তাঁর দেহাবসানের পরপরই বাংলার যুবশক্তি কীভাবে মৃত্যুঞ্জয়ী মহামন্ত্রে জেগে উঠেছিল ভাবলে আশ্চর্য লাগে। বাংলার দামাল বিপ্লবীরা সকলেই ছিলেন স্বামীজির ভাবশিষ্য। বিবেকানন্দকে না পেলে আমরা বীর সুভাষকে পেতাম না। আবির্ভাব দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি-
জীর্ণ-জড়-অচলকে যুগধর্মের প্লাবনে ভাসিয়ে নিয়ে সমাজে নতুনের আবাহন করেন যে যুগপুরুষেরা, তাঁরা ছক ভাঙেন। বাঁধা গত ভাঙেন। ছক না ভাঙলে বন্ধ্যা সমাজের অন্ধকার গর্ভে আলোর সঞ্চার হয় না। স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন প্র্যাক্টিকাল বেদান্তের বিপ্লবী সন্ন্যাসী। তাঁর মধ্যে পাই সূর্যের সাত রঙ। গৃহী, যোগী, ভক্ত, বিপ্লবী, দেশপ্রেমিক, সমাজসেবী, রাষ্ট্রনেতা, খেলোয়াড়, যোদ্ধা, ছাত্র, যুবক, উদ্যোগপতি,সংগঠক– উত্তাল জীবন সমুদ্রে সবার জন্যই লাইট হাউস হয়ে দেখা দেন স্বামী বিবেকানন্দ। স্বামীজির জীবনচরিতে বিরোধাভাস আছে। কিন্তু এই বিরোধাভাস বিবেকানন্দের নাতিদীর্ঘ জীবনকে আরও বেশি অনবদ্য, অনুপম, বর্ণময় করে তুলেছে।
কর্ম থেকে পালিয়ে সমাধিতে লীন হওয়ার বাসনা বিবেকানন্দের মধ্যে শৈশব থেকেই প্রবল। গুরু রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের কাছে চাইতেনও তেমন। কিন্তু গুরু জানতেন, তাঁর লরেনকে লোকশিক্ষে দিতে হবে। কর্মের থেকে যত পিছন ফিরতে গিয়েছেন, হয়তো গুরুর ইচ্ছেতেই কর্ম ততই টেনে ধরেছে স্বামীজিকে। গুরুভ্রাতা-শিষ্য-ভক্তদের কাছে আক্ষেপ করেছেন যে, কর্ম তাঁকে বেঁধে ফেলেছে। কিন্তু কাজ শেষ না করে বিশ্রাম নেন নি। বিবেকানন্দের জীবনী পাঠ করলেই আমরা বুঝতে পারব রক্তমাংসের মানুষটার আরেক নাম ‘সাইক্লোন’। স্বজাতির স্বভাব আলস্য তাঁর মধ্যে ছিল না। মর্ত্যের আলো দেখার পর মাত্র ৩৯ বছর ৫ মাস ২৪ দিন ছিল মানুষটির পরমায়ু। কখনও কোনও কাজ ফেলে রাখেন নি। গুরুভ্রাতারা ফেলে রাখলে তাঁদের বকাঝকা করতেন। শরীর ছাড়ার দু’দিন আগেও বলেছেন, ‘এই বেলুড়ে যে আধ্যাত্মিক শক্তির ক্রিয়া শুরু হয়েছে, তা দেড় হাজার বছর ধরে চলবে-তা একটা বিরাট বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ নেবে।‘ এই সেই সন্ন্যাসী যিনি মানুষকে ডেকে বলেছেন, ‘তোমার মধ্যেই অনন্ত শক্তি। তুমি চাইলে সব কিছুই করতে পার।’ বিবেকানন্দকে আবিষ্কার করতে পারলে জগতের চরম দুর্বল মানুষও হতাশ হবে না। বিবেকানন্দের আরেক নাম তাই শক্তি। শক্তির কখনও মৃত্যু হয় না।
মহাপ্রস্থানের ৯৪ দিন আগে ভগিনী নিবেদিতাকে বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘আমার যা দেবার ছিল তা দিয়ে ফেলেছি , এখন আমাকে যেতেই হবে।‘ তিনি দেশকে কী দিয়েছেন, সমকালীন সমাজ তার মূল্যায়ণ করতে পারে নি। তাঁর স্বজাতি বাঙালি তো নয়ই। ৫ জুলাই কলকাতার কোনও সংবাদপত্রে স্বামী বিবেকানন্দের দেহাবসানের সংবাদ বের হয় নি। স্বামীজির স্মরণসভায় সভাপতিত্বের প্রস্তাব পর্যন্ত প্রত্যাখ্যান করেছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের দু’জন বিচারপতি। একজন তো এমনও বলেছিলেন, হিন্দু রাজা দেশ শাসন করলে তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হত। আজ ভাবা যায়! সমকালীন লোকসমাজের স্থূলচক্ষে বোধ হয় এমনি করেই বিপ্লবী যুগপুরুষদের উপেক্ষা জোটে। যুগে যুগে বিপ্লবীর জন্য তো ফাঁসির মঞ্চই যোগ্যতম স্থান। স্বামীজি তো বিপ্লবীই! স্বামী বিবেকানন্দই ভারতীয় জাতীয়তাবাদের অগ্নিসন্তানদের, মৃত্যুঞ্জয়ী বীর বিপ্লবীদের পিতা,গুরু,মন্ত্রদাতা।
পরাধীন, পরাঙ্মুখ, হতগৌরব জাতির সামনে স্বামী বিবেকানন্দ যে ভূমিকা রেখেছিলেন ভারতের কোনও সমকালীন রাষ্ট্রনেতারই তা সাধ্যে কুলোয় নি। অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের সামনে স্বামীজিই ছিলেন একমাত্র জীবন্ত অনুপ্রেরণা। ততদিনে তাঁর দেহ গেছে। কিন্তু শক্তিটা ছড়িয়ে পড়েছে শতশত যুবকের মধ্যে। নিদ্রিত ভারতকে জাগিয়ে তোলাই ছিল স্বামীজির স্বপ্ন এবং সাধনা। তাঁর দেহাবসানের পরপরই বাংলার যুবশক্তি কীভাবে মৃত্যুঞ্জয়ী মহামন্ত্রে জেগে উঠেছিল ভাবলে আশ্চর্য লাগে। বাংলার দামাল বিপ্লবীরা সকলেই ছিলেন স্বামীজির ভাবশিষ্য। বিবেকানন্দকে না পেলে আমরা মনে হয় বীর সুভাষকে পেতাম না।
স্বামী বিবেকানন্দকে যারা একসময় পাশ কাটিয়ে গেছে আজ ঠেকায় পড়ে তারা সবাই তাঁরই শরণাপন্ন হয়েছে । বিবেকানন্দর বাণীতে নিজেদের রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাচ্ছে তারা। পাবে না ! বিশ্বনাথ দত্তের অকালপ্রয়াত পুত্রটি যে সবার গুরু, গাইড এবং রেমেডি।
স্বামীজি ছিলেন দ্রষ্টা। ভবিষৎ বিপ্লবকে তিনি যেন চোখের সামনে দেখতে পেতেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্তিম লগ্নে যখন গোটা চিন আফিমে ডুবে, যখন চিনের উত্থানের চিন্তা কারও স্বপ্নেও ছিল না তখন বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ইংরেজ ডুববেই , চিন জাগবে। স্বামীজি বলছেন,” কেহ যদি ভগবানের প্রতিশোধে বিশ্বাস নাও করে, ইতিহাসের প্রতিশোধে বিশ্বাস করতেই হবে। আর এ-প্রতিশোধ ইংরেজের উপর নেমে আসবেই। তারা পা দিয়ে আমাদের ঘাড় চেপে রেখেছে। তারা নিজেদের স্ফূর্তির জন্য আমাদের শেষ রক্তবিন্দু চুষে খেয়েছে। তারা আমাদের কোটি কোটি টাকা লুটে নিয়েছে।আর আমাদের গ্রামের পর গ্রাম প্রদেশের পর প্রদেশ অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। এখন চীনারা পড়বে তাদের উপর প্রতিশোধরূপে- আর এতে ন্যায়সঙ্গত বিচার ছাড়া আর কিছুই হবে না।” স্বামীজি শিষ্যা ভগিনী কৃস্টিন তাঁর গ্রন্থ ‘ রেমিনিসেন্সেস অব স্বামী বিবেকানন্দ‘র এক জায়গায় লিখছেন তাঁর গুরু সম্পর্কে – ”তাঁকে মনে হতো, তিনি যেন ভবিষ্যদ্রষ্টা ঋষিরূপে বিরাজমান; এমনিভাবে একদিন তিনি এই কথাগুলি বলে আমাদের চমকে দিয়েছিলেন- এরপর যে বিরাট অভ্যুত্থানের ফলে নবযুগের সূত্রপাত হবে, তা আসবে রাশিয়া বা চীন থেকে। ঠিক যে কোন দেশ তা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি না-তবে তা রাশিয়া বা চীনই হবে।” আবার এই বিবেকানন্দই বলে গেছেন- ”ইংরেজরা চলিয়া যাইবার পর চীনদেশ হইতে ভারতাক্রমণের একটা বড় আশঙ্কা রহিয়াছে।” এইসব ভবিষ্যদ্বাণী পরিব্রাজক বিবেকানন্দ করছেন আমেরিকা-ইউরোপ ভ্রমণকালে উনবিংশ শতাব্দীর অন্তিমক্ষণে দাঁড়িয়ে। বিংশ শতাব্দীর ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে কতটা নির্ভুল ছিল স্বামীজির পূর্বাভাস।
ভারতের দলিতদের দুঃখকষ্ট, নিপীড়ন দেখে বিপ্লবী সন্ন্যাসী বলেছিলেন, “চলমান শ্মশান”, ”ভারবাহী পশু”! আবার তিনিই বলেছেন সমাজে “শূদ্র জাগরণ” অবশ্যম্ভাবী। দ্রষ্টা ঋষি বলছেন- “তথাপি এমন সময় আসিবে, যখন শূদ্রত্বসহিত শূদ্রের প্রাধান্য হইবে, অর্থাৎ বৈশ্যত্ব ক্ষত্রিয়ত্ব লাভ করিয়া শূদ্রজাতি যে প্রকার বলবীর্য বিকাশ করিতেছে তাহা নহে, শূদ্রধর্মকর্ম-সহিত সর্বদেশের শূদ্রেরা সমাজে একাধিপত্য লাভ করিবে। তাহারই পূর্বাভাসচ্ছটা পাশ্চাত্য জগতে ধীরে ধীরে উদিত হইতেছে এবং সকলে তাহার ফলাফল ভাবিয়া ব্যাকুল।” স্বামী বিবেকানন্দকে যারা একসময় পাশ কাটিয়ে গেছে আজ ঠেকায় পড়ে তারা সবাই তাঁরই শরণাপন্ন হয়েছে । বিবেকানন্দর বাণীতে নিজেদের রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাচ্ছে তারা। পাবে না! বিশ্বনাথ দত্তের অকালপ্রয়াত পুত্রটি যে সবার গুরু, গাইড এবং রেমেডি।
Photo- Archives.