আগের আমলেও নেতারা চাকরি দিতেন কিন্তু এই আমলে চাকরি কিনতে হয়। তিন আমল নিরীক্ষণ করে লিখলেন উত্তম দেব-
চাকরি শব্দটা ফারসি। চাকর থেকে এসেছে। চাকরের যা কাজ তাই যে চাকরি তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কোনও অফিস বা কারখানায় বেতনের বিনিময়ে নিয়মিত কাজ করার দায়িত্বকে চাকরি বলেছে সংসদ বাংলা অভিধান। চাকরের একটা সুন্দর তৎসম নাম আছে- কিঙ্কর। একটি অনলাইন অভিধানে দেখলাম চাকরির অর্থ করা হয়েছে কিঙ্করত্ব। অর্থাৎ সরকারি চাকরিকে সরকারি কিঙ্করত্ব বলা যেতে পারে। হিন্দিভাষীরা বলেন ‘সরকারি নোকরি’। চাকরের আরেক নাম নোকর, হিব্রু ‘নৌকর’ থেকে এসেছে। নোকরের কাজ নোকরি। চাকরি জিনিসটার সঙ্গেই তদ্বির বা ধরাধরির একটা যোগাযোগ আছে। সাহেবসুবোকে ধরাধরি বা উমেদারি না করলে চাকরি পাওয়া যায় না, এই মহৎ উপলব্ধি তো উনবিংশ শতকেই বাঙালির হয়েছিল। যেদিন থেকে সাহেবের সওদাগরি দফতরে চাকরির দরজা খুলে গেল, সেদিন থেকে অন্যকে চাকরগিরি বা চাকরি দেওয়ার চাইতে নিজে অন্যের চাকরগিরি বা চাকরি করাতেই বাঙালি মধ্যবিত্তের অধিক আগ্রহ তৈরি হল। সে যুগে জনসন সাহেবের সওদাগরি আপিসের চাকরি থেকে আজকের যুগের সরকারি চাকরি- চাকরি পেলে আর কি চাই বাঙালির।
সরকারি চাকরিতে নিয়োগ নিয়ে ঝামেলায় এখন পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে তোলপাড় অবস্থা। প্রাথমিক ও স্কুল সার্ভিস কমিশনের নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় ফেঁসে গিয়ে রাজ্য সরকার এবং রাজ্যের শাসকদল রোজই লেজেগোবরে হচ্ছে। মানুষের উপর্যুপরি কটাক্ষে ক্ষেপে লাল সরকারের শিক্ষামন্ত্রী থেকে শাসকদলের প্রগল্ভ মুখপাত্র এখন বলছেন- চাকরি দিতে গিয়ে দুর্নীতি আমরাই প্রথম শুরু করি নাই, বামফ্রন্ট সরকারও সাধু ছিল না। এই সরকারের আমলে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগে আদালতে একাধিক মামলা হয়েছে। মামলা চলাকালে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। কোর্টের নির্দেশেই সেই তদন্তের ভার ন্যস্ত হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের এজেন্সি সিবিআই-ইডির উপরে। বাংলায় বাম রাজত্বের অবসান হয়েছে ১২ বছর আগে। ১৯৭৭ থেকে ২০১১- চৌত্রিশ বছরের বাম আমলে চাকরি নিয়ে কী পরিমাণ অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে, এই আমলে তার অনুসন্ধান হবে কীভাবে?
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার চাইলে কোনও প্রাক্তন বিচারপতিকে দিয়ে তদন্ত কমিশন গঠন করতে পারে। নতুবা দুর্নীতির কারণে চাকরি থেকে বঞ্চিতরা আদালতে মামলা ঠুকতে পারেন। মুশকিল একটাই, বঞ্চিতদের সিংহভাগের চাকরির বয়স তো গেছেই অনেকের হয়তো পৃথিবীতে থাকার মেয়াদও ফুরিয়ে গেছে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মুখ্যমন্ত্রীত্বের ভবিতব্য যখন নির্ধারণ হয়ে গেছে, সেই শেষ লগ্নে প্রাথমিক শিক্ষকের নিয়োগ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগে কয়েকটি জেলায় জনগণের মধ্যে কিছু অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছিল। এটা বাদ দিলে ৩৪ বছরের মধ্যে বামফ্রন্ট সরকারকে নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগে মামলা-মোকদ্দমায় জেরবার হতে হয় নি। পড়তে হয় নি বড় কোনও গণরোষের মুখেও, যেমনটি পড়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। তা সিপিএমের নেতারা কি চাকরি দিতেন না ? নিয়োগ প্রক্রিয়ায় প্রভাব খাটাতেন না?
চাকরি নেতারা দিতেন, দিতেন আধিকারিকেরাও
এই দেশে রুলিং পার্টির নেতার সুপারিশে চাকরি লাভ, টেন্ডার জেতা, হাসপাতালে বেড পাওয়া এমনকি পুলিশের কেস থেকে খালাস কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। মন্ত্রী এবং সরকারি পার্টির সাংসদ-বিধায়কদের বাড়িতে রোজ সকালে দর্শনার্থীদের ভিড় এমনি এমনি হয় না। এই তিন-চারটে কাজ করার ক্ষমতা না থাকলে আবার রুলিং পার্টির নেতা কীসের? শুধু রাজনৈতিক নেতাদেরই নয় আমজনতার মনোভাবটাও এমনই। বাম আমলে বাম নেতারা চাকরি দিয়েছেন। সাতাত্তরের আগে কংগ্রেসের নেতারাও। এমন একটা যুগ গেছে, যখন সরকারি দফতরের উচ্চ পদস্থ আধিকারিকেরাও দু’চারজনের চাকরির ব্যবস্থা করে দিতেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বহু দিন পর্যন্ত সরকারি দফতরগুলিতে করণিক ও চতুর্থ শ্রেণীর পদে নিয়োগ হত স্থানীয় পর্যায়ে। এমনকি কেন্দ্রীয় সরকারের দফতরেও। স্টাফ সিলেকশন কমিশন গঠিত হয় ১৯৭৫ সালে। তার আগে ইনকাম ট্যাক্স, কাস্টমস, ডাক ও তার সহ কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন দফতরে স্থানীয় পর্যায়ে কর্মী নিয়োগ করা হত। সেই সব নিয়োগে নিয়মের কড়াকড়ি ছিল না। দূর সম্পর্কের অফিসার মামা অনুকম্পা বশত দুস্থ ভাগিনাকে চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন- বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজে এমন ঘটনা বিরল এবং অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। প্রভাবশালী অফিসার পাড়ার দু’চারজন বেকার ছেলেকেও ডেকে নিজের দফতরে চাকরি জুটিয়ে দিতেন। বহু বাঙালি পিতা অবসরে যাওয়ার আগে বড় সাহেবকে বলেকয়ে নিজের জ্যেষ্ঠ পুত্রটিকে দফতরে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এখন সরকারি দফতরে গ্রুপ ডি বা চতুর্থ শ্রেণীর চাকরির জন্যেও কত কাড়াকাড়ি। আগে গ্রুপ ডি-র চাকরির প্রায় সবটাই ছিল দয়া-দাক্ষিণ্য প্রসূত। অফিসারকে একটু ধরাধরি করেই সেই চাকরি পাওয়া যেত।
কংগ্রেস নেতারা চাকরি দিতেন কিন্তু টাকা নিতেন না
বাম জামানায় সিপিএমের নেতাদের মুখে অভিযোগ শুনতাম- সিদ্ধার্থশংকর রায়ের আমলে কংগ্রেসের নেতারা সিগারেটের খাপে লিখে চাকরি দিতেন। তাদের আমলে চাকরি খুব শুদ্ধভাবে হয়, তা বোঝাতেই ভোটের সময় বক্তৃতায় এই অভিযোগ করতেন সিপিএম নেতারা। চিরকুটে কিম্বা সিগারেটের খাপে চাকরির কথাটা মূলতঃ সিপিএমেরই তোলা, যা আজ সিপিএমের বিরুদ্ধে বলতে শোনা যাচ্ছে তৃণমূলের নেতাদের। আসলে ষাট-সত্তরের দশকে রুলিং পার্টির প্রভাবশালী নেতারা বলেকয়ে দিলে চাকরি হয়ে যেত। কিন্তু তাঁরা টাকা নিয়ে চাকরি দিতেন- এই অভিযোগ ছিল না। তখন সরকারি চাকরিতে সামান্য বেতন, যা দিয়ে কোনও রকমে খাওয়া-পরা চলত। ষাট-সত্তরের দশকে মধ্যবিত্তের হাতে অতো টাকাই বা কোথায় যে একটা চাকরির জন্য লক্ষ টাকা ঘুষ দেবে। অভাবী মানুষ চাকরির জন্য নেতাদের গিয়ে ধরত, অনুনয় করত। নেতারা কোনও একটা সরকারি দফতরে চাকরির ব্যবস্থা করে দিতেন। সাধারণত ইন্টারভিউয়ের আগে দফতরের প্রধানের কাছে যে চাকরিপ্রার্থীর নামে নেতার সুপারিশ যেত, তারই চাকরি হত। সেই আমলে কংগ্রেসের নেতারা অনুকম্পা দেখিয়ে কাউকে চাকরি পাইয়ে দিয়ে হয়তো তার আনুগত্য অর্জন করতে চাইতেন কিন্তু টাকা খাওয়ার কথা ভাবতেন না।
ষাটের দশকে জলপাইগুড়ি জেলায় কংগ্রেসের এক বিশিষ্ট নেতা ছিলেন, যিনি চাকরিপ্রার্থী কাউকে পারতপক্ষে খালি হাতে তাঁর দুয়ার থেকে ফেরাতেন না বলে শুনেছি। তাঁর মাধ্যমে সরকারি দফতরে কিম্বা প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পাওয়া অনেককেই দেখেছি আশেপাশে এবং পরিচিত মহলে। পরে সংগঠন কংগ্রেস ও সাতাত্তরে জনতা পার্টিতে যোগ দেওয়া সেই নেতার বাড়িতে এজেন্সির লোকেদের কারেন্সি গোনার মেশিন নিয়ে কখনও হাজির হতে হয় নি। এরকম চাকরিদাতা নেতা বাংলার জেলায় জেলায় ছিলেন। রেলমন্ত্রী থাকাকালীন কোতয়ালির বাড়িতে বসে মালদহের কম লোকের চাকরি করে দেন নি গণিখান চৌধুরী। গণিখানের নামে অনেক ভালমন্দ কথা শোনা যায় কিন্তু গণি চাকরি দিয়ে টাকা কামিয়েছেন, এই অপবাদ কেউ দিতে পারবে না।
বামেদের নিয়োগ নীতি: নিয়ম বজায় রেখে অনিয়ম কর
এ’বার বাম জামানায় আসা যাক। বামেদের ৩৪ বছরের দীর্ঘ শাসনে চাকরির বাজারে একটু একটু করে পরিবর্তন আসে। বামেরা ক্ষমতায় আসার আগেই কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি স্টাফ সিলেকশন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ১৯৭৯ সালে ওয়েস্ট বেঙ্গল কলেজ সার্ভিস কমিশন চালু করে বামফ্রন্ট সরকার। ১৯৮১ সাল থেকে কলেজ সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়। যদিও কলেজ সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে অধ্যাপক নিয়োগের প্রক্রিয়া পুরোপুরি স্বচ্ছ ছিল, এই দাবি হয়তো বাম শিবির থেকেও উঠবে না। আবার বামেদের অনুগত নয়, এমন কারও কলেজে অধ্যাপনার চাকরি মেলে নি- এই অভিযোগও তোলার সুযোগ নেই।
১৯৯৭ সালে বিধানসভায় স্কুল সার্ভিস কমিশন অ্যাক্ট পাশ করে জ্যোতি বসুর সরকার। ৯৮ থেকে স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমেই হাই ও হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলগুলিতে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়। তার আগে স্কুলে শিক্ষকদের নিয়োগ হত গভর্নিং বডির মাধ্যমে। এই পদ্ধতিতে নিজেদের পছন্দের লোক ঢোকানোর সুযোগ ছিল এবং বামেরা তা করেছেও। জেলায় জেলায় দলের ছেলেমেয়েদের চাকরি হয়েছে। সিপিএমের জেলা কমিটির সম্পাদক বা অন্য প্রভাবশালী নেতা বা শিক্ষক সংগঠনের নেতার সুপারিশে চাকরি হয়েছে। আড়াল থেকে সুপারিশ কার্যকর হয়েছে কিন্তু নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নিয়মের ব্যত্যয় হয় নি। এই মেকানিজমটা আলিমুদ্দিনের নেতারা জানতেন। যে কোনও ধরণের নিয়োগের ক্ষেত্রেই পাইকারি হারে বেনিয়ম করা থেকে বিরত থাকতেন সিপিএম নেতৃত্ব। ঘোর বাম জামানায় অনেক কট্টর বাম বিরোধী শিক্ষকও গভর্নিং বডির মাধ্যমেই চাকরি পেয়েছেন। বহু ক্ষেত্রে বামপন্থী গভর্নিং বডিও তাঁদের চাকরি পাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি। আমার স্কুল জীবনে এমন অনেক শিক্ষককে পেয়েছি, যাঁরা পাঁড় কংগ্রেসী কিন্তু চাকরি পেয়েছেন সিপিএমের আমলেই।
পার্টির জন্য খাটলে চাকরি পেত ক্যাডাররা
সিপিএমের লক্ষ্য থাকত, প্রত্যেক বছর দলের ক্যাডারদের, যারা নিয়মিত পার্টির মিটিং-মিছিল করত, পোস্টার মারত, দেওয়াল লিখত, তাদের একটি অংশের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া। পার্টির সর্বক্ষণের কর্মীদের স্ত্রীদেরও একটা হিল্লে হয়ে যেত। হাইস্কুল -কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রুপ সি, গ্রুপ ডি পদে কর্মী নিয়োগের সময় পার্টি সব থেকে বেশি সুযোগ নিত। এই সমস্ত নিয়োগ হত গভর্নিং বডির মাধ্যমেই। বেশি লোক জানাজানিও হত না। পার্টির কোন কোন ক্যাডারকে বা কোন ক্যাডারের বাড়ির লোককে চাকরি দেওয়া হবে, তা পার্টির ভেতরে আগেই ঠিক হয়ে যেত। এ নিয়ে চাকরিপ্রার্থী ক্যাডারদের মধ্যে নেতা ধরাধরি চলত। লবিরও একটা ব্যাপার ছিল। কেউ চাকরি পেত। কেউ কেউ বঞ্চিত হত। যারা নিয়োগ পেত না, তারা পার্টির অভ্যন্তরে, লোকাল কমিটির বৈঠকে ক্ষোভ উগড়ে দিত- এত মিটিং-মিছিল করি। তবুও আমার হল না। অমুকে তো ঘরে বসে থাকে। ডাকলেও মিছিলে আসে না। তার চাকরি হয়ে গেল! পরবর্তী কোনও নিয়োগে চাকরির আশ্বাস দিয়ে এই ধরণের ক্ষুব্ধ- অসন্তুষ্ট ক্যাডারদের শান্ত করতেন নেতৃত্ব। হয়তো পরের বছর চাকরি হয়েও যেত।
সিপিএমের লক্ষ্য ছিল চাকরি দিয়ে দলের প্রতি আনুগত্য ধরে রাখা। দলের ক্যাডারকে বা ক্যাডারের বাড়ির লোককে চাকরি করে দিয়ে সিপিএমের নেতারা টাকা খেতেন না। সেই সুযোগও ছিল না। কেন না, রেজিমেন্টেড সিপিএমে কম-বেশি সমস্ত ঘটনাই আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের মুজফ্ফর আহমেদ ভবনের নজরদারির মধ্যে থাকত। পার্টি অর্থাৎ সিপিএম করলে চাকরি পাওয়া যায়, এই রকম কথা আশীর দশক থেকেই বঙ্গীয় সমাজে ছড়িয়ে পড়েছিল। বহু যুবক-যুবতী পাশ দিয়ে বেরোনোর পর শুধু চাকরি পাওয়ার প্রত্যাশাতেই সিপিএম বা বামফ্রন্টের অন্য কোনও শরিক দলের মিছিলে হাঁটতে যেত। অনেক সিপিএম ক্যাডারকেই চাকরি পাওয়ার পর ধীরে ধীরে দলের কাজ কমিয়ে দিয়ে শেষে একদম বসে যেতে দেখেছি বাম জামানাতেই। এগারোতে বাংলায় পরিবর্তন এলে সবার আগে বামের ধড়াচূড়া তাদেরকেই ত্যাগ করতে দেখেছি, যারা লাল ঝান্ডার মিছিলে হেঁটে, সিপিএমের স্লোগান হেঁকে চাকরি বাগিয়ে ছিলেন। অর্থাৎ চাকরির দিয়েও শেষ পর্যন্ত কর্মী-সমর্থকদের দলের প্রতি অনুগত রাখতে পারে নি সিপিএম।
বাম আমলে এসএসসি-র বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ওঠে নি
তবে হাইস্কুলে শিক্ষকের চাকরি পেতে টাকা লেনদেনের একটা চল বাম আমলেই শুরু হয়েছিল। স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগে বেশ কয়েক বছর অনেক জায়গায় গভর্নিং বডি টাকা বিনা চাকরি ছাড়ত না। সে’সময় ১৪-১৫ লক্ষ টাকা ঘুষ কল্পনাতীত ব্যাপার ছিল। তবে এক-দুই লক্ষ টাকায় রফা হত। এই ধরণের ঘটনা বাড়তে থাকায় শিক্ষক নিয়োগে একটা স্বচ্ছতা আনার তাগিদ থেকেই স্কুল সার্ভিস কমিশন গঠন করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। ১৯৯৮ থেকে ২০১০- এসএসসি-র মাধ্যমে রাজ্যে প্রচুর ছেলেমেয়ের চাকরি হয়েছে। প্রায় প্রত্যেক বছর পরীক্ষা ও রিজিয়ন ভিত্তিক নিয়োগ হত। মেধা তালিকা তৈরি করার সময় কারসাজি যে করা হত না তা নয়। কিন্তু সিপিএম ততটা জলও মেশাতো না, যতটা মেশালে পাইকারি হারে যোগ্যদের বঞ্চিত করতে হয়। বাম জামানায় স্কুল সার্ভিস কমিশনের নিয়োগ প্রক্রিয়াকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আদালতে মামলা হয়েছিল বলে শুনি নি। কারণ, চাকরিপ্রার্থীদের তরফে বড় ধরণের কোনও অভিযোগ ছিল না।
স্থানীয় নিয়োগে নিজেদের লোক ঢোকাতো সিপিএম
ওয়েস্ট বেঙ্গল পাবলিক সার্ভিস কমিশন বা পিএসসির মাধ্যমে বাম আমলে যে নিয়োগ হত, সেসব নিয়ে অস্বচ্ছতার অভিযোগ ওঠার সুযোগ ছিল না। পিএসসি-র ক্লার্কশিপের পরীক্ষা বেশ কঠিন ছিল। কিন্তু প্রত্যেক বছর পরীক্ষা হত এবং ভাল সংখ্যায় লোয়ার ডিভিশন অ্যাসিস্টেন্ট পদে কর্মী নিয়োগ হত। ছেলেমেয়েদের মধ্যে যারা পড়ালেখায় একটু ভাল তদুপরি প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষার পড়ায় যথেষ্ট পরিশ্রমী, তাদের জন্য সৎভাবে সরকারি চাকরি পাওয়ার দরজা ছিল পিএসসি ক্লার্কশিপ। কিন্তু গ্রুপ সি পদের যে নিয়োগগুলি পিএসসির বাইরে স্থানীয় পর্যায়ে হত, সেখানে পার্টির হস্তক্ষেপ ঘটত, ধরাধরি চলত ক্ষেত্র বিশেষে টাকাপয়সার লেনদেনও। বাম জামানায় জেলা শাসকের দফতরে স্থানীয় পর্যায়ে অনেক নিয়োগ হত। এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে বাড়িতে কল লেটার আসত। যদিও এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ খুব একটা সুবিধার জায়গা ছিল না। চাকরিপ্রার্থীদের কল পাওয়া না পাওয়া নিয়ে এক্সচেঞ্জের আধিকারিকেরা নানারকম সেটিংয়ে জড়িত থাকতেন বলে শোরগোল উঠত। এই সমস্ত নিয়োগের সময় শাসকদলের নেতারা যেমন প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের লোক ঢোকাতেন তেমনি দু’একজন খাতিরের লোককে চাকরিতে ঢুকিয়ে দিতে পারতেন জেলা শাসকেরাও।
বামফ্রন্ট সরকারের আমলে সিপিএম নিঃশব্দে দলের কর্মীদের সবথেকে বেশি ঢুকিয়েছে গ্রন্থাগার দফতরে। গত শতাব্দীর আশীর দশকে রাজ্য জুড়ে পাড়ায় পাড়ায় রুরাল লাইব্রেরি বা পল্লী পাঠাগার স্থাপন করে সরকার। ক্লাব বা বেসরকারি সংস্থা পরিচালিত পাঠাগারগুলিকেও গ্রন্থাগার দফতরের আওতায় আনা হয়। প্রতিটি পাঠাগারে দু-তিনজনের চাকরির ব্যবস্থা হয়। পল্লী পাঠাগারগুলিতে দলের ছেলেমেয়েদের বসাতে অসুবিধা হয় নি সিপিএম নেতৃত্বের। বাম আমলে বামফ্রন্টের যে শরিক যে দফতরের মন্ত্রীত্ব পেত সেই দফতরে সেই শরিকের লোকেরা বেশি বেশি চাকরি পেত। অনেক দিন পর্যন্ত স্বাস্থ্য দফতর ছিল আরএসপির হাতে। যতদিন স্বাস্থ্য দফতর আরএসপির হাতে ছিল, ততদিন সরকারি হাসপাতালগুলির তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী পদে আরএসপির লোক বেশি ঢুকত। সেই সময় স্বাস্থ্য দফতরে আরএসপি প্রভাবিত কর্মচারী সংগঠন জয়েন্ট কাউন্সিলের প্রভাব বেশি ছিল। কারা ও পূর্ত দফতর বরাবরই শরিক আরএসপির উপরে ছেড়ে রেখেছিল সিপিএম। এই দুই দফতরে কর্মী নিয়োগের সময় আরএসপির প্রাধান্য থাকত। দফতর হাতে থাকায় কৃষি, কৃষি বিপণন ও জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরে দলের লোকদের চাকরি বেশি দিতে পারত ফরওয়ার্ড ব্লক।
প্রাথমিকের নিয়োগে হিসেব করে পা ফেলত বামেরা
যে কোনও রাজ্য সরকারের সামনে সব থেকে বেশি চাকরি সৃষ্টির সুযোগ থাকে প্রাথমিক শিক্ষায়। সাতাত্তরে ক্ষমতায় এসেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ছাড়ে নি সিপিএম। বছরে বছরে লোক নিয়েছে প্রাথমিকে। সাতাত্তর থেকে সাতাশি- এক দশক পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মধ্যবিত্ত মানস মোটের উপর ছিল সিপিএমে অভিভূত। সিপিএমের লোক চাকরি পাবে কিম্বা চাকরি পাওয়ার জন্য সিপিএম করতে হবে অথবা সিপিএমের নেতাকে গিয়ে ধরতে হবে- এ’সবের মধ্যে সমাজের অধিকাংশ মানুষ কোনও দোষ বা গ্লানি খুঁজে পেতেন না। ফলে এই দশ বছর সিপিএম স্বচ্ছন্দে, বিনা বাধায় এবং নির্দ্ধিধায় নিজের ক্যাডারকে, হোলটাইমার ক্যাডারের বউকে-বোনকে-ভাইকে প্রাইমারিতে চাকরি দিয়েছে।
সিপিএমের আমলে প্রাথমিকে নিয়োগ হত জেলা ভিত্তিক এবং নিয়োগ প্রক্রিয়া পরিচালনা করত জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদ (ডিপিএসসি)। ডিপিএসসিগুলির মাথায় বসানো হত সিপিএমের ঘাঘু নেতাদের। তাঁরা সাতপাঁচ ভেবে পদক্ষেপ করতেন এবং বিরোধী দলের নেতাদেরও ম্যানেজ করে চলতেন। প্রাথমিকে নিয়োগের ক্ষেত্রে এক পর্যায়ে আলিমুদ্দিনে বসে অনিল বিশ্বাস বিরোধীদের জন্যও কোটা বেঁধে দেন। নিয়োগের আগে বিরোধী নেতাদের কাছে বার্তা যেত, আপনারা কাদের নাম রিকমেনড করতে চান। মেধা তালিকা বা চাকরিপ্রার্থীদের প্যানেলের ব্যালেন্স বা ভারসাম্যে বিঘ্ন না ঘটিয়ে কাজের কাজটি চুপচাপ সেরে ফেলার মধ্যেই ছিল পাকা মাথার বাম নেতাদের মুনশিয়ানা। এই সব নানাবিধ কারণে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের মতো এত বিরাট কর্মযজ্ঞে নেমে বামফ্রন্ট সরকারকে কখনও বিব্রত হতে হয় নি বাম রাজত্বের একেবারে শেষ দিকে ২০১০-এর নিয়োগ পর্বটি ছাড়া। বামফ্রন্ট ক্ষমতা হারানোর ১২ বছর পরে এই ঘোর তৃণমূল জামানাতেও পশ্চিমবঙ্গে যত প্রাথমিক শিক্ষক আছেন, তাঁদের ৭৫ শতাংশই নিয়োগপত্র পেয়েছেন বাম আমলে।
নিয়োগ কীসের? চাকরি কিনে চাকরি কর
কংগ্রেস ও বাম জামানার নিয়োগ নিয়ে সাতকাহনের পর বাকি থাকে বর্তমান জামানা। রোজ মিডিয়ায় যা বেরোচ্ছে তাতে ঘটমান বর্তমান নিয়ে অধিক শব্দ খরচের আর প্রয়োজন নেই। শুধু এ’টুকু বলাই যথেষ্ট, চাকরিতে নিয়োগের ব্যাপার থাকলে তবে না নিয়ম-অনিয়মের প্রশ্ন উঠে। পরিবর্তনের বাংলায় চাকরি বেচাকেনা হয়েছে, নিয়োগের কোনও ঝামেলাই রাখেন নি পার্থ-মানিকরা। এই সরকার যে সিস্টেমটা বের করেছে তার মূল কথা- চাকরি চাও? চাকরি কিনে চাকরি নাও। নো উমেদারি। নো ধরাধরি। মাল ফেলো চাকরি তোলো। অনলি মাটি ম্যাটারস। চাকরি শুধু মাত্র অর্থের ব্যাপার। ও মেধাটেধা কিস্যু নয়। দোষ মানুষেরই। চাকরি বেচাকেনার ভরা বাজারে মানুষ শুধু শুধু মুফতে চাকরি চেয়ে সরকারকে বিড়ম্বনায় ফেলে কোন আক্কেলে।
Feature Image is Representational. Photo- Collected.