বগটুই গণহত্যাকে ধনখড় ‘ভয়ঙ্কর’ বলতেই খেপলেন মমতা। ২০০৭-এর ১০ নভেম্বর নন্দীগ্রামে ১০ জনের মৃত্যুর পর গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর ‘হাড়হিম করা সন্ত্রাস’ মন্তব্যের পর রাজ্যপালের ভূমিকার প্রশংসা করেছিলেন এই মমতাই।
বিশেষ প্রতিবেদন :বীরভূমের রামপুরহাটের বগটুই গ্রামে গণহত্যা। জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ হয়ে ছয় মহিলা ও দুই শিশু সমেত নিহত দশ। স্তম্ভিত গোটা রাজ্য। মধ্যযুগীয় নৃশংস বর্বরতায় দশজন নিরীহ গ্রামবাসীকে পুড়িয়ে মারার খবর কানে যাওয়া মাত্রই বিচলিত হয়ে পড়েন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়। ছুটি কাটাতে রাজ্যপাল এখন দার্জিলিঙে। দার্জিলিং থেকেই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে ট্যুইটারে একটি ভিডিও বার্তা দেন ধনখড়। আর এতেই চটেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যপালের দোষ- বগটুইয়ের হত্যাযজ্ঞকে ‘ভয়ঙ্কর হিংসার ঘটনা’ বলে বর্ণনা করেছেন তিনি। রাজ্যপালের বক্তব্যকে অনভিপ্রেত বলে দাবি করেছেন মমতা।
বগটুইয়ে ১০ জন নিরীহ নারী ও শিশু রাজনৈতিক হিংসার বলি। সোমবার রাত আটটা নাগাদ স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান ও তৃণমূল নেতা ভাদু শেখ বোমা হামলায় নিহত হন। ভাদুর বাড়ি বগটুইয়ের পূর্ব পাড়ায়। মৃত্যুর বদলা নিতে রাতেই পশ্চিম পাড়ায় হামলা চালায় ভাদু শেখের অনুগামীরা। দশটি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। বাইরে থেকে দরজায় ছিকল তুলে দিয়ে ঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলে ভেতরে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায় নারী ও শিশু সহ কমপক্ষে দশজন। মঙ্গলবার সকালের দিকে ঘটনা ধামাচাপা দিতে চেষ্টার ত্রুটি রাখে নি প্রশাসন। বেলা গড়াতে দার্জিলিঙে বসে সব খবরই পান রাজ্যপাল। ততক্ষণে তোলপাড় রাজ্য। রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান হিসেবে আর চুপ করে থাকতে পারেন নি জগদীপ ধনখড়। ভিডিয়ো বার্তায় রাজ্যপাল বলেন,“রামপুরহাটে ভয়ঙ্কর হিংসার ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনা দেখিয়ে দিচ্ছে রাজ্যে আইনের শাসন নেই। সন্ত্রাসের সংস্কৃতি চলছে।” এই ঘটনায় নিহতদের পরিবারকে সমবেদনা জানিয়ে হত্যাকান্ড সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য মুখ্যসচিবের কাছে তলব করেছেন ধনখড়।
রামপুরহাট কান্ডে রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের কড়া বার্তা হজম হয় নি মুখ্যমন্ত্রীর। রাজনৈতিক মহল মনে করেছিল এই বীভৎস ঘটনার পর হয়তো সংযত প্রতিক্রিয়া দেখাবেন তৃণমূল সুপ্রিমো। কিন্তু রাজ্যপালের ট্যুইট বার্তার কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রতিবাদ জানিয়ে রাজভবনে চিঠি পাঠান ক্ষুব্ধ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যপালের মন্তব্য তাঁকে ব্যথিত করেছে বলে চিঠিতে জানান মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী জগদীপ ধনখড়কে আরও লিখেন- “বিজেপি শাসিত রাজ্যে এমন ঘটনা ঘটনা ঘটলে আপনি নীরব থাকেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে যখনই কোনও দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে আপনি রাজ্য সরকারের সমালোচনা ও নিন্দার সুযোগ ছাড়েন না।” রাজ্যপালের মন্তব্যে নিরপেক্ষ তদন্তের কাজ ব্যাহত করবে বলেও অভিযোগ করেন মমতা। মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যপালের উদ্দেশ্যে লেখেন- ” আপনাকে এই ধরণের মন্তব্য থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করছি। প্রশাসনকে নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করতে দিন।”
তৃণমূলের সরকারের এগারো বছরের শাসনে এমন ভয়াবহ রাজনৈতিক হিংসার ঘটনা’ এই প্রথম। বাম জামানার ছোট আঙারিয়ার স্মৃতি উস্কে দেওয়া এই ঘটনায় প্রশাসনের দিকে আঙ্গুল তোলার যথেষ্টই অবকাশ আছে। বীরভূমের মতো রাজনৈতিক হানাহানিতে দীর্ণ একটি জেলায় অন্তর্দ্বন্দ্বে শাসকদলের উপপ্রধান খুন হয়ে যাওয়ার পরেও কেন পুলিশ পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকল না এই প্রশ্ন প্রশাসনের অন্দরেও উঠেছে। বিরোধীদের প্রবল দাবির পরেও বিধানসভায় এ নিয়ে টু শব্দটি করেন নি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। অথচ রাজ্যপাল ঘটনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতেই তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে প্রত্রাঘাত করতে বিলম্ব করলেন না রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান।
রাজনৈতিক মহল বলেছে, এমন নয় যে রাজ্যে এই ধরণের রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের ঘটনায় ধনখড়ই প্রথম রাজ্যপাল, যিনি প্রকাশ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দিলেন। ২০০৭– এর ১০ নভেম্বর নন্দীগ্রামে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির মিছিলের উপর সিপিএমের আক্রমণে ১০ জনের মৃত্যুর পরে একই রকম তীব্র প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধী। গোপালকৃষ্ণ গান্ধী ঘটনাটিকে ‘হাড় হিম করা সন্ত্রাস’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। সেই সময় রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধানের এই মন্তব্য শাসক সিপিএমকে খুশি না করতে পারলেও তুষ্ট করেছিল তৃণমূল নেত্রীকে। সময় পাল্টায়। শাসকও পাল্টায়। কিন্তু পাল্টায় না শাসকের মনোবৃত্তি।
Photo Credit- Twitter.