দাওয়াত নিয়ে মুখ খুলে নিজের দাওয়ায় কি খাল কেটে কুমিরই আনলেন শুভাপ্রসন্ন? শুভার কটাক্ষ মাইন্ডে নিয়েছেন নেত্রী। লিখলেন নির্বাণ রায়-
শিল্পী শুভাপ্রসন্ন হঠাৎ করে কপালে শনি ডেকে আনতে গেলেন কেন, কে জানে। ভাষা দিবসের অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে শুভার সুখের জীবনে অশুভ যোগের সূত্রপাত। পানি, দাওয়াত, গোসল অথবা নাস্তার মতো শব্দ বাংলা ভাষায় জেঁকে বসা নিয়ে শুভাপ্রসন্নের আপত্তি। পানি সংস্কৃত পানীয় থেকে এলেও দাওয়াত ও গোসল আরবি শব্দ। নাস্তা এসেছে ফার্সি থেকে। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি জাতিধর্ম নির্বিশেষে নিমন্ত্রণকে নিমন্ত্রণই বলে দাওয়াত নয়। গোসলে নয় আমরা স্নানে যাই। সকালে উঠে জলখাবারকে ‘টিফিন’ হিসেবে যদিও বা খাই নাস্তা কদাপি নয়। পানি সংস্কৃত হলেও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির বলতে জিভে আটকায় বৈকি।
আমরা সবাই জানি পানি, দাওয়াত, গোসল ও নাস্তা- এই চারটি শব্দই বাংলাদেশের বাংলাভাষী মানুষের মুখের লব্জ। বাংলাদেশের বাঙালিহিন্দু আবার এই চারটি শব্দ ব্যবহারে মোটেই স্বচ্ছন্দ্য নয়। সামাজিক জীবনে দায়ে পড়ে বাংলাদেশের হিন্দুরা দাওয়াত, গোসল কিম্বা পানি বলতে বাধ্য হলেও পারিবারিক পরিসরে এইসব শব্দ এড়িয়ে চলতেই ভালবাসে। দাওয়াত, গোসল ও নাস্তার গায়ে যে ধর্মের ছোঁয়াচ আছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। যেখানে ধর্ম সেখানেই স্পর্শকাতরতা। শুভাপ্রসন্ন মনে করেন, সাম্প্রদায়িক গন্ধযুক্ত এই শব্দগুলি বাংলা ভাষায় জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। শুধু শুভা নয় আরও অনেকেরই এমন অভিযোগ। হঠাৎ করে এ’পারের দৈনন্দিন জীবনেও যেন নিমন্ত্রণ ফেলে ‘দাওয়াতে’ যাওয়া, স্নান বাদ দিয়ে ‘গোসল’ করা এবং জলখাবার ফেলে ‘নাস্তা-পানি’ সারতেই একটু বেশি পছন্দ করছেন কেউ কেউ।
একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠান মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতেই বোমাটি ফাটিয়েছেন শুভাপ্রসন্ন। দাওয়াত-গোসলের হঠাৎ বাড়াবাড়িতে তিনি যে বিরক্ত, তা গোপন রাখেন নি শিল্পী। বক্তৃতা দিতে উঠে তাঁর শুভাদার দাওয়াত-গোসল বিষয়ক অভিযোগকে খন্ডন করতে দেরি করেন নি মমতা। পরদিন মিডিয়ায় মমতার এই অবস্থানকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে কটাক্ষ করেন শুভাপ্রসন্ন। দাওয়াত-গোসল বিতর্কে তৃণমূলপন্থী অপর দুই বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী ও কবি সুবোধ সরকার মমতার পাশে দাঁড়ানোয় দু’জনকেই ‘তেলবাজ’ বলে চাটতে ছাড়েন নি শুভা।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোন রাজনৈতিক অঙ্কে শিল্পী শুভাপ্রসন্নের দাওয়াত-গোসল মন্তব্যে অপ্রসন্ন হলেন, তা সবার কাছেই পরিস্কার। বিতর্কের সূত্রপাত হওয়ার পর তিনদিন পেরিয়ে গেছে। নিজের অবস্থানে এখনও অনড় শুভাপ্রসন্ন। শুভাপ্রসন্ন সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম জামানা থেকেই তৃণমূলপন্থী বিদ্বজ্জনদের মধ্যমণি বলা যায়। বাম আমলে শুভাপ্রসন্নের সল্টলেকের বাড়ি ছিল বিরোধী নেতাদের আলাপ-আলোচনার ঠেক। শলাপরামর্শ করতে মমতাও সেখানে বহুবার গেছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী হয়েই রেলকে দিয়ে শুভাপ্রসন্নের ছবি অনেক টাকা দাম দিয়ে কিনিয়েছেন। আর ২০১১-য় পালা বদলের পর তৃণমূলপন্থী বিদ্বজ্জনদের মধ্যে শুভাপ্রসন্নই সবথেকে বেশি লাভবান হয়েছেন বলে খবর। সারদা মামলায় শাসকদলের একাধিক নেতা-মন্ত্রীর সঙ্গে শিল্পী শুভাপ্রসন্নেরও নাম জড়িয়ে যায়। বারকয়েক ইডি-সিবিআই ডাকাডাকি করলেও শেষ পর্যন্ত শুভাপ্রসন্নকে জেলে যেতে হয় নি।
টিভি চ্যানেলের প্যানেল ডিসকাশনে মমতার বিরুদ্ধে সামান্য অভিযোগ শুনলেই তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠা শুভা হঠাৎ কেন ক্ষেপে উঠলেন? গত কয়েক বছরে রাজ্যের তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। নিয়োগ দুর্নীতিতে ফেঁসে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মতো হেভিওয়েট মন্ত্রী পর্যন্ত জেলে গেলেন। কোনও ঘটনাই শিল্পী শুভাপ্রসন্নের মনকে অপ্রসন্ন করে তুলতে পারে নি। কিন্তু দাওয়াত, গোসল, পানি নিয়ে বিতর্ক উস্কে দিয়ে তৃণমূলেরে অন্দরে আচমকাই একঘরে হয়ে পড়লেন শুভাপ্রসন্ন। বিরূপ সমালোচনা সহজভাবে নেন না মুখ্যমন্ত্রী। দল ও সরকার যখন নিয়োগ দুর্নীতি সহ নানা ইস্যুতে চরম ব্যতিব্যস্ত তখন শুভাপ্রসন্নের তোলা বিতর্ককে উটকো ঝামেলা বলেই নাকি মনে করছেন মমতা। শুভার কাছে অপমানিত সুবোধ-নৃসিংহপ্রসাদও একটা হেস্তনেস্ত চেয়ে কালীঘাটে হত্যে দিয়ে এসেছেন বলে খবর। কোনও সন্দেহ নেই যে চিত্রশিল্পী শুভাপ্রসন্নের সঙ্গে মমতার খাতির বহু পুরোনো। কিন্তু কেউ কোনও কারণে চক্ষুশূল হয়ে পড়লে মমতা যে তাঁর হাড়মাস কালি করে ছাড়েন, ভুক্তভোগী মাত্রেই তা জানেন। শুভাপ্রসন্নেরও মমতার কোপানলে পড়ার সময় চলে এসেছে বলে তৃণমূলের অন্দরে জোর গুঞ্জন।
ইতিমধ্যেই আসরে নেমে গেছেন কুণাল ঘোষ। কুণালের সঙ্গে শুভাপ্রসন্নের একদফা চোটপাট হয়ে গেছে বলে মিডিয়ায় খবর। ফোনে বাতচিত চলাকালে কুণাল ক্ষেপে গিয়ে শুভাকে কাঁচা খিস্তি পর্যন্ত করেছেন। শুভাপ্রসন্নকে যে তিনি খিস্তিয়েছেন, সংবাদ মাধ্যমের কাছে তা গোপন করেন নি কুণাল। জমির প্লট বা পদ পাওয়ার লোভেই শুভাপ্রসন্ন মমতার বিরোধিতা শুরু করেছেন বলে প্রকাশ্যে বলতে ছাড়েন নি কুণাল। তৃণমূলের নেতা ও তৃণমূলপন্থী বিদ্বজ্জনদের মধ্যে যাঁদের সঙ্গে এখনও কুণাল ঘোষের হিসেব মেটানো বাকি, তাঁদের মধ্যে শুভাপ্রসন্নও একজন। সারদা মামলায় ফেঁসে গিয়েও তৃণমূল শিবিরের যাঁরা বেঁচে গিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে শুভাপ্রসন্নও আছেন। পক্ষান্তরে কুণালকে দীর্ঘ জেলযন্ত্রণা সইতে হয়েছে। এখন দৈবের বশে শুভা মমতার ব্যাডবুকে আসতেই কুণাল ঘোষ যে তাঁকে ডোবাতে উঠেপড়ে লাগবেন, তা জানা কথাই। কুণাল ঘোষ প্রকাশ্যে শুভাপ্রসন্ন সম্পর্কে যা বলেছেন, তা যথেষ্টই অপমানজনক। কুণাল বলেছেন, “একটা স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে শুভাপ্রসন্ন একটু বাড়াবাড়ি করছেন। ভাষা দিবসের ঘটনা নিয়ে নতুন করে মমতাদিকে ভুল প্রমাণ করতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। দলের কারও উচিত ওঁর সঙ্গে কথা বলা। জমি না কমিটির পদ লাগবে, এটা জেনে নিলেই ঝামেলা মিটে যাবে।”
তৃণমূলের অন্দরে অনেকেই চাপা স্বরে বলাবলি করছেন, দাওয়াত-ফাওয়াত নিয়ে মুখ খুলে নিজের দাওয়ায় খাল কেটে কুমিরই আনলেন শুভাপ্রসন্ন। শুভার কটাক্ষ মাইন্ডে নিয়েছেন নেত্রী। ওদিকে শুভার বিরুদ্ধে কালীঘাটে ধুনো দেওয়ারও লোকের অভাব নেই তৃণমূলে। অনেকেই অনেক কারণে ‘দেমাকি’ শুভাপ্রসন্নের ওপর খাড়। শুভাকে কোনঠাসা করতে তাঁর অতীত দিনের কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি ঘাঁটা দেওয়ার প্রস্তুতি নাকি ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে শাসকদলের ভেতরে। তেনার সুরে সুর মিলিয়ে সব দিক গুছিয়ে দিব্যিই তো ছিলেন। ৭৫ বছর বয়সে এসে হঠাৎ বেসুরো হয়ে কী বিড়ম্বনাতেই না পড়লেন শুভাপ্রসন্ন!
Feature image is representational.