রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসের বিরুদ্ধে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে অভিযোগ জানাতে বাধ্য শুভেন্দু অধিকারীরা। চুপ থাকলে রাজ্য বিজেপির বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। লিখলেন উত্তম দেব-
শ্রীপঞ্চমী তিথিতে রাজভবনে মুখ্যমন্ত্রীর সান্নিধ্যে বাংলা শিক্ষার হাতেখড়ি। ষষ্ঠীতে দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর ক্লাসে ছাত্রের আসনে রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস। বৃহস্পতিবার হাতেখড়ি পর্ব মিটতেই দিল্লির ফ্লাইট ধরতে তড়িঘড়ি দমদমে ছোটেন বাংলার রাজ্যপাল। রাজ্য বিজেপির নেতারা চাপাস্বরে সংবাদ মাধ্যমকে জানাচ্ছেন, ছুটবেন না! কেন্দ্র থেকে জরুরী তলব এসেছে যে। মোদী কিম্বা শাহের দফতর থেকে আনন্দের কাছে সত্যিই তলব এসেছে কিনা, তা নিশ্চিত করে জানা যায় নি। তবে এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে চাপান-উতোর শুরু হয়ে গেছে সরস্বতী পুজোর সন্ধ্যা থেকেই।
রাজ্য বিজেপির সঙ্গে সি ভি আনন্দ বোসের দূরত্ব বাড়তে বাড়তে ‘হাতেখড়ি’কে ঘিরে চরমে পৌঁছেছে। সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক এমন ইস্যুতে সি ভি আনন্দ বোসের নজর কাড়তে চেয়ে রাজ্য বিজেপির নেতারা ব্যর্থ হয়েছেন যা ধনখড় থাকলে নিঃসন্দেহে লুফে নিতেন। পর পর একাধিক ইস্যুতে রাজ্যপালের সাড়া না পেয়ে রাজভবনে যাতায়াতই প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন শুভেন্দু অধিকারী, সুকান্ত মজুমদাররা। তবে ধনখড় হোক আর আনন্দ বোস- রাজভবন সংবাদ শিরোনামেই আছে। পার্থক্য শুধু একটা জায়গাতেই- মমতাকে চটিয়ে হেডলাইন থাকতেন ধনখড়, আনন্দ বোস হেডলাইনে থাকছেন শুভেন্দু-সুকান্তকে চটিয়ে।
জগদীপ ধনখড় যখন রাজভবনে, বহুবার রাজ্যপালের নামে তৃণমূলের তরফে নালিশ গেছে দিল্লিতে। এখন সি ভি আনন্দ বোসকে নিয়ে পড়েছেন রাজ্য বিজেপির নেতারা। রাজ্যপালের নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে অমিত শাহের টেবিলে শুভেন্দু অধিকারীদের তরফে ইতিমধ্যেই অনেক অভিযোগ জমা পড়েছে বলে রাজ্য বিজেপি সূত্রে খবর। এই মুহূর্তে আনন্দ ও বিজেপির সংঘাত আর রাখঢাকের জায়গাতেও নেই। যে দিন সাংসদ স্বপন দাশগুপ্ত রাজ্যপালকে নবান্নের জেরক্স মেশিন আর রাজভবনকে তৃণমূলের পার্টি অফিস বলে কটাক্ষ করেছেন, সেদিন থেকেই চাপা অসন্তোষের বিস্ফোরণ ঘটে গেছে। রাজ্যপালের হাতেখড়ি অনুষ্ঠানে রাজ্য বিজেপির তরফে কেউই উপস্থিত ছিলেন না। প্রাক্তন রাজ্যপাল তথাগত রায় উপস্থিত থাকলেও তথাগত নিজেই দাবি করে থাকেন, তিনি আর বিজেপিতে নেই। রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদার চুপ থাকলেও হাটে হাঁড়ি ভাঙতে ছাড়েন নি শুভেন্দু। কেন তিনি রাজ্যপালের হাতেখড়িতে যান নি, সামাজিক মাধ্যমে তার সবিস্তার ব্যাখ্যা করেছেন বিরোধী দলনেতা। শুভেন্দু অধিকারীর কথাতেই স্পষ্ট রাজভবনের সঙ্গে রাজ্যের শাসকদলের নেক্সাসের প্রতিবাদে অনুষ্ঠানটি কার্যত বয়কট করেছেন তাঁরা।
এই পরিস্থিতিতে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব কী পদক্ষেপ করে, সেই দিকে স্বাভাবিকভাবেই নজর রাজনৈতিক মহলের। রাজনীতিতে মঞ্চের থেকে গ্রিনরুমের ঘটনাই বেশি রহস্যের। কে কোন ঘুঁটি কেন চালে তা সহসা সাধারণের বোধগম্যের বাইরে। কেন্দ্র থেকে কেন সি ভি আনন্দ বোসের মতো ভালো মানুষকে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল করে পাঠানো হল, সেই প্রশ্নের উত্তর সুকান্ত-শুভেন্দুদের জানা থাকলেও তাঁদের পক্ষে হয়তো মুখ ফুটে তা বলা সম্ভব নয়। রাজনীতিতে অনেক গোপন ব্যথাই মুখ বুজে হজম করতে হয়।
সি ভি আনন্দ বোসকে রাজ্যপাল পেয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আনন্দিত। মমতাকে আনন্দ দেওয়াই কি কেন্দ্রের অভিপ্রায় ছিল? মমতা আনন্দ পেলে বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্বের কিঞ্চিৎ লাভ থাকলেও বঙ্গ বিজেপির তাতে কী ফায়দা? রাজভবন আর নবান্নের মধ্যে সখ্যতা যত বেশি প্রকট হয়ে উঠবে, রাজনীতিতে বিজেপির অস্বস্তি ততই বাড়বে। সামনেই পঞ্চায়েত নির্বাচন। ইতিমধ্যেই রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। গ্রামীণ ভোট ঘিরে আইনশৃংখলার গুরুতর অবনতি ঘটলেও যদি রাজভবন উচ্চবাচ্য করা থেকে বিরত থাকে, তবে শুভেন্দু অধিকারীরা দলের কর্মী-সমর্থকদের কাছে মুখ দেখাবেন কীভাবে? বাম-কংগ্রেসও কি বিজেপিকে ছেড়ে কথা বলবে? সিপিএমের ‘সেটিং তত্ত্ব’ সামাল দেবে কী করে রাজ্য বিজেপি?
রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস এখন দিল্লিতে। আনন্দের ‘নাট’ একটু টাইট করে দেওয়ার দাবি শাহের কাছে রাখতেই পারেন শুভেন্দু অধিকারীরা। রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা বলে একটা কথা আছে। দলের রাজ্য নেতৃত্বকে তুষ্ট রাখার বাধ্যবাধকতা বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের তরফেও আছে। দিল্লি থেকে আনন্দ নতুন কী পাঠ নিয়ে রাজভবনে আসেন, এখন এটাই দেখার। কুণাল ঘোষ বৃহস্পতিবার রাত থেকেই ‘নিরপেক্ষ’ রাজ্যপালের মন বিষিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন।
Feature Image is representational. Image source- Official FB page of Gov. C V Ananda Bose.