– বি শে ষ প্র তি বে দ ন –
তিনি মৃদুভাষী । অনলবর্ষী ভাষণে তিনি সড়গড় নন । মঞ্চে তাঁর গলা কখনও সপ্তমে চড়ে না । নিজের মাতৃভাষায় পর্যন্ত কাঁচা । টিভিতে তাঁর মুখ দেখা যায় কদাচিৎ । সাংবাদিক সম্মেলনে মেজাজ হারানোর আদত তাঁর নেই । স্রেফ জিহ্বা দিয়ে শব্দবোমা মেরেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে জব্দ করে ফেলার ইচ্ছা এবং সামর্থ্য কোনটাই তাঁর নেই । ক্যারিশ্মাটিক জননেতা পিতার মৃত্যুর পর যখন রাজনীতিতে এলেন তখন তাঁর বয়স আধা শতক পেরিয়ে গেছে। মোট কথা ভারতবর্ষে সফল জননেতা হওয়ার জন্য যা যা ক্রাইটেরিয়া থাকা দরকার তার কোনটাই তাঁর মধ্যে মজুত বলে মনে হয় না । তারপরেও এই মুহুর্তে দেশের সবথেকে চর্চিত এবং শক্তিশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে তিনি অন্যতম । স্বাধীনোত্তর ভারতের ছয় ‘ লঙ্গেস্ট সার্ভিং চিফ মিনিস্টারস ‘ দের মধ্যে তিনি একজন । মহাকালের ইচ্ছা অন্য রকম কিছু না হলে এই তালিকার সর্বোচ্চ স্থানে আরোহণ তাঁর জন্য সময়ের অপেক্ষা মাত্র । তাঁর নাম নবীন পট্টনায়ক । প্রতিবেশী রাজ্য ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী ।
বিজু পট্টনায়ক : যতটা বড় মাপের নেতা ছিলেন ততটা সফল প্রশাসক বলা চলে না নবীনের ক্যারিশ্মাটিক পিতাকে । |
‘ পলিটিক্যাল হেভিওয়েট ‘ বলতে রাজনীতির অভিধানে যা বোঝায় আক্ষরিক অর্থেই তা ছিলেন বরং নবীনের পিতৃদেব বিজু পট্টনায়ক । ওড়িশার রাজনীতির সবথেকে আকর্ষনীয় ও জনপ্রিয় চরিত্রদের একজন ছিলেন বিজুবাবু । জাতীয় রাজনীতিতেও তাঁর ছিল সমান দাপট । পেশায় বৈমানিক , স্বভাবে দুঃসাহসী বিজু পট্টনায়ক ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন আরও একটি কারণে । জওহরলাল নেহেরুর নির্দেশে ১৯৪৭ এর ২৪ জুলাই ওলন্দাজ অধিকৃত ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা থেকে দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট মহম্মদ হাট্টা এবং প্রধানমন্ত্রী সুতান সাজারিরকে উড়িয়ে দিল্লিতে নিয়ে এসেছিলেন বিজু পট্টনায়ক । কলকাতা থেকে জাভা দ্বীপের জাকার্তা , জাকার্তা থেকে দিল্লি পর্যন্ত এই দুঃসাহসিক উড়ানে ডগলাস-47 বা ডাকোটা বিমানে বিজুর সহযাত্রী ছিলেন সহধর্মিণী জ্ঞান দেবী । জনমোহিনী ক্ষমতার সহজাত অধিকারী হওয়ার হওয়ার পরেও ঠিক সফল প্রশাসক বলা চলে না পিতাকে কিন্তু অন্তর্মুখী ও অন্তরালপ্রিয় ব্যক্তিত্ব হয়েও দেশের সফলতম মুখ্যমন্ত্রীদের একজন হয়ে উঠতে পেরেছেন পুত্র । এখানেই নবীন পট্টনায়ক সবার থেকে আলাদা। প্রচন্ড শাউটেড বা গলাবাজ অথবা প্রচারে দক্ষ না হলে শুধু ভারত কেন অন্য যে কোনও দেশেই রাজনীতিতে কল্কে পাওয়া মুশকিল । একটা সম্পূর্ণ নিজস্ব ঘরানার প্রচার কৌশল নবীনের থাকলেও গলাবাজিতে একশোতে পাস মার্ক তোলাও তাঁর পক্ষে কঠিন ।
মৃদুভাষী ,অনুচ্চারিত এবং অন্তর্মুখী হয়েও রাজনীতিতে সফল নবীন পট্টনায়ক । |
দেশের অধিকাংশ আঞ্চলিক দলের দ্বিতীয় প্রজন্মের নেতাদের মতোই নবীন পট্টনায়কের রাজনীতিতে আসাও পৈত্রিক সূত্রেই । যদিও নবীনের পিতা আঞ্চলিক দলের নেতা ছিলেন না । কিন্তু বিজুবাবুর মৃত্যুর পর জনতা দলের ওড়িশা ইউনিটকে আঞ্চলিক দলেই পরিণত করেন নবীন পট্টনায়ক । বিজু জনতা দল বা বিজেডির সুপ্রিমো হিসেবে বিজেপির সঙ্গে জোট গড়ে ২০০০ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জিতে প্রথমবারের মতো ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী হন নবীন পট্টনায়ক । পঞ্চাশ বছর বয়সে দলের হাল ধরার আগে নিজের প্রদেশের সঙ্গেই যোগসূত্র ছিল এতটাই ক্ষীণ যে নিজের মাতৃভাষাটাও শেখা হয়ে ওঠে নি বিজুবাবুর জ্যেষ্ঠ পুত্রের । একুশ বছর ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে কাটিয়ে দেওয়ার পরেও ওড়িয়ায় সড়সড় হয়ে উঠতে পারেন নি নবীন পট্টনায়ক । এত সীমাবদ্ধতার পরেও একটা মানুষ পাঁচ পাঁচটা ভোট উতরে নিজের কুর্শি অটুট রাখেন কীভাবে ?
সরকার পরিচালনার স্টাইলে প্রতিবেশী দুই রাজ্যের দুই মুখ্যমন্ত্রী যেন দুই ভিন্ন মেরুর বাসিন্দা ! |
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে মাত্র তিনটি জায়গায় মিল নবীন পট্টনায়কের । দু’জনেই গার্হস্থ্য জীবন থেকে দূরে এবং ঘরোয়া জীবনে দু’জনেরই চালচলন সাধাসিধে অনাড়ম্বর । তিন নম্বর মিল – মমতা ও বিজু দু’জনেই দল ও প্রশাসন চালান একার হাতে । এহ বাহ্য দেশের রাজনৈতিক পরিসরে বহুল আলোচিত এই দুই নেতার রাজনীতি ও সরকার পরিচালনার স্টাইলে পার্থক্য এতই বেশি যে প্রতিবেশী দুই রাজ্যের দুই মুখ্যমন্ত্রীকে দুই ভিন্ন মেরুর পলিটিশিয়ান বলাই সমীচীন। বিজেপির সঙ্গে সমঝোতা করে ওড়িশায় ক্ষমতায় এসেছিলেন নবীন পট্টনায়ক । রাজনীতিতে চিরস্থায়ী বলে কিছু নেই । বিভিন্ন ঘটনার সূত্র ধরে বিজেডি-বিজেপি বন্ধুত্ব টুটতে সময় লাগল না । ২০০৯ এ বামপন্থী সহ ছোটখাটো কয়েকটি দলের সঙ্গে জোট বেঁধে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফেরেন নবীন । ২০১৪ এবং ২০১৯ এ লড়লেন একাই এবং দু’বারই বিজুপুত্র সরকারে ফিরলেন দুই-তৃতীয়াংশের অধিক আসন নিয়ে । এর মধ্যে নবীন পট্টনায়কের জন্য সবথেকে বেশি চ্যালেঞ্জের ছিল উনিশের নির্বাচন । ঘটনাচক্রে ওড়িশায় লোকসভা-বিধানসভার নির্বাচন একসাথেই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে । একুশে বঙ্গজয়ে মোদী-শাহ জুটি যতটা শক্তি ব্যয় করেছেন তার চেয়ে কিছু কম করেন নি উনিশে উৎকল জয় করতে । আর করবেনই বা না কেন । বিজেপির লুক ইস্ট পলিসির মধ্যে অসম সহ সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাশাপাশি ওড়িশা এবং বাংলাও অন্তর্ভূক্ত । যখন সকলে ধরেই নিয়েছিল দেশ জোড়া প্রচন্ড মোদী হাওয়ার মধ্যে নবীনের বিদায় অবধারিত তখন সব অঙ্ক গুলিয়ে দিয়ে বিপুল সংখ্যাধিক্যে পঞ্চমবারের মতো ওড়িশার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করেন নবীন পট্টনায়ক ।
রাজনৈতিক লড়াইকে কখনও ব্যক্তিগত বিদ্বেষে পরিণত করেন নি নবীন পট্টনায়ক । |
নবীনের সব থেকে বড় রাজনৈতিক কৌশল হল মতান্তরকে কখনও মনান্তরে পরিণত হতে দেন না তিনি । রাজনৈতিক লড়াইকে ব্যক্তিগত বিদ্বেষে পরিণত করেন না নবীন । ওড়িশার রাজ্য রাজনীতিতে এখন বিজেডির প্রধান প্রতিপক্ষ বিজেপি । বিধানসভার প্রধান বিরোধীদল বিজেপি । কিন্তু জাতীয় রাজনীতিতে , লোকসভা-রাজ্যসভার ভেতরে এনডিএ’র বাইরে কোনও দলের সঙ্গে যদি কেন্দ্রের শাসক দলের সবথেকে বেশি বোঝাপড়া থেকে থাকে তবে তা নবীন পট্টনায়কের বিজেডি । নবীন পট্টনায়কের দলের কাছে বিজেপির বিরাট ব্যবধানে পরাজয়ের পরেও নবীনের সঙ্গে কোনও ইগোর লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েন নি নরেন্দ্র মোদী কিম্বা অমিত শাহ । সেই পরিস্থিতিই তৈরি হতে দেন নি ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী । তাঁর ফলে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কে ছাপ ফেলতে পারে নি ওড়িশার ঘরোয়া রাজনীতি । কেন্দ্র-রাজ্য সুসম্পর্কের জন্য যে ডাবল ইঞ্জিন সরকার অপরিহার্য নয় তার বড় প্রমাণ ওড়িশা রাজ্য । বিজেপি ওড়িশার প্রধান বিরোধী দল হওয়ার পরেও বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক এড়িয়ে যাওয়ার জন্য কোনও ছুঁতো খুঁজতে হয় না নবীন পট্টনায়ককে । দুন স্কুলে শিক্ষাপ্রাপ্ত নবীনের ব্যক্তিত্বের মধ্যে এমন একটি পলিটিক্যাল সফিস্টিকেশন আছে , যার গুণে কারও প্রতি দাঁত কিড়মিড় করা শত্রুতা না রেখেও তার থেকে রাজনৈতিক ভাবে নিজেকে আলাদা রাখতে কোনও অসুবিধা হয় না মৃদুভাষী মানুষটার । নবীনের কাছ থেকে কারও কারও কিছু শেখার তো আছে অবশ্যই ।
Photo Credits- Mint /AFP, Odisha Live , orissadiary.com and india whispers.