ভারতপন্থী রনিল দিল্লির কাছে হাত পাতবেন অবধারিত। ভারত কি পারবে চিনা ড্রাগনের তপ্ত নিঃশ্বাস থেকে দেউলিয়া প্রতিবেশীকে বাঁচাতে? লিখলেন উত্তম দেব-
ডুবতে বসা দেশকে উদ্ধারে কান্ডারীর দায়িত্ব পড়ল অভিজ্ঞ রনিল বিক্রমসিঙ্ঘের ঘাড়েই। ৭৩ বছরের রনিল এর আগে চারবার শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলেছেন। সোমবার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়েই বেপাত্তা মাহিন্দা রাজাপক্ষে। শোনা যাচ্ছে শেষ মুহুর্তে সেনাবাহিনী এসে না বাঁচালে জনরোষে পরিবার শুদ্ধ পুড়ে মরতে হত মাহিন্দাকে। ত্রিঙ্কোমালিতে নৌবাহিনীর ঘাঁটিতে নাকি পরিবারের সবাইকে নিয়ে লুকিয়ে আছেন তিনি। এক দিকে বিপর্যস্ত অর্থনীতি। অন্যদিকে লাগামহীন গণবিক্ষোভ আর হিংসা। আইনের শাসন ও সাংবিধানিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার মুখে মাহিন্দার ছেড়ে যাওয়া চেয়ারে রনিল বিক্রমসিঙ্ঘেকে বসিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে।
উদ্ধারকর্তা সেই ভারতপন্থী রনিলই
ইউএনপি জোটের কর্ণধার রনিল দ্বীপরাষ্ট্রের রাজনীতিতে বরাবরই ভারতপন্থী বলে পরিচিত। সবে শপথ শেষে দায়িত্ব নিয়েছেন। মন্ত্রিসভা এখনও তৈরি করেন নি। এর আগে চারবার শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করলেও প্রবীণ রাজনীতিবিদ ভালোই জানেন, এইবারের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। দেশ যখন রক্তক্ষয়ী গোষ্ঠী সংঘর্ষ ও গৃহযুদ্ধে জর্জরিত তখনও দু’বার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলেছেন রনিল। কিন্তু এবার যখন দায়িত্ব নিলেন তখন নাক পর্যন্ত বৈদেশিক ঋণের চোরাবালিতে ডুবে যাওয়া শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির পুরো ভিতটাই ধ্বসে গেছে। মাত্র দু’বছর আগে পার্লামেন্ট নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিলেন মাহিন্দা রাজাপক্ষে। সেই সময় মাহিন্দা জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। আর আজ হাতের কাছে পেলে তাঁকে পাগলা কুত্তার মতোন পিটিয়ে মারে ক্রোধে উন্মত্ত জনতা। মন্ত্রিসভাকে নিজের পারিবারিক কোম্পানিতে পরিণত করেছিলেন মাহিন্দা। এখন রাজাপক্ষে নামটাই লঙ্কার মানুষের মাথায় ক্রোধের আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
নতুন মন্ত্রিসভায় রাজাপক্ষে পরিবারের কারও ঠাঁই নেই
মাহিন্দার ভাই গোতাবায়া এখনও রাষ্ট্রপতি পদে টিকে আছেন। মাহিন্দার পদত্যাগের পর গোতাবায়া যখন চোখে সর্ষেফুল দেখতে দেখতে পরবর্তী মন্ত্রিসভা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছিলেন তখনই গোতাবায়াকে সবাই জানিয়ে দেয় নতুন মন্ত্রিসভার ত্রিসীমানায় রাজাপক্ষে পরিবারের কারও থাকা চলবে না। প্রাণের দায়ে বিরোধীদের শর্ত মেনে নেন মাহিন্দার ভাই। মাহিন্দা রাজাপক্ষের কুকর্মের দায় গিয়ে পড়েছে তাঁর দলের উপরেও। শ্রীলঙ্কার সবথেকে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল এসএলএফপির নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা এখন প্রাণের ভয়ে আত্মগোপনে। মাত্র দু’বছর আগে যেই দলের নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতা দখল করেছিল, আজ সেই দলের জনপ্রতিনিধিদের পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। শাসকদলের একজন এমপি গণধোলাই খেয়ে মৃত্যু অবধারিত বুঝতে পেরেই মাথায় রিভলবারের নল ঠেকিয়ে আত্মঘাতী হন।
ভারতের হাত ছেড়ে ধ্বংসের পথে লঙ্কা
মাস খানেক আগেই, রনিল বিক্রমসিঙ্ঘে যখন সংসদে বিরোধীদলের নেতা, অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে শ্রীলঙ্কাকে রক্ষা করতে ভারতের কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়েছিলেন। দ্রুত বড়লোক হয়ে ওঠার মোহতে না ধরলে ছবির মতো সুন্দর দেশটার অর্থনীতি এমনভাবে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ত না বলেই বিশেষজ্ঞদের ধারণা। তামিল ইস্যুকে কেন্দ্র করে সময় সময় প্রতিবেশি দ্বীপরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের চাপান-উতোর চললেও শ্রীলঙ্কার আপদে-বিপদে কখনও উদাসীন থাকে নি নয়াদিল্লি। ভূ-রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে এই উপমহাদেশের কোনও রাষ্ট্রের পক্ষেই ভারতের থেকে মুখ ঘুরিয়ে রাখা সম্ভব নয়। আর জোর করে রাখতে চাইলে তার ফল হয় পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কার মতো। মূলতঃ মাহিন্দা রাজাপক্ষের প্রভাবেই ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক দূরত্ব তৈরি করে শ্রীলঙ্কা। চিনের উস্কানিতে মতিভ্রম হয় মাহিন্দার। শ্রীলঙ্কায় বিনিয়োগের পরিমাণ হ্রাস পাওয়ায় ভারতের ক্ষতি নিশ্চয় হয়েছে কিন্তু ভারতের হাত ছেড়ে দিয়ে বিজয় সিংহের দেশ ধ্বংস হওয়ার মুখে।
রনিল বিক্রমসিঙ্ঘে বিচক্ষণ ও ধীরস্থির
রনিল বিক্রমসিঙ্ঘে কাকা জে আর জয়বর্ধনের মতোই বিচক্ষণ ও ঠান্ডা মাথার রাজনীতিক। তামিল ইস্যুতে প্রেসিডেন্ট জয়বর্ধনে রাজীব গান্ধীকে ঘোল খাইয়ে ছেড়েছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে এলটিটিইর সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত দীর্ঘ সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে বহু ক্ষতি স্বীকার করেছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী। এই মুহুর্তে শ্রীলঙ্কার ঘাড়ে ৫ হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের বৈদেশিক ঋণ। ফরেন রিজার্ভ তলানিতে, মাত্র ১৯১ কোটি ডলার। ঋণের সুদ মেটানোরও ক্ষমতা নেই কলম্বোর। বৈদেশিক ঋণের সিংহভাগ চিনের। এই অবস্থায় রনিল কতটুকু কী করতে পারেন এটাই দেখার।
ভারত কি পারবে শ্রীলঙ্কাকে বাঁচাতে?
রনিল বিক্রমসিঙ্ঘে শ্রীলঙ্কার দায়িত্ব নেওয়ায় সাউথ ব্লক স্বস্তিতে। শ্রীলঙ্কা ধ্বংস হয়ে গেলেও চিনের কিছু যায় আসবে না। কিন্তু পড়শী লঙ্কা পুড়লে ভারতে তার প্রভাব পড়বেই। ইতিমধ্যেই তামিলনাড়ুতে শ্রীলঙ্কা থেকে শরণার্থী ঢুকতে শুরু করেছে। রনিল ভারতের কাছে হাত পাতবেন অবধারিত। ভারত কি পারবে চিনা ড্রাগনের তপ্ত নিঃশ্বাস থেকে দেউলিয়া প্রতিবেশীকে বাঁচাতে?
Feature photo source- Official Facebook page of Ranil Wickremesinghe.