বিশেষ প্রতিবেদন: যুদ্ধ এবং জলবায়ু পরিবর্তন পৃথিবীতে সাড়ে চার কোটি মানুষকে দুর্ভিক্ষের মুখে ঠেলে দিতে চলেছে। ‘হাঙ্গার হটস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত পৃথিবীর ১৯টি এলাকায় ২০২৩-এর জানুয়ারির মধ্যে পরিস্থিতি আরও শোচনীয় হওয়ার আশঙ্কা করছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা। পৃথিবীর ৭৫টি দেশে ৮ কোটির বেশি মানুষের ক্ষুধা নিবারণে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি পালন করে থাকে এই সংস্থা। ক্ষুধার্ত জনগোষ্ঠীর মুখে খাদ্য তুলে দেওয়ার পাশাপাশি খাদ্য উৎপাদন, বন্টন এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে পৃথিবী জুড়ে জরিপ চালিয়ে থাকে জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থা। দুনিয়া জুড়ে খাদ্য নিরাপত্তার অভাব বা ফুড ইনসিকিউরিটি নিয়ে সম্প্রতি যে পূর্বাভাস সংস্থাটি দিয়েছে, তা আতঙ্কিত হওয়ার মতোই।
২০ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, পৃথিবীর ৪৫টি দেশে খাদ্য সংকট পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সব মিলিয়ে ২০ কোটির বেশি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা বড় রকমের ঝুঁকির মুখে পড়তে চলেছে। এই বিপুল সংখ্যক মানুষকে অনাহারের হাত থেকে বাঁচাতে অবিলম্বে পদক্ষেপ করা প্রয়োজন বলে সংস্থাটির মিড ইয়ার আপডেটে উল্লেখ করা হয়েছে। ক্ষুধায় কাতর ১৯টি অঞ্চলের মধ্যে সবথেকে শোচনীয় অবস্থা আফগানিস্তান, ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, দক্ষিণ সুদান এবং ইয়েমেনের। এই ছয়টি দেশই টানা গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত।
১৯টি হাঙ্গার হটস্পটের মধ্যে থাকা ৩৭টি দেশের ৪৫ মিলিয়ন মানুষ রোজ এত সামান্য পরিমাণ ক্যালরি আহার করে যে চরম অপুষ্টি ও অনাহার জনিত মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তারা। ইতিমধ্যেই অনেক এলাকা থেকে অনাহারে ভোগা মানুষের মৃত্যুর খবর আসতে শুরু করেছে বলে খাদ্য ও কৃষি সংস্থা জানিয়েছে। জরুরী ভিত্তিতে ব্যবস্থা না নিলে ২০২২-এর শেষ নাগাদই ৯ লক্ষ ৭০ হাজার ক্ষুধার্ত মানুষ চূড়ান্ত বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে বলে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে সংস্থার প্রতিবেদনে।
রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ, পরিস্থিতি আরও খারাপ করেছে
এই দুর্ভিক্ষ ও খাদ্যাভাবের একটা কারণ পুরোপুরি মনুষ্য সৃষ্ট। বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকা জাতিগোষ্ঠীগত সংঘাত-হিংসা, গৃহযুদ্ধ ও যুদ্ধের কারণেই ক্ষুধার সমস্যা এমন চরমে উঠেছে। মরার উপর খাঁড়ার ঘার মতো আচমকা নেমে এসেছে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ, যা আন্তর্জাতিক বাজারে কৃষিজাত পণ্যের দাম বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। পৃথিবীতে গম নিয়ে যত বাণিজ্য হয়, তার তিরিশ শতাংশই রাশিয়া আর ইউক্রেনের দখলে। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে জ্বালিনি ও খাদ্যশস্যের আন্তর্জাতিক মূল্য বেড়ে যাওয়ায় দেশে দেশে অভ্যন্তরীণ খাদ্য ও জ্বালানি ক্রয়ের খরচ এক ধাক্কায় অনেকটাই বেড়ে গেছে।
লা নিনার ট্রিপল ডিপ চিন্তা বাড়িয়েছে
খাদ্য ঘাটতির আরও একটা কারণ চরম আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তন বলে মনে করছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা। ঘন ঘন সামুদ্রিক ঝড়, বন্যা এবং টানা অনাবৃষ্টি অনেক দেশের খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থাকেই খাদের কিনারায় এনে ফেলেছে। বিশেষ করে হর্ন অব আফ্রিকার ১১টি দেশ ইতিমধ্যেই খরা কবলিত। টানা পাঁচ বছর ধরে আফ্রিকার এই অঞ্চলে কার্যত বৃষ্টি নেই। পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করা হয়েছে জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সর্বশেষ প্রতিবেদনে। লা লিনার প্রভাবে আবহাওয়া আরও চরম আকার নিয়েছে। পর্যাপ্ত পরিমাণ বৃষ্টির অভাবে পূর্ব ও পশ্চিম আফ্রিকা, মধ্য এশিয়া, মধ্য আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের বহু দেশে খাদ্য ও প্রাণীজসম্পদ উৎপাদনের প্রভূত ক্ষতি সাধন করেছে।
এই নিয়ে তিন বছর হল পৃথিবীতে লা নিনার দাপট অব্যাহত। গত বিশ বছরের মধ্যে এই প্রথমবার পৃথিবী ভূ-তাত্ত্বিকদের ভাষায় লা নিনোর ‘ট্রিপল ডিপ’ এফেক্টের মধ্যে পড়েছে। যা একাধিক দেশকে টানা, ভয়াবহ বন্যা ও উপর্যুপরি সামুদ্রিক ঝড়ে কাবু করে তুলেছে। এই পরিস্থিতিতে পৃথিবীর বিশাল অংশ জুড়ে খাদ্য সংকট চরমে ওঠার আগেই উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরী বলে মনে করছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা।
Feature Image is representational and collected from the vaultz news.