উপনিষদ জ্ঞানকে চিহ্নিত করেছে আলো রূপে। অজ্ঞানতাকে বলা হয়েছে অন্ধকার। জ্ঞানের দেবী সরস্বতীর আরেক নাম তাই জ্যোতির্ময়ী। দেবী জ্যোতির্ময়ী জ্ঞানের আলো দান করে আমাদের মনের সকল অন্ধকার ঘুচিয়ে দিন।
আজ দেবী সরস্বতীর পুজো। মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে দেবী পূজিতা হন। এই তিথি বসন্ত পঞ্চমী নামেও পরিচিত। দেবী সরস্বতীকে বলা হয় বাগদেবী। অর্থাৎ শুভ্রবর্ণা এই দেবী আমাদের বাকশক্তির নিয়ন্ত্রা। এখানে বাক অর্থ জ্ঞান। সরস্বতী নামের অর্থ জ্যোতির্ময়ী। বৈদিক ঋষিরা জ্যোতি শব্দের ওপর অতীব গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সাধারণ ভাবে ‘জ্যোতি ‘ মানে আলো। আবার জ্যোতিকেই জ্ঞান রূপে অলঙ্কৃত করেছে বেদ। বৃহদারণ্যক উপনিষদ বলছে, ‘ তমসো মা জ্যোতির্গময় ‘। অর্থাৎ হে পরমপুরুষ আমাকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে চলো। এই আলো হচ্ছে জ্ঞান। জ্ঞানের আলো। অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে জ্ঞানের আলোর দিকে যাত্রার আকুতি উপনিষদের ছত্রে ছত্রে। দেবী সরস্বতীকে বলা হচ্ছে জ্যোতির্ময়ী। অর্থাৎ তিনি জ্ঞান শক্তিতে পরিপূর্ণা।
ভারতীয় আধ্যাত্মবাদের সঙ্গে যুক্ত কোনও রূপ এবং রূপক নিয়ে আলোচনা খুব সহজ ব্যাপার নয়। এক একটি রূপের উৎস এবং মাহাত্ম্য এত বহুমাত্রিকতা সম্পন্ন যে সহজভাবে তার ব্যাখ্যা করা বেশ কঠিন। জ্ঞানসাগরে দেবীসরস্বতীকে খুঁজতেগিয়েও থই পাওয়া যায় না। তিনি আমাদের জ্ঞান, বিদ্যা, বুদ্ধি, মেধার অধিষ্ঠাত্রী দেবী। তিনি শুধু শুদ্ধজ্ঞানই প্রদান করেন না আমাদের সুবুদ্ধিও দেন। সরস্বতী বৈদিক দেবী। আমরা বাঙালিরা জগতের আদিশক্তি অনুসন্ধানে মাদুর্গা , মাকালীর শরণাপন্ন হই। এই দুই নারী মূলতঃ অভিন্না। এবং তাঁরাই আদ্যাশক্তির উৎস ও আধার। কিন্তু আমাদের পরমারাধ্যা মাদুর্গা, মাকালী বৈদিক নন। যে ধনসম্পদ এবং অর্থ বিনা জাগতিক সুখ লাভ কদাপি সম্ভব নয় তা লাভের জন্যও আমরা একজন নারীরই শরণাগত হই। সেই নারীর নাম মা লক্ষ্মী। কিন্তু তিনিও সেই অর্থে বৈদিক দেবী নন। আমরা বিদ্যার জন্য শ্বেতপদ্মে আসীন, শ্বেত রাজহংস বাহিনী, শ্বেতবসনা এবং শ্বেতবর্ণা যে নারীর কৃপা প্রার্থনা করি তাঁর উৎস এবং উদ্ভব কিন্তু পূর্ণ রূপেই বৈদিক।
ঋকবেদে আমরা দেবী সরস্বতীর বর্ণনা পাচ্ছি। ঋকবেদ বলছে ভূঃ ভুবঃ স্বঃ- এই ত্রিলোক ব্যাপী দেবী সরস্বতী প্রকাশিত জ্ঞানময়ী রূপে। সংস্কৃত ভাষায় সরস্বতীর আরেক অর্থ যাতে জল রয়েছে এমন। লুপ্ত সরস্বতী একদা ছিল বিপুলা তটিনী ও স্রোতস্বিনী। হিমালয়ের সিমুর পর্বতের প্লক্ষ প্রস্রবণ থেকে উৎসারিত এই নদী তিনশ-চারশ খ্রীস্ট পূর্বাব্দে উত্তর-পশ্চিম ভারতের বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে প্রবাহিত হত। সরস্বতী নদী ছিল বৈদিক সভ্যতার প্রাণ স্বরূপা। সপ্তসিন্ধু বাহিত বৈদিক সংস্কৃতির ছত্রে ছত্রে সরস্বতী নদীর মহিমা বর্ণিত আছে। ঋকবেদের এক জায়গায় বলা হয়েছে সরস্বতী যুগপৎ দেবীশ্রেষ্ঠা এবং নদীশ্রেষ্ঠা ‘ অম্বিতমে নদীতমে দেবীতমে সরস্বতী।’ নদীকে বলা হয় সভ্যতার প্রাণ প্রবাহিনী । প্রাণ প্রবাহিনীকে দেবতা রূপে বরণ বৈদিক তথা ভারতীয় সভ্যতার এক অনুপম বৈশিষ্ট্য। যিনি প্রাণসঞ্চারিত করেন তিনিই তো স্রষ্টা।সভ্যতায় প্রাণসঞ্চারিনী নদী তাই ভারতীয়দের কাছে ঈশ্বর রূপে পূজিতা। সরস্বতী নদীর দুই তীর জুড়ে ছিল বৈদিক ঋষিদের তপোবন, সাধনভূমি । সরস্বতীর পাড়ে চলত ঋষিদের সারস্বত চর্চা। পুণ্য সলিলা তটিনী সরস্বতীই কালক্রমে দেবী ভগবতীর রূপ পরিগ্রহ করেন বলে অনেক পন্ডিতের ধারণা।
বৈদিক শাস্ত্র মতে ব্রহ্মার সঙ্গে সরস্বতীর নিবিড় যোগ। ব্রহ্মার স্ত্রীশক্তি হিসেবে সরস্বতীকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ব্রহ্মার মুখগহ্বর থেকে সরস্বতীর উদ্ভব। আবার ব্রহ্মার কন্যা হিসেবেও সরস্বতীর পরিচিতি আছে স্কন্দ পুরাণে। অন্যদিকে ভগবান বিষ্ণুর সঙ্গেও সরস্বতীর সম্পর্ক পাচ্ছি। দেবী ভাগবত পুরাণ অনুসারে নারায়ণের জিহ্বাগ্র থেকেই দেবী সরস্বতীর উদ্ভব। নারায়ণকে পতি রূপে কামনা করায় গঙ্গা দ্বারা শাপগ্রস্তা হয়ে শিবের চতুর্থ মুখ থেকে পুনরায় আবির্ভূতা হয়ে ব্রহ্মাকে পতি রূপে গ্রহণ করেন। মার্কেন্ডেয় পুরাণেও পাই দেবী সরস্বতীকে। শ্রীশ্রী চন্ডী কর্তৃক শুম্ভ-নিশুম্ভ অসুর দ্বয় বধকালে বাগদেবী উপস্থিত অষ্টভূজা মহাসরস্বতী রূপে। অর্থাৎ মুনি-ঋষির সাধনভূমি থেকে মহামায়া দেবী চন্ডীর রণভূমি সর্বত্রই বীণাপাণি সরস্বতী উপস্থিত জ্ঞানশক্তি ও জ্ঞানদাত্রী রূপে। ভগবান বিষ্ণু কৃষ্ণ হয়ে ধরায় এসে জ্ঞানদায়িনীকে বর প্রদান করলেন। পু্রাণের এক মতানুসারে গোকূলে মাঘ মাসের শুক্লা পক্ষের পঞ্চমী তিথিতে মর্ত্যে দেবী সরস্বতীর পুজোর প্রচলন করেন শ্রীকৃষ্ণ।
বেদ-পুরাণ জুড়ে বীণাপাণি বাগদেবীর স্বরূপ ব্যাখ্যার শেষ নেই। বাঙালির তিনি মা সরস্বতী। ভারতের অন্যত্র দেবী সরস্বতীর বিগ্রহ ময়ুর বাহনা এবং তিনি চতুর্ভূজা। বীণা বাদনরতা দেবীর এক হাতে অক্ষমালা। আরেক হাতে বেদপুস্তক। রাজহংসের পৃষ্ঠে আসীনা বাঙালির সরস্বতী দ্বিভূজা। দেবীর বামহস্তে বীণা দক্ষিণ হস্তে বরাভয় মুদ্রা। বাঙালির ঘরে ঘরে আজ জ্যোতির্ময়ী সরস্বতীর আরাধনা। দেবী জ্যোতির্ময়ী জ্ঞানের আলো দান করে আমাদের মনের অন্ধকার ঘুচিয়ে দিন।
Photo- Collected.