ডুয়ার্সের চা বলয়ের আদিবাসী সমাজে তৃণমূলের জনভিত্তি ষোলোর পর থেকেই দুর্বল হয়ে পড়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর আলিপুরদুয়ার সফর কি শাসকদলকে হৃত জমি পুনরুদ্ধারে সাহায্য করবে?
আলিপুরদুয়ার :দু’দিনের উত্তরবঙ্গ সফর শেষ করে বুধবার কলকাতা ফিরেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবার মমতার সফর আলিপুরদুয়ার জেলাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। আলিপুরদুয়ারে দীর্ঘদিন ধরেই তৃণমূলের হাল খারাপ। লোকসভা তো বটেই এমনকি বিধানসভা নির্বাচনেও মমতাকে শূন্য হাতে ফিরিয়েছে আলিপুরদুয়ার জেলা। সেই অভিমানের কথা মঙ্গলবারের কর্মীসভায় জানাতে ভোলেন নি মুখ্যমন্ত্রী। মমতা মনে করেন, তাঁর সরকার ঢেলে দেওয়ার পরেও আলিপুরদুয়ারের মানুষের মন পায় নি। তবে মানুষের ক্ষোভের পেছনে যে কারণ আছে তা মানতে বাধ্য হয়েছেন তৃণমূল সুপ্রিমো। এই পরিস্থিতিতে তিনি অন্যান্য জায়গায় যা বলে থাকেন আলিপুরদুয়ারে তার বাইরে কিছু বলেন নি। আলিপুরদুয়ারবাসীদের উদ্দেশ্যে মমতা সকাতরে বলেন- দলের স্থানীয় নেতাদের ব্যবহারে রেগে গিয়ে আমাকে শাস্তি দেবেন না। মমতার কথা অনুযায়ী দলের তরফে যা কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি তার জন্য দায়ী স্থানীয় নেতৃত্ব।
বুধবার আলিপুরদুয়ার জেলায় একাধিক সরকারি প্রকল্পের শিলান্যাস ও উদ্বোধন করেন মুখ্যমন্ত্রী। হাসিমারায় সুভাষিণী চা বাগানের মাঠে যোগ দেন গণবিবাহের অনুষ্ঠানেও। সেখানে ধামসা-মাদলের তালে আদিবাসী নারীদের সঙ্গে নাচেও পা মেলান মুখ্যমন্ত্রী। মমতার আলিপুরদুয়ার সফরের মধ্যেই পৃথক কোচ-কামতাপুর রাজ্যের দাবিতে অজ্ঞাত স্থান থেকে ভিডিও বার্তা দিয়েছেন কেএলও প্রধান জীবন সিংহ। মুখ্যমন্ত্রীকে হুমকি পর্যন্ত দিয়েছেন রাজ্য পুলিশের খাতায় মোস্ট ওয়ান্টেডের তালিকায় নাম থাকা এই জঙ্গি নেতা। জীবন সিংহের হিংসাত্মক রাজনীতিকে সমর্থন না করলেও তাঁর দাবিকে ন্যায্য বলেই মনে করেন জলপাইগুড়ির বিজেপি সাংসদ ডঃ জয়ন্ত রায়। উত্তরবঙ্গের রাজবংশী, আদিবাসী ও গোর্খা জনগোষ্ঠীর মধ্যে তৃণমূলের জনপ্রিয়তা হ্রাসের অন্যতম কারণ যে পৃথক রাজ্যের প্রতি তাদের সহানুভূতি, এটা মমতার অজানা নয়। আলিপুরদুয়ারে তাই মমতা বলেছেন,”বুকে বন্দুক ধরলেও বাংলা ভাগ হতে দেবো না।রবীন্দ্রনাথ, নজরুলকে ভাগ করতে পারবেন? কেউ ব্যানার্জি তো কেউ চ্যাটার্জি, কেউ রায় তো দাস, কেউ আলম তো মাস্টার, কেউ মুণ্ডা তো কেউ সর্দার। কত মানুষ কত ধর্ম। আমরা সবাই এক হয়ে থাকব।’’ বিজেপির উস্কানিতেই জীবন সিংহ বাংলা ভাগের কথা বলছে বলে আলিপুরদুয়ারে অভিযোগ করেন মমতা। মমতার কটাক্ষ- ভোট এলেই ওরা ভাগাভাগির খেলায় নামে।
আলিপুরদুয়ারের জন্য তাঁর সরকার কী কী করেছে এবং ভবিষ্যতে আরও কী কী করবে দু’দিনের সফরে বারেবারে তার খতিয়ান দেন মুখ্যমন্ত্রী। ডুয়ার্সের চা শ্রমিকদের জন্য রাজ্য সরকারের ভূমিকার কথা মনে করিয়ে দেন মমতা। তিনি বলেন,” চা বাগানে আগে আপনারা মজুরি পেতেন মাত্র ৬৭ টাকা। আমরা ২০২ টাকা করে দিয়েছি। আরও বাড়বে। যতদিন না বাড়ছে ততদিন ১৫ শতাংশ করে ইন্টেরিম রিলিফ পাবেন। চা সুন্দরীর মাধ্যমে বাড়িও তৈরি করে দিয়েছি।” পর পর দুটি নির্বাচনে ডুয়ার্সের চা বাগানের আদিবাসী বেল্ট তৃণমূলকে বিমুখ করেছে। আলিপুরদুয়ার সফরে এসে আদিবাসীদের মনে দল ও সরকারের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনতে চেষ্টার ত্রুটি রাখেন নি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুধবার মমতার দাবি- “আদিবাসীদের জমি আগে সবাই কেড়ে নিত। আমরা একটা আইন করেছি আদিবাসীদের জমি কেউ নিতে পারবে না। নিলে তা বেআইনি হবে। কোনোভাবেই নেওয়া যাবে না।” যদিও বিরোধীদের কটাক্ষ, জমির উপর আদিবাসীদের অধিকার কেন্দ্রের করা আইনের দ্বারা বহু আগে থেকেই সুরক্ষিত।
১০০ দিনের কাজের টাকা কেন্দ্রের থেকে আদায় করা এখন মমতার একটা বড় মাথাব্যথা। বিশেষ করে পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগেই বকেয়া টাকা জবকার্ডধারীদের হাতে তুলে দিতে না পারলে শাসকদল বিড়ম্বনায় পড়বে। আলিপুরদুয়ারে সরকারি অনুষ্ঠানের মঞ্চে দাঁড়িয়েও কেন্দ্রকে নিশানা করেন তৃণমূল সুপ্রিমো। তিনি বলেন,” কেন্দ্রীয় সরকার গম বন্ধ করে দিয়েছে। ১০০ দিনের কাজের টাকা বন্ধ করে দিয়েছে। গ্যাসের দাম বেড়ে কোথায় দাঁড়িয়েছে। ভোটের আগে উজ্জ্বলা দিয়েছিল, এখন কোথায়?” বিজেপিকে নিয়ে মমতার কটাক্ষ- ” ভোট যখন আসবে, বলবে আলাদা রাজ্য গড়ে দেবো। চা বাগান খুলে দেবো। আর ভোটের পর দেখুন জিনিসপত্রের দাম কোথায় পৌঁছেছে!”
লোকসভা-বিধানসভা ভোটে ডুয়ার্সের মানুষের মনে দাগ কাটতে পারে নি তৃণমূল। সামনেই পঞ্চায়েত ভোট। এরপর চব্বিশে আবার লোকসভা নির্বাচন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবার অনেক আগে থেকেই দলের দুর্বল জায়গাগুলি নিয়ে সতর্ক বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। দক্ষিণে জঙ্গলমহল সফরের পরেই উত্তরে ডুয়ার্সযাত্রা। রাজ্যের দুই প্রান্তের দুই আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাতেই মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে ড্যামেজ কন্ট্রোলের ছাপটি খুব স্পষ্ট বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। আবেগ অস্ত্রে বিক্ষুব্ধ জনগণকে বশে আনতে মমতার দক্ষতায় সংশয় নেই তাঁর রাজনৈতিক শত্রুদেরও। আলিপুরদুয়ার ছাড়ার আগে মমতা বলে এসেছেন- “আপনারা ভাল থাকলে আমিও ভাল। আপনারা খারাপ থাকলে আমি কোথায় যাব?” এখন দেখার আলিপুরদুয়ার জেলার মানুষ কেমন রাখেন মমতাকে।
Photo credit- Official FB page of Mamata Banerjee.