ভোট আসছে , বুক কাঁপছে ! পশ্চিমবঙ্গে হিংসামুক্ত রাজনীতি কেন সম্ভব নয় ? অন্য রাজ্য পারলে বাংলা কেন নয় ? - nagariknewz.com

ভোট আসছে , বুক কাঁপছে ! পশ্চিমবঙ্গে হিংসামুক্ত রাজনীতি কেন সম্ভব নয় ? অন্য রাজ্য পারলে বাংলা কেন নয় ?


 

                                   উত্তম দেব


ভারতীয় রাজনীতিতে টাকার খেলা , জনপ্রতিনিধি কেনাবেচা এবং দলবদল নতুন কোনও ঘটনা নয় । আয়ারাম গয়ারাম জমানার শুরু হিন্দি বলয়ে সেই সাতষট্টি সালেই  । আর রাজনীতিতে হিংসা বিশেষ করে নির্বাচন কেন্দ্রিক অশান্তির সূত্রপাত‌ও সত্তরের দশক থেকে । এটা বললাম গোটা দেশের প্রেক্ষিতে । এবার আসি পশ্চিমবঙ্গের কথায় । পোয়েট্রি এবং পলিটিক্সে বাঙালি বরাবরই অত্যুৎসাহী । কিন্তু রাজনৈতিক হিংসা বলতে যা বোঝায় সত্তরের আগে পশ্চিমবঙ্গে তা দেখা যায় নি । রাজপথে আন্দোলনের সময়  প্রশাসন বনাম বিরোধী দলের সংঘাত অন্য জিনিস। বিরোধীদের মিছিলে লাঠিচার্জ , টিয়ারগ্যাস , গুলি পঞ্চাশ-বাহান্নতেও হয়েছে । উনষাটের খাদ্য আন্দোলনে ৩১ আগষ্ট কলকাতার রাস্তায় পুলিশের হাতে ‌৮০ জনের মৃত্যু হয়েছিল । সেটা ছিল একটা গণ অভ্যুত্থানের মতো ঘটনা ।   কিন্তু এক দলের কর্মী আরেক দলের কর্মীকে খুন করছে  এমনকি দলের ভেতরে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে লাশ পড়ে যাচ্ছে , এমন পরিস্থিতি ৬৭-৬৮ পর্যন্ত  বাংলায় দেখা যায় নি । লাঠালাঠি , হাতাহাতি পর্যন্ত হয়তো গড়িয়েছে কিন্তু প্রতিপক্ষকে  একেবারে খুন করে দেওয়ার মানসিকতা তখনও আসে নি।  পুরোনো দিনের সংবাদপত্র গুলো খুলে দেখুন ,এইসব খবর  পাবেন না ।

নিঃসন্দেহে রাজনীতিতে ব্যক্তি হত্যার সূচনা করেছিল নকশালরা । দলের ভেতরে বিপ্লবের নামে ব্যক্তি হত্যার রাজনীতিতে অনুমোদন দিয়েছিলেন  খোদ চারু মজুমদার । সিপিআই(এম এল ) এর ভেতর অনেকেই  ‘ খতমের লাইন‘ এর বিরোধিতা করলেও দলে পাত্তা পান নি বরং সাধারণ নকশালপন্থীরা খতমের নেশায় মেতে ওঠে । এর পরিণাম হয়েছিল ভয়াবহ । বিপ্লবের নামে এরা গ্রামের বড় কৃষককে খুন করল । ডিউটি সেরে বাড়ির পথে ফেরা ট্রাফিক সার্জেন্টকে খুন করল । প্রাণ নিল উপাচার্যের‌ও । দলীয় পর্যায়ে  খুনোখুনিটা শুরু হয়েছিল নকশাল ভার্সেস সিপিএম দিয়ে । সিপিএমের অভিযোগ সেই সময় কংগ্রেস‌ও নকশাল সেজে দলের বহু কর্মীকে খতম করেছে । এই জন্য ‘ কংশাল‘ বলে একটা শব্দ সত্তরের দশকের বাজারে চালু করেছিল সিপিএম ।

চারু মজুমদারের ‘ খতমের লাইন ‘ দিয়েই বাংলায় হত্যার রাজনীতির সূত্রপাত 

সত্তর-একাত্তর-বাহাত্তর — এই তিনটি বছর পশ্চিমবঙ্গের সমাজজীবন সন্ত্রাস আর নৈরাজ্যের অমানিশায় ডুবে গিয়েছিল । সন্ত্রাস , রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস  আর  বহুমাত্রিক রাজনৈতিক খুনোখুনিতে জেরবার হয়ে গিয়েছিল রাজ্যটা । নকশালের ছেলেরা সিপিএমের ছেলের গলা নামাচ্ছে । সিপিএম পাল্টা নকশাল মেরে বদলা নিচ্ছে । কখনও ফর‌ওয়ার্ড ব্লক আর সিপিএমে লেগে যাচ্ছে । কোনও গ্রামে এস‌ইউসি- সিপিএমে লড়াই বেঁধে যাচ্ছে । কোথাও সিপিএম ভার্সেস সিপিআই পর্যন্ত । কোথাও এস‌ইউসি-আর‌এসপিতেও মারামারি করে মরেছে । এই রকম গোলমেলে পরিস্থিতিতে‌ই একাত্তরের ২০ ফেব্রুয়ারি কলকাতার রাস্তায় প্রকাশ্য দিবালোকে খুন হয়ে গেলেন প্রবাদপ্রতিম ফর‌ওয়ার্ড ব্লক নেতা হেমন্ত বসু । যেই হত্যাকান্ড আজ‌ও রহস্যাবৃত ।

হেমন্ত বসুর হত্যারহস্যের কোনও সমাধান হয় নি

এই অভিশপ্ত হননকালে কংগ্রেস একাত্তরের শেষে বাংলাদেশ যুদ্ধের আগে পর্যন্ত বেশ  ব্যাকফুটেই ছিল বলা যায়। বাংলাদেশ যুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধীর অভাবনীয় সাফল্য পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসকে ফের উজ্জীবিত করে । ততদিনে মেরেধরে  নকশাল আন্দোলনকেও অনেকটাই বাগে নিয়ে এসেছেন  ইন্দিরা ।  রাষ্ট্রপতির শাসনাধীনে ১৯৭২ এর ১১ই মার্চ পশ্চিমবঙ্গে যে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেটাকে কলঙ্কিত করল কংগ্রেস । এই ভোট থেকেই  ‘ রিগিং ‘ শব্দের সঙ্গে পরিচিত হল বাঙালি । তার আগে ভোটে অল্পস্বল্প কারচুপি হলেও অবাধে ছাপ্পা , বুথ দখল , বিরোধী দলের এজেন্টকে ঠেঙিয়ে তুলে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল না । ভোটের দিন দুপুরের মধ্যে মারের চোটে বুথ ছেড়ে পালাল সিপিএম সহ  বিরোধীরা । বরানগরে জ্যোতি বসু পর্যন্ত হাত তুলে দিলেন !  অথচ সেবার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দৌলতে  হাওয়া কংগ্রেসের  এতটাই অনুকূলে ছিল যে বিন্দুমাত্র গোলমাল না করেই সিদ্ধার্থশংকর রায়ের  দল অনায়াসে‌ ভোটে জিতে যেত ।

সত্তর-একাত্তরের  পশ্চিমবঙ্গ ছিল লাল সন্ত্রাসের , যার সূচনা করেছিল নকশালদের ভুল রাজনীতি । বাহাত্তরে আসরে নামল কংগ্রেস । শুরু হল শাসক দলের সন্ত্রাস ও জবরদস্তির যুগ ।  বাংলার রাজনীতিতে ততদিনে বোমা , পাইপগান , ওয়ান শাটার কালচার পাকাপাকি ভাবে চলে এসেছে । নীতি আদর্শ থেকে দশহাত দূরে থাকা   মস্তানরা পার্টির ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিল । রুলিং পার্টির নেতার হাত মাথায় থাকলে এলাকার মানুষকে গরম দিয়ে টু পাইস কামানো যায় – এই রহস্যটাও যুব সমাজ জেনে ফেলল বাহাত্তর সাল থেকেই । বাহাত্তর থেকে সাতাত্তর – গ্রামে গ্রামে , পাড়ায় পাড়ায় সিপিএমের বহু কর্মী ঘরছাড়া হয়েছিলেন । রাজনৈতিক খুনখারাবি ততদিনে বাংলার সমাজজীবনের অঙ্গ হয়ে গেছে । অর্থাৎ সত্তরের একটি দশক জুড়ে ধীরে ধীরে  বাঙালি রপ্ত করল,  যে আমার রাজনৈতিক বিরোধী তাকে হত্যা করা যায় । যে অন্য দলের পতাকা বহন করে তাকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়া যায় । কেউ অন্য দলকে ভোট দিতে পারে এই আভাস পাওয়া মাত্র‌ই তার ঠ্যাঙটি মেরে ভেঙে দেওয়া যায় ।

সাতাত্তরে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এল । কিন্তু বাংলার রাজনৈতিক সংস্কৃতি কি বদলাল ? সত্তর- একাত্তরের ‘ রেইন অব টেরর ‘ ফিরে আসে নি কিন্তু রাজনীতিতে হিংসার আবাদ অব্যাহত থাকল । বামপন্থীরা শ্রেণী চরিত্র , শ্রেণী সংগ্রামের কথা বলে রাজনীতিতে হিংসাকে বৈধতা দেওয়ার একটা  চেষ্টা করেন । কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক সংঘর্ষে কখনও  শ্রেণী শত্রু মারা পড়ে না । এখানে দরিদ্র বামপন্থী  দরিদ্র দক্ষিণপন্থীকে খুন করে । রাজনৈতিক শত্রুতা থেকে মানুষ প্রতিবেশীর ঘরে আগুন দেয় । গ্রামের দশঘর মিলে তিনঘরকে গ্রামছাড়া করে শুধু এই কারণেই যে তিন ঘরের তেরোজন তাদের পাট্টিকে ভোট দেয় নি ।

গ্রাম ছাড়া করার রাজনীতি , গ্রাম দখল করার রাজনীতি । বুথ থেকে বিরোধী দলের এজেন্টকে মেরে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার রাজনীতি । শুধু জেতা নয় দলের প্রার্থীকে রেকর্ড মার্জিনে জিতিয়ে আনার রাজনীতি । প্রতিপক্ষকে স্পেস না দেওয়ার এইসব  রাজনীতি সিপিএম করেছে । এখন তৃণমূল করছে ।  গোটা ভারতবর্ষের দিকে তাকিয়ে দেখুন । প্রদেশে প্রদেশে অনেক রকমের জটিল সমস্যা আছে । সামাজিক হিংসা আছে । জাতিগোষ্ঠীগত অশান্তি আছে । রাজনীতিতে টাকার খেলাও আছে ।  কিন্তু রাজনৈতিক হিংসা কমে এসেছে । অথচ ছিল । ভোটের দিন বিহার , ইউপি , হরিয়ানায় রক্তগঙ্গা ব‌ইত । ” ছাপ্পা ” শব্দটাই বিহারের বাহুবলীদের দান ।  বুথ দখল করে অবাধে ব্যালট পেপারে ছাপ মারা হত বলে ” ছাপ্পা” । যে ‘ গোবলয় ‘ নিয়ে  সংস্কৃতিমনা রুচিশীল বাঙালির এত নাক কোঁচকানি সেই গোবলয়েও এখন বিনা রক্তপাতে লোকসভা-বিধানসভার  ভোটপর্ব মিটছে । এমনকি পুরসভা -পঞ্চায়েতের মতো স্থানীয় নির্বাচনে‌ও মারামারি বন্ধ হয়ে গেছে । পশ্চিমবঙ্গ পারছে না কেন ? রাজনৈতিক হিংসায় লাগাম টানতে কেন‌ পারছে না পশ্চিমবঙ্গ ?

রাজনৈতিক  হিংসায় আজ বিহার-ইউপিকেও লজ্জায় ফেলছে বাংলা

বিধানসভা নির্বাচনের দিন যত এগোচ্ছে আর আমাদের ভয় তত‌ই  বাড়ছে । রাজনৈতিক নেতাদের ভাষণ ” মারব এখানে লাশ পড়বে শ্মশানে ” স্টাইলের । মিডিয়া এই ধরণের বক্তব্যকেই বেশি হাইলাইটস দিচ্ছে । বেপরোয়া নেতারা দ্বিগুণ উৎসাহে মুখে কুকথার ফোয়ারা ছোটাচ্ছে । রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী । তিনিও কিনা মেজাজ হারিয়ে মঞ্চে তুই তোকারি করছেন ! রাজ্য জুড়ে সারা বছরই রাজনৈতিক হানাহানি রোজকার ঘটনা । ভোট এগিয়ে আসতেই তা সংখ্যায়‌  বাড়ছে । এবং শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা অনুমান করেই শিউড়ে উঠছেন অনেকে । একটা মানুষ মরে গেলে নেতাদের কিছু না। কিন্তু একটা সংসার অন্ধকার হয়ে যায় । জোয়ান ছেলে পার্টি করতে গিয়ে লাশ হয়ে ঘরে ফেরে । নেতারা মৃতদেহে মালা চড়িয়ে কনভয় হাঁকিয়ে ফিরে আসেন। বুড়ো বাপমায়ের বাকি জীবন কাটে বিলাপ করে । লাশের পাহাড়ে চড়ে ক্ষমতার চেয়ারে গিয়ে যাঁরা বসেন তাঁদের কানে পুত্রহারা বাপ-মা , স্বামীহারা বিধবা , বাপহারা ছেলেমেয়েদের কান্না পৌঁছায় না ।

রাজনৈতিক নেতাদের সদিচ্ছা থাকলে ভোট মরশুম হিংসামুক্ত রাখা সম্ভব । কিন্তু সদিচ্ছা দেখাতে গেলে সৎ সাহস লাগে । গদিই যেখানে পাখির চোখ সেখানে সৎ সাহস দেখিয়ে আহাম্মক সাজতে রাজি কোন নেতানেত্রী , দাদাদিদি ? আর নাগরিক সমাজের মাথা বুদ্ধিজীবী কূল ?  এই রাজ্যে বুদ্ধিজীবী বলে যাঁদের চালানো হয় বহু আগেই তাঁদের দু’কান কাটা গেছে । পারিতোষিকভোগী এই বুদ্ধিজীবীরা এখন সদর্পে রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটেন । রাজ্য রসাতলে ডুবতে বসলেও কেউ সরকার প্রধানের কানের কাছে গিয়ে বলবে না, ‘দোহাই আপনার,  জেতা হারা তুচ্ছ । সবাইকে নিয়ে বসে এমন সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি করুন যেখানে রাজনীতি চলবে , তর্কবিতর্ক থাকবে , পক্ষবিপক্ষ থাকবে , ভোট‌ হবে ,সব হবে  । কিন্তু কোনও মায়ের কোল খালি হবে না । ‘

পশ্চিমবঙ্গে  কবে থামবে রাজনৈতিক হিংসার পরম্পরা ?

 


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *