প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিতে আত্মনির্ভর হওয়ার পথে আরও এক কদম এগোল ভারত। দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি প্রথম বিমানবাহী রণতরীর উপরবিশেষ প্রতিবেদন-
সামরিক প্রযুক্তিতে দেশের পরমুখাপেক্ষিতা কাটিয়ে ওঠা মোদী সরকারের অন্যতম লক্ষ্য। আশার কথা হল সরকারের সদিচ্ছায় ভারত প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে নিজের দুর্বলতাগুলি কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে। এই বছর দেশের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্ণ হচ্ছে। ১৫ অগাস্ট দেশের নৌ বহরে প্রথমবারের মতো যুক্ত হতে চলেছে সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি অত্যাধুনিক একটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার বা বিমানবাহী রণতরী। স্বাধীনতার পর এই প্রথম! আইএনএস বিক্রান্ত- দেশের নৌবাহিনী যেই রণতরীর নাম দিয়েছে ইন্ডিজিনাস এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ( আইএসি ) বিক্রান্ত। রবিবার আইএসি বিক্রান্তের চতুর্থ তথা চূড়ান্ত দফার ট্রায়াল সফলভাবে শেষ হয়েছে বলে নৌবাহিনী সূত্রে জানানো হয়েছে।
৩৭ হাজার ৫০০ টনের বিমানবাহী রণতরী
আইএসি বিক্রান্তের নক্সা তৈরি করেছে ডাইরেক্টরেট অব নাভাল ডিজাইন ( Directorate of Naval Design )। ২০০৯ থেকে সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে রণতরীটি নির্মাণের কাজ শুরু করেন ডিএনডি’র বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদেরা। রাষ্ট্রায়ত্ব কোচিন শিপইয়ার্ড লিমিটেড ( সিএসএল )- এ ৩৭ হাজার ৫০০ টনের এই বিশাল অত্যাধুনিক রণতরীটি তৈরি করতে সময় লেগেছে ১২ বছর। একুশের অগাস্ট মাসেই যুদ্ধজাহাজটি সমুদ্রে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। এর পর সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় পরপর চারটি পরীক্ষায় সফলভাবেই উত্তীর্ণ হয়েছে নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি দেশের প্রথম এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার। জুলাইয়ের শেষেই আইএসি বিক্রান্তকে ভারতীয় নৌবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করতে পারে ডিএনডি। এরপর বাকি থাকবে শুধু নৌবাহিনীতে আনুষ্ঠানিক সংযুক্তিকরণ বা কমিশনিং। আগামী ১৫ অগাস্ট প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর হাত দিয়ে নৌবাহিনীতে আইএসি বিক্রান্তের আনুষ্ঠানিক কমিশনিং হওয়ার কথা।
ভারত হবে বিমানবাহী রণতরী নির্মাণে সক্ষম সপ্তম দেশ
বিমানবাহী রণপোত নির্মাণ করতে পারে পৃথিবীর হাতে গোনা কয়েকটি দেশ। আমেরিকা, রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি এবং চিন- এখনও পর্যন্ত এই ছয়টি দেশ নিজস্ব প্রযুক্তিতে বিমানবাহী রণপোত নির্মাণে সক্ষম। ২০২২-এই ভারত হতে চলেছে সপ্তম দেশ যে নিজের সামর্থ্যেই এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার বা বিমানবাহী রণতরী তৈরি করতে পারে। ভারতের মতো সমুদ্র বেষ্টিত বড় দেশের নৌ প্রতিরক্ষায় বিমানবাহী রণতরী বাধ্যতামূলক। চিন বহু আগেই তার নৌবহরকে যথেষ্টই শক্তিশালী করে তুলেছে। ভারত মহাসাগরে চিনের আগ্রাসন রুখে দিতে ভারতীয় নৌবাহিনীর স্বশক্তিকরণ আরও আগেই দরকার ছিল বলে মনে করেন দেশের প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা। ভারতীয় নৌবহরে এতদিন যে কয়টি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার যুক্ত ছিল তার সবকটিই বিদেশ থেকে কেনা। আইএনএস বিক্রান্ত ( ওয়ান ) আসে ব্রিটেন থেকে। এইচএমএস হারকিউলিস ব্রিটিশ রয়্যাল নেভি থেকে ডিকমিশনড হওয়ার পর ১৯৬১ সালে আইএনএস বিক্রান্ত নামে ভারতীয় নৌবহরে যুক্ত হয় যুদ্ধজাহাজটি। ১৯৯৭ সালে আইএনএস বিক্রান্তকে অবসরে পাঠানো হয়। আইএনএস বিরাটও ( ১৯৮৭-২০১৬ ) কেনা হয়েছিল ব্রিটেন থেকে। এখন দেশের নৌবাহিনীতে সক্রিয় আছে একটি মাত্র বিমানবাহী রণতরী- আইএনএস বিক্রমাদিত্য। রাশিয়া থেকে কেনার পর ২০১৩ সালে যুদ্ধজাহাজটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের বহরে যুক্ত করে নৌবাহিনী।
যুদ্ধজাহাজটি ১৮ তলা বাড়ির সমান উঁচু
দেশের প্রথম বিমানবাহী রণতরী আইএনএস বিক্রান্ত একাত্তরের ভারত-পাক যুদ্ধে অনবদ্য ভূমিকা পালন করে। আইএনএস বিক্রান্তের সেই স্মৃতি জাগ্রত রাখতেই দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি ভারতের প্রথম অত্যাধুনিক বিমানবাহী রণপোতের নাম রাখা হয়েছে আইএসি বিক্রান্ত। শুধু ভারতীয় নৌবাহিনীতেই নয় দেশের সামগ্রিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাতেই একটা নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করতে চলেছে আইএসি বিক্রান্ত। ইন্ডিয়ান নেভিতে এখন চলছে প্রহর গোনার পালা। নৌবাহিনীর অফিসার থেকে সৈনিক সবাই রোমাঞ্চিত। ২৬২ মিটার লম্বা এক বিশাল যুদ্ধজাহাজ আইএসি বিক্রান্ত। উচ্চাতা ৬২ মিটার, যা একটি ১৮ তলা বাড়ির সমান। জাহাজটিতে রয়েছে ১৪টি ডেক আর ২৩০০টি ঘর। নাবিক, ইঞ্জিনিয়ার এবং অফিসার সহ ১৭০০ জনের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে বিক্রান্তে। মহিলা অফিসারদের থাকার জন্য যুদ্ধজাহাজটিতে আছে পৃথক ব্যবস্থা। জাহাজটি নিয়ন্ত্রিত হবে সর্বাধুনিক নেভিগেশন দ্বারা। থাকছে অতি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন রাডার। নাবিক ও মেরিনসেনাদের জীবনরক্ষাকারী নানা অত্যাধুনিক প্রযুক্তিও এতে যোগ করা হয়েছে।
৩০টি ফাইটার জেট ওঠানামায় সক্ষম
আইএসি বিক্রান্তের ছাদে একসঙ্গে ৩০টি যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টারের জায়গা হবে। রয়েছে দুটি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের রানওয়ে। যখন-তখন বিমান ও হেলিকপ্টার ওঠানামার যাবতীয় ব্যবস্থা রয়েছে জাহাজটিতে। কোন ধরণের যুদ্ধবিমান আইএসি বিক্রান্তে ওঠানামা করবে তার একটি তালিকাও তৈরি করে ফেলেছেন নৌবাহিনীর আধিকারিকেরা। Boeing’s F/A 18E সুপার হর্নেট ফাইটার এয়ারক্রাফট এবং রাফাল এম ( Rafale M ) যুদ্ধবিমানই পছন্দ তাঁদের। পাশাপাশি দেশে তৈরি তেজসও থাকার সম্ভাবনা এই ভাসমান বিমান ঘাঁটিতে।
খরচ হয়েছে ২৩ হাজার কোটি টাকা
২০১৩ সালে রাশিয়া থেকে সেকেন্ড হ্যান্ড আইএনএস বিক্রমাদিত্য কিনতে খরচ হয়েছে ২৩০ কোটি ডলার। দেশে নিজস্ব প্রযুক্তিতে আইএসি বিক্রান্ত বানাতে খরচ হয়েছে ভারতীয় মুদ্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা। তুলনায় অনেক কম খরচে দেশেই যে নতুন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার নির্মাণ সম্ভব আইএসি বিক্রান্তের সাফল্য তা প্রমাণ করতে চলেছে বলে মনে করেন সমর বিশেষজ্ঞরা। আইএসি বিক্রান্তের সাফল্য একদিকে দেশের প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিবিদদের মনোবল বাড়াবে অন্যদিকে দেশকে প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিতে স্বাবলম্বী করে তুলবে। সামরিক দিক থেকে স্বনির্ভরতা অর্জন ব্যতীত কোনও দেশ সুপার পাওয়ার হয়ে উঠতে পারে না।
Photo Credit- Indian Navy.