বাঙালি মধ্যবিত্ত কৈশোরটাকে যেমনভাবে যাপন করে সেটাকে কমিকসে ঠিকঠাক চিত্রিত করতে পেরেছিলেন নারায়ণ দেবনাথ। আমাদের সবার ভেতরেই একটা নন্টেফন্টে,হাঁদাভোঁদা এবং কেল্টুদা আছে। তাই তো বাংলা কমিকস মানেই নারায়ণ দেবনাথ। বাংলা কমিকসের তিনিই সাক্ষাৎ নারায়ণ। নন্টে,ফন্টে,হাঁদা,ভোঁদার স্রষ্টাকে শ্রদ্ধার্ঘ্য –
পিসে মশাইয়ের হাতে আর ঠ্যাঙানি খাবে না দুষ্টু হাঁদা। হস্টেল সুপার পাতিরাম হাতি আর বেত ভাঙবেন না বজ্জাত কেল্টুর পশ্চাদ্দেশে। বাঁটুলের মারের চোটে আর কোনও দিনই চোখে সর্ষেফুল দেখবে না দুই বিচ্ছু শয়তান। আর কোনও দিনই হাঁদা-ভোঁদা, নন্টে-ফন্টে, বাঁটুল দি গ্রেট ও বাহাদুর বেড়ালের নতুন সিরিজ পড়ার সুযোগ পাবে না বাঙালি। স্রষ্টা বিদায় নিয়েছেন। বাংলা চিত্রকাহিনী বা কমিকসের জগতটাকে আঁধার করে দিয়ে মঙ্গলবার সকালে অনন্তের পথে রওনা হয়ে গেলেন নারায়ণ দেবনাথ। সকাল দশটা নাগাদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর।
বহুদিন থেকেই বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন বাঙালির কৈশোরকে আনন্দে ভরিয়ে তোলার অন্যতম কারিগর। বেশ কয়েক বছর ধরেই বাড়ি আর হাসপাতাল তাঁর জীবনযাত্রার অঙ্গ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু নব্বুই পার করেও অনুভূতি হারান নি। তুলে রাখেন নি হাতের স্কেচপেন আর তুলি। যতক্ষণ জ্ঞান ছিল আর হাতের আঙুল ছিল সচল ও নিষ্কম্প ততক্ষণ প্রিয় পাঠকদের হাতে তুলে দিয়ে গেছেন কমিকসের নতুন নতুন সিরিজ। হাসপাতাল থেকে ফিরেই ফের লেগে যেতেন সৃষ্টির কাজে। এবার আর ফেরা হলো না । গত ২৪ ডিসেম্বর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল নারায়ণ দেবনাথকে। ১৬ জানুয়ারি থেকে অবস্থার চরম অবনতি। ১৮ জানুয়ারি হাঁদা-ভোঁদা, নন্টে-ফন্টে-কেল্টু এবং বাচ্চা থেকে বুড়ো অসংখ্য বাঙালিকে ছেড়ে চির বিদায় নিলেন বাংলা কমিকসের নারায়ণ।
১৯২৫ সালে হাওড়ার শিবপুরে জন্ম।বাবা-কাকাদের ছিল গয়নার ব্যবসা। কৈশোরে গয়নার ডিজাইন আঁকতে আঁকতেই চিত্রশিল্পে দক্ষতা লাভ। যৌবনের শুরুতে কলকাতা আর্ট কলেজে প্রবেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধায় আর এগোয় নি পড়া। এরপর পারিবারিক পেশা নয় আর্টকে জীবিকা হিসেবে বেছে নেন নারায়ণ দেবনাথ। চাকরি নেন বিজ্ঞাপন সংস্থায়। ১৯৬২ সালে হাঁদা-ভোঁদা দিয়ে কমিকস সিরিজ শুরু করেন নারায়ণ দেবনাথ। তার অনেক আগে থেকেই অবশ্য দেব সাহিত্য কুটির থেকে প্রকাশিত শিশু সাহিত্যের পুস্তকগুলিতে ছবি আঁকতেন তিনি। ৬২তে হাঁদা-ভোঁদা ৬৫তে বাঁটুল দি গ্রেট। এই দুটোই বেরোত শুকতারা থেকে। এরপর কিশোর ভারতীর জন্য ১৯৬৯-এ তৈরি করলেন নন্টে-ফন্টে সিরিজ। বাহাদুর বেড়াল সহ নারায়ণ সৃষ্ট আরও অনেক কমিকস চরিত্র ছিল কিন্তু বাঙালির হৃদয় জয় করে নিয়েছিল বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা আর নন্টে-ফন্টের গল্প। হাঁদা-ভোঁদা , নন্টে-ফন্টে আর বাঁটুল বাঙালির শৈশব-কৈশোরের সঙ্গী। নারায়ণ দেবনাথের কমিকস পড়তে পড়তেই বুড়ো হয়ে গেলেন কতজন! বাপ ছেলেমেয়েদের ধরিয়ে দেন নেশা। দাদু থেকে নাতিনাতনি -পঞ্চাশ বছর ধরে বাঙালির তিন প্রজন্ম নারায়ণ দেবনাথের কমিকসের মজায় মুগ্ধ। হাঁদা-ভোঁদা কিম্বা নন্টেফন্টে রঙিন হল এই সেদিন। স্রেফ সাদাকালো অথবা দুই রঙেই বাঙালির শৈশব-কৈশোরকে মাতিয়ে দিয়ে গেছেন নারায়ণ দেবনাথ।
নারায়ণ দেবনাথ বাংলা চিত্রকাহিনীর জগতে বিপ্লব ঘটিয়েও সম্মান পেয়েছেন অনেক দেরিতে। ২০১৩-য় সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার এবং ২০২১-য়ে একেবারে জীবন সায়াহ্নে এসে লাভ করেন পদ্মশ্রী সম্মান। তবে আসল সম্মান পেয়েছেন পাঠকদের কাছ থেকে। ভান্ডারে রেখে গেলেন অনেক। এই ডিজিটাল যুগে অজস্র বিদেশি কার্টুনস ও কমিকস স্ট্রিপের ভিড়েও বাঙালির শৈশব-কৈশোরকে মুগ্ধ করার ক্ষমতা রাখে নারায়ণ দেবনাথের দিশি কমিকস। বাঙালি মধ্যবিত্ত কৈশোরটাকে যেমনভাবে যাপন করে সেটাকেই কমিকসে ঠিকঠাক চিত্রিত করতে পেরেছিলেন নারায়ণ দেবনাথ। আমাদের সবার ভেতরেই একটা নন্টেফন্টে , হাঁদাভোঁদা এবং কেল্টুদা ছিল,আছে। তাই তো বাংলা কমিকস মানেই নারায়ণ দেবনাথ। আবারও বলি বাংলা কমিকসের তিনিই সাক্ষাৎ নারায়ণ।
Photo Credit- Facebook page of Narayan Debnath.