আনন্দ শুধু বাগ্মীতাতেই পারদর্শী নন, কলমেও যথেষ্টই সাবলীল। ইংরেজি, হিন্দি ও মাতৃভাষা মালায়ালম- তিনটি ভাষায় মোট ৪০টি বই লিখেছেন প্রাক্তন আইএএস সিভি আনন্দ বোস।
বিশেষ প্রতিবেদন: পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে রাজ্যপাল পদ বিভিন্ন ইস্যুতে একাধিকবার সংবাদ শিরোনামে এসেছে। তবে সরকারের সমালোচনা করে প্রাক্তন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় রোজই হেডলাইন হতেন। ধনখড়কে সরাতে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি পর্যন্ত দিয়েছিল বিরক্ত তৃণমূল। তবে ধনখড়কে যখন উপরাষ্ট্রপতি পদের জন্য মনোনয়ন দিল বিজেপি, তখন দলের সাংসদদের ভোটদান থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ধনখড়ের দিল্লিযাত্রার পর পশ্চিমবঙ্গের অস্থায়ী রাজ্যপাল হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন মণিপুরের রাজ্যপাল লা গণেশন। গত ১৮ জুলাই বাংলার অস্থায়ী রাজ্যপাল রূপে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল গণেশনকে। ১৭ নভেম্বর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি মিলল তাঁর।
যৌবনে আরএসএস-এর সার্বক্ষণিক প্রচারক হওয়ার জন্য সরকারি চাকরি ছেড়েছেন তামিল ব্রাহ্মণ লা গণেশন। করেন নি বিয়েও। তামিলনাড়ু বিজেপির সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন। কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক এই চার মাসে গণেশনের সঙ্গে মমতার সম্পর্ক ছিল যথেষ্টই মধুর। মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির কালীপুজোয় গিয়েছিলেন অস্থায়ী রাজ্যপাল। গণেশনের জন্মদিনে তাঁর চেন্নাইয়ের বাড়িতেও আমন্ত্রিত ছিলেন মমতা। এবং সেই আমন্ত্রণ রক্ষা করতেও ভোলেন নি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। দু’জনের এই সুসম্পর্ক ভালভাবে নেন নি রাজ্য বিজেপির নেতারা। কিছু ইস্যুতে এমনও মনে হয়েছে, রাজ্য বিজেপির নেতাদের এড়িয়ে চলতে পারলেই স্বচ্ছন্দ্য বোধ করেন লা গণেশন। অস্থায়ী রাজ্যপালের উপর রাজ্য বিজেপির বিরক্তি গোপন থাকে নি। গণেশনের প্রতি উষ্মার কথা রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব সাম্প্রতিক সময়ে দিল্লিতে দলের শীর্ষ নেতাদের কানেও তুলেছেন বলে শোনা যায়।
রাজ্য বিজেপির চাপেই হোক অথবা নিয়মমাফিক, মণিপুরের রাজ্যপাল গণেশনকে পশ্চিমবঙ্গের অতিরিক্ত দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিল কেন্দ্রীয় সরকার। বাংলার নতুন রাজ্যপাল হিসেবে ইতিমধ্যেই রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে নিয়োগ পেয়েছেন সিভি আনন্দ বোস। সিভি আনন্দ বোসের রাজভবনে এসে শপথ নেওয়াটুকুই বাকি। রাজ্যপাল সাংবিধানিক প্রধানের পদ হলেও পদটি নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। রাজ্যের সরকার রাজনৈতিকভাবে কেন্দ্রের সরকারের বিরোধী হলে রাজ্যপাল কেন্দ্রের ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হন বলে অভিযোগ। ধনখড়ের আমলে একাধিক ইস্যুতে নবান্নকে রাজভবনের ব্যতিব্যস্ত করে তুলতে দেখা গেছে। ক্ষেপে গিয়ে মমতা একবার হোয়াটসঅ্যাপে ধনখড়কে ব্লক পর্যন্ত করে দিয়েছিলেন।
রাজ্যপাল চাইলে রোজই কীভাবে মিডিয়ার নজর কেড়ে নিতে পারেন, জগদীপ ধনখড় তা দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। সিভি আনন্দ বোস এখনও রাজভবনে পা রাখেন নি। যদিও রাজনৈতিক মহলে জল্পনা শুরু হয়ে গেছে কেমন হবে রাজ্য সরকারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক, কতটা বেগ দেবেন তিনি সরকারকে কিম্বা আদৌ বেগ দেবেন তো? সামনেই পঞ্চায়েত ভোট। পঞ্চায়েত ভোটকে শান্তিপূর্ণ রাখা প্রশাসনের জন্য একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। কিন্তু ইতিমধ্যেই রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করে দিয়েছেন বিরোধীরা। গ্রামেগঞ্জে যেভাবে বোমা উদ্ধার হওয়া আর বোমা বিস্ফোরণে উড়াউড়ির খবর আসা শুরু হয়েছে, তাতে বিরোধীদের অভিযোগ অসাড়, এমন কথা বলার সুযোগ নেই। পঞ্চায়েত নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রশাসন আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যর্থ হলে সরকার, মুখ্যমন্ত্রী ও শাসকদলকে অস্বস্তির মুখে পড়তেই হবে। পরিস্থিতি তেমন হলে রাজভবনের পাঁচ লাইনের একটা বিবৃতিও যে ওজনে কতটা ভারী হয়, তা শাসক-বিরোধী সব পক্ষেরই জানা।
নরেন্দ্র মোদীর জমানায় কেন্দ্রের প্রতিটি পদক্ষেপের পেছনেই থাকে সূক্ষ্ম রাজনীতির চাল। সামনেই পঞ্চায়েত তারপর লোকসভা নির্বাচন। আর বাংলায় নির্বাচন মানেই রাজনৈতিক উত্তেজনা। আঠারোর পঞ্চায়েত ভোটে হিংসা-সন্ত্রাসের কথা কেউ ভুলে যায় নি। রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব খুব সঙ্গত কারণেই চাইবেন, রাজভবনের নতুন কর্তা জগদীপ ধনখড়ের মতোই প্রো-অ্যাক্টিভ থাকুন। সিভি আনন্দ বোস কেমন রাজ্যপাল হবেন, তা সময়ই বলবে তবে সিভির ‘সিভি’ দেখে একটা কথা বলাই যায়, পশ্চিমবঙ্গ একজন উচ্চশিক্ষিত, বিদ্বান, বাগ্মী ও লেখক-সাহিত্যিককেই সাংবিধানিক প্রধান হিসেবে পাচ্ছে নিঃসন্দেহে। প্রাক্তন আইএএস সিভি আনন্দ বোস জাতিতে মালায়ালম। জন্ম কেরলের কোট্টায়ামে-১৯৫১ সালের ২ জানুয়ারি। বাবা ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। নেতাজির প্রতি ভালবাসা থেকেই মালাওয়ালি সিভি আনন্দের নামের শেষে ‘বোস’ যুক্ত হয়েছে। বাচ্চা বয়স থেকেই স ভি আনন্দ মেধাবী। কেরল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। বিড়লা ইনস্টিটিউট থেকে পিএইচডি। টানা তিন বছর ইউনিভার্সিটির ডিবেটে চ্যাম্পিয়ন। সাতাত্তর ব্যাচের আইএএস ক্যাডার। মুসৌরির আইএএস ক্যাডারদের অ্যাকাডেমিতেও বিতর্কে চ্যাম্পিয়ন। বোঝাই যাচ্ছে বাংলার নতুন রাজ্যপালকে তর্কে হারানো মুশকিল।
আনন্দ শুধু বাগ্মীতাতেই পারদর্শী নন, কলমেও যথেষ্টই সাবলীল। ইংরেজি, হিন্দি ও মাতৃভাষা মালায়ালম- তিনটি ভাষায় মোট ৪০টি বই লিখেছেন সিভি আনন্দ বোস। উপন্যাস-ছোটগল্প থেকে কবিতা-প্রবন্ধ, আনন্দের লেখা বইয়ের তালিকায় আছে সবই। সাহিত্যপ্রেমী বাঙালির রাজ্য সাহিত্যিক রাজ্যপালের অভিজ্ঞতার ঝুলিকে যে আরও সমৃদ্ধ করবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু সাহিত্যিক কিম্বা সুবক্তাই নন পরিকল্পনাবিদ হিসেবেও খ্যাতি আছে এই প্রাক্তন আমলার। এই কারণেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর খুব কাছের মানুষ পশ্চিমবঙ্গের নব নিযুক্ত রাজ্যপাল। দরিদ্রদের জন্য পাকা বাড়ি সহ তাঁর একাধিক ভাবনাকে কাজে লাগিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। মোদী আনন্দকে ডাকেন ‘ম্যান অফ আইডিয়াজ’ নামে। দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ এবং জেনেভা অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ফিউশন এনার্জি অর্গানাইজেশনে। ছাত্র জীবনে ১৫টি স্বর্ণপদক সহ ১০০টিরও বেশি পদক পেয়েছেন সিভি আনন্দ বোস। ২৯টি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কারও তাঁর ঝুলিতে। অনেক হিসেবনিকেশ করেই এমন ওজনদার একজনকে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল করে দিল্লি থেকে পাঠানো হল বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
Feature Image is representational.