবেন সম্মেলনে যোগ দিতে। জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন মিস করার মতো বোকামি আমেরিকা করে না। সম্মেলনে যোগ দিতে ভারতে আসছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ‘জি-২০ লিডার্স সামিট’ নিঃসন্দেহে একটা ‘মেগা ইন্টারন্যাশনাল ইভেন্ট’। সেখানে আমেরিকার স্বার্থ সামাল দেওয়া বাইডেনের বড় দায়িত্ব। কিন্তু সম্মেলনের ফাঁকে স্বাগতিক দেশের সঙ্গে ফাঁক-ফোকরগুলি বুজিয়ে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ঝালিয়ে নেওয়ার সুযোগটিও বাইডেন যে হাতছাড়া করবেন না, ডোনাল্ড লুয়ের বক্তব্যেই তা সুস্পষ্ট।
আত্মবিশ্বাসী ভারতকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়
ডোনাল্ড লু বলেছেন, “আমি জানি, আমাদের প্রেসিডেন্ট সেপ্টেম্বরে ভারত সফরে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন। ‘জি-২০ লিডার্স সামিটে’ অংশ নিতে এটাই তাঁর প্রথম ভারত সফর হতে চলেছে। আগামীদিনে আরও যা যা ঘটবে, সেইসব কথা ভেবে আমরা এখন থেকেই রোমাঞ্চ অনুভব করছি।” একটি শক্তিশালী স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের পররাষ্ট্রনীতির মূলকথা, নিজের ভাল বুঝে পদক্ষেপ করা। আমেরিকার সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ হওয়ার পরেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে নয়াদিল্লি নিজের পথে চলেছে। আমেরিকাকে চটিয়েও ভারত রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেন চালিয়ে যাচ্ছে এবং রাশিয়ার সঙ্গে যাতে লেনদেন ঠিকঠাক থাকে, এই কারণেই আন্তর্জাতিক মঞ্চে, জাতিসংঘে যুদ্ধের প্রশ্নে ভারত নিরপেক্ষ নীতি নিয়ে চলছে। এই নিরপেক্ষতা যে রাশিয়ার পাশে থাকার সামিল, তা বুঝতে কারও অসুবিধা হচ্ছে না। কিন্তু তাতে ভারতের বড় যায় আসে না। এ’রকম একটা জটিল আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে বৃহৎ শক্তির চাপ উপেক্ষা করেও নিজের নীতিতেই অটল থেকে ভারত প্রমাণ করে দিচ্ছে এই ভারত আত্মবিশ্বাসী ভারত। আত্মবিশ্বাসী ভারতকে উপেক্ষা করার শক্তি আমেরিকার নেই।
Feature Image is representational.