অবশেষে পাঠান রিলিজের ২০দিন পর দেখার সুযোগ এল। ২০দিন পরেও ‘হল’ প্রায় ‘ফুল’ বলা যায়। পেছনের দিকে সিট পেতে দুদিন আগে টিকিট কেটে রাখতে হয়েছিল। তাহলেই বুঝতে পারছেন শাহরুখ অনেক দিন পর আবার তার জাত চেনাতে যে এসেছে সে’খবর আর গোপন নেই। সে যে ‘কিং খান’ এবং এখনও যে রাজাই আছে তা ‘পাঠান’ প্রমাণ করে দিয়েছে। ১৪৬ মিনিটের সিনেমার প্রায় সমস্তটা জুড়েই স্ক্রিন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ৫৭ বছরের লোকটা। আর আমরা নতুন করে চিনছি আরেক শাহরুখকে।
আমি ও মা বহুবছর অবধি শাহরুখের ফ্যান ছিলাম। সব সিনেমা ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো দেখতাম। ২০১১ সালে ‘রাওয়ান’ দেখে এতটাই বিরক্ত হয়েছিলাম যে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আর যাব না শাহরুখের সিনেমা দেখতে। বহুদিন বয়কট-ও করেছি। পরে টিভিতে চেন্নাই এক্সপ্রেস দেখে হাত কামড়েছি। তারপরেও যাওয়া হয়নি বহুদিন। ২০১১র পর গেলাম ২০১৬তে ‘ডিয়ার জিন্দেগি’ দেখতে। আবার ভাল লাগল। ঠিক করে ফেললাম এই ধরনের চরিত্র করলে দেখব, নয় তো নয়। ২০২৩ এ প্রতিজ্ঞা ভাঙলাম। পাঠান দেখার লোভ সামলাতে না পেরে গেলাম। আদৌ কি ঠকলাম? ঠিক বুঝলাম না।
কেন, সেটা বলি। যদি সিনেমা নয় শাহরুখকে দেখতে যান তবে আপনি মুগ্ধ হবেনই আমার মতো। যদি দীপিকার অভিনয় দেখতে চান বিস্মিত হবেনই। আমি হলফ করে বলতে পারি “বেশরম রঙ” গানের যা স্টেপ তা অন্যকেউ হলে ছড়িয়ে লাট করতো। মিমের বন্যা বয়ে যেতো। কিন্তু এই জন্য আমি মুগ্ধ নই। মুগ্ধ দীপিকা যেভাবে ফাইট করেছে। মারপিটের দৃশ্যে মহিলাদের এতটা পারফেক্ট খুব কম দেখা যায়। যদিও চাঁদনিচক টু চায়নাতেই দীপিকা দেখিয়ে দিয়েছিলেন, এ’সব দৃশ্য নির্মাণে কতটা পারদর্শী তিনি। এবং পাঠান সিনেমায় মারপিট দৃশ্যে দীপিকার স্টেপগুলো অনেকক্ষেত্রেই চাঁদনি চক টু চায়নার কপি।
অন্য সিনেমার প্রসঙ্গ যখন এলোই তখন বলি, গল্প বা প্লটের দিক থেকে পাঠান একটা খিচুড়ি সিনেমা। পোলাও হবার সমস্ত উপকরণ ছিল তাও শেষপর্যন্ত খিচুড়িই। না খিচুড়ি খারাপ নয় খুবই উপাদেয় এবং স্বাস্থ্যকর। পোলাও-এর থেকেও। পাঠানে আছে ‘ম্যা হু না’ র ভিলেন সুনীল শেঠী জন আব্রাহামের আধারে। কিন্তু ভিলেনের মন এক্কেবারে কৃষ ৩-র বিবেক ওবেরয়ের মতো। মানে পাঠান সিনেমার ভিলেন ম্যা হু নার ভিলেনের মতো গোঁসা হওয়া এক্স আর্মি অফিসার। প্রতিশোধ নিচ্ছে কৃষ-৩ এর ভিলেনের মতো ভাইরাস ছড়িয়ে।
ভাইরাস চুরি করতে হবে রাশিয়া থেকে। যেখানে আছে সেই আলমারি খোলা হল একদম হ্যাপি নিউ ইয়ার সিনেমার চুরির স্টাইলকে কপি করে। পাশাপাশি ধুম সিনেমার কথাও বলতে হয়। পালানোর দৃশ্য ধুমের কপি। হলিউডের থেকে পার্ট প্লট, অ্যাকশন এমনকি ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক সব নানা জায়গা থেকে টুকরো টুকরো কপি করে সুন্দর ভাবে একটা জায়গায় এনে পরিবেশন করা হয়েছে।
কপি পেস্টের পাশাপাশি রয়েছে ভরপুর দেশপ্রেম। এখন দেশপ্রেম দেখানোর প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে হিন্দি বলা। বাংলাপক্ষ স্টাইলে কিছু ভারতপক্ষ জন্মেছে। যারা মনে করে ভারতীয় হতে গেলে হিন্দিতে বলতে হবে। শাহরুখ ও তার সিনেমার লোকজন এটা ভালো করেই বুঝেছে। শাহরুখের ডায়লগ শুরুই হচ্ছে, “হিন্দি মে বোল। আরবি মে গালি দে নে মে ভি মজা নেহি আয়েগা”…. আর এখান থেকেই শুরু ভারতপক্ষ তথা স্বঘোষিত দেশপ্রেমিকদের খুশি করার যাত্রা। কথায় কথায় ” ইয়ে মেরে বতন কে লোগো” ব্যাকগ্রাউন্ডে বেজে যাচ্ছে, ভারত মায়ের সন্তান বলে ঘোষণা চলছে। পরিবার নিয়ে জানতে চাইলে শাহরুখ বলছে, “দেশ নে মেরি পরবারিস কি” এবং জয় হিন্দের বন্যা। তারপরেও স্বঘোষিত দেশপ্রেমিকরা এই সিনেমা বয়কটের ডাক দিয়ে নিজেদের দেশপ্রেমের গায়ে কালি কেন লাগাতে চাইল, সেটাই মাথায় ঢুকল না।
এই দেশপ্রেমিকদের খুশি করতে আর একটা ধামাকা ঘটনা আছে। এই দেশপ্রেমিকরা মনে করে সন্তান জন্ম দেওয়াতেই স্ত্রীর সার্থকতা। তাই স্বামীসহ গর্ভবতী নারী এদের চোখে খুব সম্মানীয়া। সিনেমায় জন আব্রাহামকে জাস্টিফাই করতে দেখানো হল জনের গর্ভবতী স্ত্রীকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে তাই জন ভিলেন হয়েছে। সিনটা দেখে মনে হলো জনের বৌ গর্ভবতী না হলে তাঁকে মারলে কিছু হতো না।
তবু সব মিলিয়ে পাঠান একটা সহজপাচ্য মশালাদার সিনেমা। এই সিনেমার আর একটা বেস্ট ব্যাপার হল, একটা সিনেমার মধ্যে দিয়ে প্রায় অর্ধেক বিশ্ব দর্শন হয়ে যাবে। ভারতের পাশাপাশি আফ্রিকা, স্পেন, দুবাই, স্পেন, রাশিয়া, ফ্রান্স এবং সিনেমার নাম সার্থক করার জন্য আফগানিস্তান খানিক হলেও দেখা হয়ে যাবে। যাই হোক, এতদিনে সবাই পাঠান সিনেমার গল্প জেনে গেছেন, তাও আমি জাস্ট দু’লাইনে বলে দিচ্ছি। অনাথ বালক পাঠান (শাহরুখ) র এজেন্ট। সে ভারতমাতাকে রক্ষা করার জন্য দেশমাতার শত্রুদের সঙ্গে ভয়ানক লড়াই-এর মধ্যে দিয়ে দেশকে বাঁচাচ্ছে। সবশেষে যেকথা না বললেই নয়, যত বিতর্ক শুরু হয়েছিল যা নিয়ে তা হল দীপিকার গেরুয়া বিকিনি। বয়কটবাদীদের গোপন খবর দিয়ে শেষ করি, দীপিকা এই বিকিনি পরেই সিনেমাতে পাকিস্তানের হয়ে কাজ করা জনের লোকজনদের হেব্বি পেটাচ্ছে। এবার আপনারাই বিচার করুন গেরুয়া বিকিনিতে দেশকে অসম্মান করেছে নাকি পাকিস্তানের হয়ে কাজ করা পাবলিকদের পিটিয়ে দেশকে গর্বিত করেছে।
- রিভিউটি লিখেছেন ঋতুপর্ণা কোলে