চার্লস ডারউইনই অকাট্য যুক্তির সাহায্যে প্রথম প্রমাণ করেছিলেন পৃথিবীতে সকল প্রাণের উৎস এক। বিবর্তনের মাধ্যমে সেই উৎস থেকেই মানুষের উদ্ভব।
সায়েন্স ডেস্ক :পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব ও বিকাশ নিয়ে এ যাবৎ যত মতবাদ, তত্ত্ব ও দর্শন আলোচিত হয়েছে তার মধ্যে বিবর্তনবাদই সর্বাপেক্ষা নির্ণায়ক এবং গ্রহণযোগ্য। বিজ্ঞানের ইতিহাসে কোনও মতবাদের উপর বিতর্ক, গ্রহণ-বর্জন, সংশোধন, সংযোজন, তত্ত্বের ভুল প্রমাণ এমনকি সম্পূর্ণ খারিজ হয়ে যাওয়াও নতুন কিছু নয়। বিস্তর কাঁটাছেড়া হওয়ার পরেও বিজ্ঞানের দরবারে এখনও পর্যন্ত বিবর্তনবাদ অপরাজেয়। পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব ও বিকাশের ব্যাখ্যায় বিবর্তনবাদের চেয়ে অধিকতর গ্রহণযোগ্য কোনও তত্ত্ব বা থিয়োরি এখনও পর্যন্ত বিজ্ঞানের দরবারে উপস্থাপিত হয় নি।
চার্লস রবার্ট ডারউইনকে বলা হয় বিবর্তনবাদের জনক। যদিও একা ডারউইনই বিবর্তনবাদ নিয়ে গবেষণা করেন নি। বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতো বিবর্তনবাদ নিয়েও নাড়াঘাঁটা করেছেন আরও অনেকেই। কিন্তু ডারউইনের আগে আর কেউই প্রজাতির অভিযোজন ও বিবর্তন বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা দিতে পারেন নি। চার্লস ডারউইনের ঠাকুর্দা চিকিৎসক ইরাসমাস ডারউইন ছিলেন আদি বিবর্তনবাদীদের একজন। ফরাসি বিজ্ঞানী জাঁ ব্যাপতিস্তা ল্যামার্কও বিবর্তনবাদের উপর খানিকটা আলোকপাত করেছিলেন। কিন্তু অকাট্য যুক্তির উপর দাঁড়াতে পারে নি তাঁদের গবেষণা। ডারউইনের বিবর্তনবাদের আরেক নাম ‘ন্যাচারাল সিলেকশন’ বা প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব। স্বজাতি আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস ছিলেন ডারউইনের থেকে ১৪ বছরের ছোট। প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব নিয়ে দু’জনের চিন্তাভাবনা ছিল সমসাময়িক। এই নিয়ে দুই গবেষকের মধ্যে মতের আদান-প্রদানও চলত। নিজেদের গবেষণাপত্র গুলিকে একত্রে সংকলিত করে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ করলেন ডারউইন ও ওয়ালেস। ডারউইন-ওয়ালেসের “প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব” নামে যা স্বীকৃতি পেয়েছিল বৈজ্ঞানিক মহলে। পরের বছর চার্লস ডারউইন প্রকাশ করলেন সেই মহাগ্রন্থ যার নাম- ” অন দ্য ওরিজিন অব স্পিসিস”। এই গ্রন্থই ডারউইনকে বিবর্তনবাদের জনকে পরিণত করে। একই সময়ে বিবর্তনবাদ নিয়ে গবেষণা করলেও বিবর্তনবাদের উপর ডারউইনের গবেষণার মৌলিকত্ব মেনে নেন আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস। ১৮৮৯ সালে বিবর্তনবাদ নিয়ে গবেষণাপত্র লিখতে গিয়ে ডারউইনবাদ ( Darwinism ) শব্দটি প্রথমবারের মতো ব্যবহার করেন ওয়ালেস স্বয়ং।
বিজ্ঞানে আবিষ্কার, উদ্ভাবন ও তত্ত্ব বা থিয়োরির অভাব নেই। কিন্তু মাত্র চারটি তত্ত্ব মানুষের চিন্তার জগতকে উথালপাথাল করে দিয়েছে- এক, নিকোলাস কোপারনিকাসের হেলিওসেন্ট্রিক থিয়োরি অব দ্য ইউনিভার্স। দুই, আইজ্যাক নিউটনের থিয়োরি অব গ্র্যাভিটি। তিন, অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের থিয়োরি অব রিলেটিভিটি। চার, চার্লস ডারউইনের থিয়োরি অব ইভোলিউশন বা বিবর্তনবাদ। থিয়োরি অব গ্র্যাভিটি বা থিয়োরি অব রিলেটিভিটি নিয়ে ধর্মবেত্তাদের তেমন কোনও মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু যে দুই মতবাদ প্রচারিত হওয়া মাত্র আব্রাহামিক ধর্মের বাহক ও অনুসারীদের গাত্রদাহের কারণ হল তার একটি পৃথিবী গোল ও সূর্যকে পরিক্রমা করে অপরটি বিবর্তনের মাধ্যমেই মানুষের উদ্ভব। পৃথিবী গোল ও সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে- ক্যাথলিক চার্চ ঢোক গিলে আজ এটা মেনে নিলেও বিবর্তনবাদ নিয়ে তাদের খচখচানি এই একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকেও পুরোপুরি যায় নি। আজও স্কুলে বিবর্তনবাদ পড়ানোয় প্রবল আপত্তি আমেরিকার গোঁড়া খ্রিস্টানদের। ২০১৭-য় তুরস্কে স্কুলের জীবনবিজ্ঞান বই থেকে বিবর্তনবাদ তুলে দিয়েছে সরকার। বাংলাদেশের একটি স্কুল পাঠ্যবইয়ের পাতা সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে- যেখানে ডারউইনের বিবর্তনবাদের তুলনায় কোরআন ও বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্বকেই বড় করে দেখানো হয়েছে।
আসলে ডারউইনের বিবর্তনবাদ মানলে বাইবেলে বর্ণিত সৃষ্টি তত্ত্ব মিছে হয়ে যায়। বাইবেলে বর্ণিত সৃষ্টি তত্ত্বকেই অভ্রান্ত বলে মনে করে তিন আব্রাহামিক ধর্ম খ্রিস্টান, ইহুদি ও ইসলাম। বাইবেল বলে- ঈশ্বর ছয় দিনে জগতের সকল প্রাণী সৃষ্টি করে সপ্তম দিনে নিদ্রা গিয়েছিলেন। ইহুদি ও ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা উনিশ-বিশ এটাই মেনে নিয়েছেন। ডারউইন জানতেন তিনি মৌচাকে ঢিল মেরেছেন। বিবর্তনবাদ উত্থাপিত হওয়া মাত্র ইউরোপীয় সমাজে প্রবল বিতর্কের সৃষ্টি করে। চার্লস ডারউইনই অকাট্য যুক্তির সাহায্যে প্রথম প্রমাণ করেছিলেন পৃথিবীতে সকল প্রাণের উৎস এক। বিবর্তনের মাধ্যমে সেই উৎস থেকেই মানুষের উদ্ভব। প্রজাতির বিবর্তনের ধারাকে যে ভাবে ব্যাখ্যা করে গেছেন ডারউইন তার উপর ভিত্তি করেই পৃথিবীতে প্রাণের উৎস ও বিকাশ সংক্রান্ত গবেষণাকে আরও সমৃদ্ধ করেছেন জীববিজ্ঞানীদের পরবর্তী প্রজন্ম।
জীবের জেনেটিক মিউটেশন বা জিন ঘটিত রূপান্তর সম্পর্কে কিছু জানতে পারেন নি চার্লস ডারউইন। ১৮৮২ সালে ডারউইনের মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর দুই দশক পরে প্রথম জিনের রহস্য ভেদ করেন বিজ্ঞানীরা। ডারউইন বংশানুক্রমিক বিবর্তনকে প্রমাণ করে গেলেও বংশানুক্রমিক বিবর্তনের আসল চাবিকাঠি যে জিনের হাতে তা বুঝতে পারেন নি বিবর্তনবাদের জনক। জেনেটিক্স সায়েন্সের হাত ধরেই ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের বিবর্তনবাদকে আরও নিখুঁতভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করছেন একুশ শতকের বৈজ্ঞানিক মহল।
Photo- Archives.