মুখ্যমন্ত্রীর উত্তরবঙ্গ সফরের মধ্যেই জীবন সিংহের ভিডিও ঘিরে চাঞ্চল্য। ভিডিও যদি জীবনেরও হয়, এই ভাবে উত্তরবঙ্গে জঙ্গি নাশকতার দিন ফিরিয়ে আনতে পারবেন না কেএলও প্রধান। বিশেষ প্রতিবেদন-
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্তরবঙ্গ সফরের আগে কেএলও-র প্রচারিত ভিডিও ফুটেজ ( নাগরিক নিউজ ডট কম ভিডিওর সত্যতা যাচাই করে নি ) ঘিরে রাজনৈতিক মহলে চাঞ্চল্য। বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এজেন্সিগুলিকেও ভাবাচ্ছে। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে সামরিক পোশাক পরিহিত যেই ব্যক্তিকে মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে রীতিমতো হুমকি ছুঁড়তে দেখা যাচ্ছে, দাবি করা হচ্ছে তিনিই কেএলও প্রধান জীবন সিংহ।
ইতিমধ্যেই উত্তরবঙ্গে পা রেখেছেন মমতা। মঙ্গলবার আলিপুরদুয়ার ও জলপাইগুড়ি জেলায় কর্মসূচি রয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর। মমতার উত্তরবঙ্গ সফরে মোটেই খুশি নন কেএলও প্রধান। জীবন সিংহ বলেন- ” আমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলছি, খবরদার কোচ-কামতাপুরের ওপর পা রাখবেন না। তোমরা কোচ-কামতাপুর রাজ্য গঠনের ক্ষেত্রে কোনও হস্তক্ষেপ করতে পারবা না।” ভাষণে উত্তরবঙ্গ থেকে নির্বাচিত বিজেপির তিন সাংসদ নিশীথ প্রামাণিক, ডঃ জয়ন্ত রায় ও জন বার্লারও নাম নেন জীবন সিংহ।
একটি ভিডিও ক্লিপে তিরিশ-বত্রিশজন সশস্ত্র যুবককে ওয়ার্মআপ করতেও দেখা যাচ্ছে। প্রত্যেকের হাতেই অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। পাহাড়ের ঠিক নিচে কোনও সমতলভূমিতে ভিডিওটি ধারণ করা হয়েছে। জীবন সিংহ যখন বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, তখন তাঁর দুই পাশে আরও পাঁচজনকে বসতে থাকতে দেখা যায়। একজন বাদে প্রত্যেকেই সামরিক পোশাকে। জীবন সিংহের পেছনে ছয় জঙ্গি রাইফেল উঁচিয়ে পাহারা দিচ্ছিলো।
অপারেশন অল ক্লিয়ারের পর থেকেই কেএলও কোনঠাসা
মুখ্যমন্ত্রীর চলতি উত্তরবঙ্গ সফরকে লক্ষ্য করেই যে ভিডিওটি ছড়ানো হয়েছে এই ব্যাপারে নিশ্চিত নিরাপত্তা আধিকারিকেরা। তবে ভিডিওতে বক্তৃতারত ব্যক্তিটিই জীবন সিংহ কিনা সেই ব্যাপারে নিশ্চিত নন গোয়েন্দারা। জীবন সিংহের গতিবিধির উপর কড়া নজর কেন্দ্র ও রাজ্যের গোয়েন্দা নেটওয়ার্কগুলির। যদিও বাজপেয়ী সরকারের আমলে সংগঠিত অপারেশন অল ক্লিয়ারের ( ২০০৩-এর ১৫ জানুয়ারি থেকে ২০০৪-এর ৩ জানুয়ারি ) পর থেকেই জীবন সিংহকে নিয়ে রহস্যের শেষ নেই। জীবনকে নিয়ে নানা সময়ে নানা খবর রটে। অপারেশন অল ক্লিয়ারের ধাক্কায় ভূটানের জঙ্গলে থাকা আলফা এবং এনডিএফবি সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একাধিক জঙ্গি সংগঠনের ঘাঁটি গুঁড়িয়ে যায়। সেখানে কেএলও জঙ্গিদেরও প্রশিক্ষণ চলত। অপারেশন অল ক্লিয়ারের পর আলফা এবং এনডিএফবি কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। পরেশ বড়ুয়া ছাড়া আলফার বাকি শীর্ষ নেতারা একে একে আত্মসমর্পণ করে মূলস্রোতে মিশে যান। অপারেশন অল ক্লিয়ার কেএলও-রও কোমর ভেঙে দেয়। ২০০৪ থেকেই তরাই-ডুয়ার্সে কেএলও জঙ্গিদের তৎপরতা স্তিমিত হয়ে যায়। জীবন সিংহের ঘনিষ্ঠ একাধিক জঙ্গি রাজ্য সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করে সমাজের মূলস্রোতে ফিরে আসে। কিন্তু জীবন সিংহ বেপাত্তাই থেকে যান।
জীবন সিংহ কি মায়ানমারে?
খালেদা জিয়ার আমলে বাংলাদেশেও বেশ কয়েকবার জীবন সিংহ আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের হাতে প্রমাণ আছে। এই মুহুর্তে মায়ানমারের জঙ্গল ছাড়া আর কোথাও কেএলও প্রধানের পক্ষে আত্মগোপন করে থাকা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা। ভারত-মায়ানমার সীমান্তে কাচিন বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত দুর্গম পার্বত্য এলাকা কার্যত হরেক রকমের জঙ্গি গোষ্ঠীর মুক্তাঞ্চল। এনএসসিএন সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একাধিক জঙ্গি সংগঠনের ঘাঁটি রয়েছে মায়ানমারের এই অঞ্চলে। ২০১৫-তে এনএসসিএন- খাপলাং গোষ্ঠীকে শায়েস্তা করতে মায়ানমারের এই অঞ্চলে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকও চালিয়েছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী। পরেশ বড়ুয়ার মতো জীবন সিংহও গুটি কয়েক অনুগামী নিয়ে মায়ানমারের কাচিন বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত মুক্তাঞ্চলে ঘাপটি মেরেছেন বলে গোয়েন্দাদের অনুমান।
গোপনে নেটওয়ার্ক গড়তে ব্যস্ত জীবন?
বছর কয়েক আগে একবার অসমে এনকাউন্টার জীবন সিংহের মৃত্যুর খবর চাউর হয়েছিল। যদিও পরে সেই খবর অস্বীকার করে নিরাপত্তা এজেন্সিগুলি। ২০১৫-তেও এমন খবর রটেছিল যে, মায়ানমারের জঙ্গলে সেনা অভিযানে জীবন সিংহের মৃত্যু হয়েছে। ২০১৭-র ১লা অগাস্ট উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজে জীবন সিংহের স্ত্রী ভারতী দাসের মৃত্যু হয়। নেপাল থেকে গোপনে অ্যাম্বুলেন্সে করে ভারতীকে মেডিকেলে আনা হয়েছিল বলে জানতে পারে পুলিশ। জীবন সিংহের স্ত্রীকে যখন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল তখন তাঁর দেহে প্রাণের চিহ্ন খুঁজে পান নি চিকিৎসক। মায়ানমারের জঙ্গলে আত্মগোপন করে থাকলেও নেপাল পর্যন্ত জীবন সিংহের গোপন যাতায়াত থাকতে পারে বলে গোয়েন্দাদের একটি অংশের সন্দেহ।
জীবন সিংহের গতিবিধি নিয়ে ধোঁয়শায় গোয়েন্দারা?
জীবন সিংহের আসল নাম তমির দাস। আলিপুরদুয়ার জেলার কুমারগ্রামে তমিরের বাড়ি। তমির বাড়ি ছাড়া প্রায় তিরিশ বছর। কামতাপুর আন্দোলনের প্রারম্ভিক পর্বে অসমে একবার ধরা পড়লেও জামিনে ছাড়া পেয়ে যান তমির। ছাড়া পাওয়া মাত্রই গা ঢাকা দেন। জঙ্গি জীবনে তমির দাস নাম পাল্টে হয়ে যান জীবন সিংহ। পুলিশের কাছে জীবন সিংহের যে কটি ফটো আছে তা সেই সময় তোলা। এখন জীবন সিংহ দেখতে কেমন স্পষ্ট কোনও ধারণা নেই কেন্দ্র বা রাজ্যের গোয়েন্দাদের। মোস্ট ওয়ান্টেড এই জঙ্গি নেতাকে শনাক্ত করতে এটা একটা বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে স্বীকার করছেন নিরাপত্তা আধিকারিকেরা।
পরিস্থিতি পাল্টে গেছে, জীবন হতাশ হতে বাধ্য
বিভিন্ন সময়ে কেএলও-র লেটারহেড প্যাডে জীবন সিংহের স্বাক্ষরিত বিবৃতি সংবাদ মাধ্যমের দফতরে এসে পৌঁছেছে। এর আগেও জীবন সিংহ বলে দাবি করা ব্যক্তির একাধিক ভিডিও মিডিয়ার হাতে এসেছে। কিন্তু ভিডিও-র ব্যক্তিরা কেএলও প্রধান জীবন সিংহই কিনা সন্দেহমুক্ত হতে পারে নি পুলিশ। তবে মুখ্যমন্ত্রীকে হুমকি দেওয়া ব্যক্তি জীবন সিংহ হোন আর নাই হোন ভিডিওটিকে গুরুত্ব দিয়েই দেখছে প্রশাসন। পৃথক কোচ-কামতাপুর রাজ্যের দাবি করা হয়েছে ভাইরাল ভিডিওতে। ভিডিওর বক্তা জীবন যদি নাও হোন, জীবন সিংহ যে জীবিত, এটা এক প্রকার নিশ্চিত রাজ্য ও কেন্দ্রের গোয়েন্দারা। জীবন দীর্ঘদিন ধরেই ভেঙে পড়া সংগঠনকে ফের দাঁড় করাতে চাইছেন। কিন্তু সফল হয়েছেন এমন প্রমাণ এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। মায়ানমারের দুর্গম পাহাড়-জঙ্গল থেকে উত্তরবঙ্গ অনেক দূরে। অসমের পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে। বোড়ো জঙ্গিরাও ঝিমুচ্ছে। ভূটান পাহাড়ের দিকে ভারত সরকারের কড়া নজর। শেখ হাসিনার রাজত্বে বাংলাদেশে বসে ভারত বিরোধী কার্যকলাপ চালানো কোনও মতেই সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতিতে খবরে থাকতেই কি মাঝেমধ্যে ভিডিও ছেড়ে বাজার গরম করেন হতাশ জীবন সিংহ?
ভাইরাল ভিডিও-র অংশ বিশেষ-
Video and photo- collected by correspondent.