নাগরিক প্রতিবেদন : ওরা সুইপার । ওরা স্ক্যাভেঞ্জার । ওরা সাফাইকর্মী । ওরা মেথর – জমাদার । ইদানিং খাতির করে ভদ্রলোকেরা এদের পরিচ্ছন্নতাকর্মী , স্বচ্ছতাকর্মী প্রভৃতি নামেও ডেকে থাকেন । কয়েক বছর ধরে দেশ জুড়ে স্বচ্ছ ভারত অভিযান চলছে ঘটা করে । বাংলায় নির্মল বাংলার ঢক্কানিনাদ । বিশেষ বিশেষ দিবসে ঝাড়ু হাতে স্বচ্ছ ভারতের শো অফ করতে রাস্তায় , রেলস্টেশনে নামতে দেখা যায় মন্ত্রী-আমলা থেকে সেলিব্রেটিদেরও । ওইটুকুই আমাদের প্রাপ্তি । নইলে স্বচ্ছ ভারত অভিযানের ঠ্যালায় জনজীবনে কতটা স্বচ্ছতাবোধ এসেছে পথেঘাটে তার অজস্র নমুনা চব্বিশ ঘন্টাই বিদ্যমান । শখে আর ছবি তুলতে ঝাড়ু ধরা নয় , যারা পেটের তাগিদে ভারতকে স্বচ্ছ রাখতে রোজ নালা-নর্দমা- সেপটিক ট্যাঙ্কে নামেন সরকারের স্বচ্ছ ভারত কিম্বা নির্মল বাংলা অভিযান কিন্তু তাদের জীবনের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ ।
সমাজে অনেক পেশাই আছে যা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করতে হয় । অনেকেরই হয়তো উপযুক্ত পারিশ্রমিকের পাশাপাশি কর্মস্থলে যথেষ্ট নিরাপত্তাও জোটে । কারণ তাদের ক্ষেত্রে সমাজের মানুষ এবং সরকারের মধ্যে এইটুকু অন্ততঃ সচেতনতা থাকে যে কাজটা বিপজ্জনক । আমাদের সাফাইকর্মীরা অতটা ভাগ্যবান নন । একে তো ভারতীয় সমাজে যারা অন্ত্যজদের মধ্যেও অন্ত্যজ বংশানুক্রমিকভাবে তাদের ভাগ্যেই জুটেছে নোংরা-ময়লা-পুরীষ সাফাইয়ের কাজ । এই সেদিন পর্যন্ত তাদের মনুষ্য পদবাচ্য বলেই গণ্য করত না সমাজের ভদ্দরলোকেরা । এখনও কতটুকু করি , মন থেকে আদৌ তাদের সহনাগরিক বলে ভাবি কিনা বিবেকের কাছে এই প্রশ্ন করার সময় এসে গেছে । নালা-নর্দমার পরিস্কার করার কাজটা যে সময় সময় ভারি বিপজ্জনক আমরা ক’জন তা ভাবি ? তাদের সরকারি-বেসরকারি নিয়োগকর্তারা ভাবেন ? ভেবে থাকলে এই প্রযুক্তিনির্ভর অত্যাধুনিক যুগেও কেন ভূগর্ভস্থ নর্দমা কিম্বা সেপটিক ট্যাংক পরিস্কার করার সময় বেঘোরে মরতে হয় সাফাইকর্মীদের ?
বৃহস্পতিবার সকালে কলকাতার কুঁদঘাট এলাকায় ম্যানহোল খুলে নিকাশি নালা সাফ করতে গিয়ে মৃত্যু হল চারজন সাফাইকর্মীর । মৃতদের তিনজন একই মায়ের সন্তান । বাইশ থেকে আঠাশ বছরের চার-চারটা জোয়ান ছেলে ভূগর্ভস্থ নালায় কাজ করতে নেমে আর জীবিত ফিরল না ।বিষাক্ত মিথেন গ্যাসের ছোবল প্রাণ কেড়ে নিল তাদের । নিকাশি নালা ও সেপটিক ট্যাংক পরিস্কার কালে দেশে সাফাইকর্মীদের মৃত্যু কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় । কেন্দ্রীয় সামাজিক ন্যায় ও স্বশক্তিকরণ দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী রামদাস আথাওয়ালে ২০২০ ‘ র ১১ই ফেব্রুয়ারি সংসদে যে তথ্য পেশ করেছেন তা চমকে ওঠার মতোই । অবশ্য যদি আমরা মনে করে থাকি যে মেথরদের বেঘোরে মৃত্যুতেও চমকে ওঠার মতো কোন কারণ থাকতে পারে ।
সরকারি পরিসংখ্যান বলছে নালা-নর্দমা-সেপটিক ট্যাঙ্ক পরিস্কার করতে নেমে দেশে ২০১৯য়ে প্রাণ হারিয়েছেন মোট ১১০জন শ্রমিক । ২০১৮ তে সংখ্যাটা ছিল ৬৮ । মাত্র একবছরের ব্যবধানে কর্মস্থলে সাফাইকর্মীদের দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু হার ৬২ শতাংশ বেড়ে গেছে ! সবথেকে চিন্তার বিষয়, সাফাইকর্মীদের দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনা দিনের পর দিন বাড়ছে এবং এই প্রযুক্তিনির্ভর যুগেও কর্মস্থলে তাদের মৃত্যু ঝুঁকি হ্রাসের মতো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হচ্ছে সরকার । একটি হিসেবে দেখা গেছে ভারতে গত এক দশকে কাজ করার সময় দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১ হাজার ৮৫০ জন সাফাইকর্মী ।
ম্যানহোলে কিম্বা সেপটিক ট্যাংকে নেমে সরকারি কিম্বা বেসরকারি সাফাইকর্মীদের মৃত্যুর খবর ২৪ ঘন্টা পরেই সবাই ভুলে যায় । যারা কাজটি করছে তাদের সামাজিক অবস্থান এখনও এতটাই খারাপ যে নিজেদের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে যাওয়াটা তাদের কাছে বিলাসিতা মাত্র । পুরসভা – কর্পোরেশনের মতো সরকারি এজেন্সি কিম্বা বেসরকারি ঠিকাদারি সংস্থা – যারাই সাফাইকর্মীদের কাজে লাগায় নিজেদের কর্মীদের সুরক্ষা দিতে তাদের আন্তরিক আগ্রহ থাকলে এক বছরে শতাধিক সাফাই কর্মচারীর বেঘোরে মৃত্যু হত না ।
Photo Credit – Frontline , Business Standard and the free press journal