ভাদ্রের সংক্রান্তিতে বাংলা জুড়ে চলছে যন্ত্রের দেবতা বিশ্বকর্মার পূজা। বিশ্বকর্মাদেবের পূজা দিয়েই বাঙালির দীর্ঘ মহোৎসবের সূচনা। বাঙালির পরম্পরার সঙ্গে বিশ্বকর্মা কীভাবে জড়িয়ে আছেন, পড়ুন ঋতুপর্ণা কোলের লেখায়-
বিশ্বকর্মার সঙ্গে আমাদের প্রথাগত পরিচয় ঋকবেদে হলেও বিশ্বকর্মার ইতিহাস নিহিত আরও প্রাচীনকালে, বেদপূর্ব যুগে। ‘পূজা পার্বণের উৎসকথা‘ গ্রন্থে লেখক পল্লব সেনগুপ্ত এই দেবতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে লিখছেন, “ঋকবেদের মন্ত্রে যদিও অনেকবারই বিশ্বকর্মার উল্লেখ পাওয়া যায় এবং পরবর্তীকালে তিনি পুরাণেও স্থান পেয়েছেন, তবু মূলত প্রাগার্যভাষী জনপদনিবাসী জাতিগোষ্ঠীরই উপাসিত দেবতা বলে গণ্য করাই সঙ্গত”। কারণ হিসাবে তিনি বলতে চেয়েছেন বেদে বিশ্বকর্মার পরিচয় ‘বিশ্বব্রহ্মান্ডের স্রষ্টারূপে‘ কিন্তু প্রকৃতভাবে তিনি স্থাপত্যবিদ্যা, যন্ত্রবিদ্যার অধিষ্ঠাতা। আর্যজাতির প্রচলিত পরিচয় যাযাবর জাতি হিসাবে। সে জাতির কাছে যন্ত্রপাতির চর্চা থাকলেও, স্থাপত্যবিদ্যার চর্চা খানিক অসম্ভব। সেদিক দিয়ে তুলনামূলক প্রাচীনতা খানিক অনুমিত।
বাঙালির বিশ্বকর্মাও বাঙালির নিজের মতো
অতি সরলীকৃতভাবে বিশ্বকর্মার পরিচয় বলতে বোঝায়, তিনি দেব সাম্রাজ্যের হেড অফ দি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট। সারাভারত ভূমিতে বিশ্বকর্মা পূজিত হন একেবারে একটি নির্দিষ্ট দিনে, ভাদ্র সংক্রান্তিতে। ভাদ্রের শেষ দিনটি বিশেষভাবেই বিশ্বকর্মার পায়ে অর্পিত। বঙ্গদেশে বিশ্বকর্মার পূজা প্রচলন কবে থেকে তা সঠিক কাল নিরূপন সম্ভব নয়। তবে বিশ্বকর্মা যে বেশ প্রভাবসম্পন্ন, প্রাচীন, প্রচলিত দেবতা তার প্রমাণ বা সাক্ষ্য দেয় মঙ্গলকাব্যগুলি। বাঙালির মৌলিক উপাদান, একেবারেই নিজের নিজস্ব উপাদান নিয়ে লেখা বললে সবার প্রথমে স্মরণ করতেই হয় লৌকিক মঙ্গলকাব্যগুলিকে অর্থাৎ মনসামঙ্গল, চন্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল ইত্যাদি। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের প্রেক্ষিতে প্রাচীনযুগের একমাত্র সাহিত্যিক নিদির্শনকে বাদ দিলে সমগ্র মধ্যযুগে মূলত যে সাহিত্যধারাগুলি প্রচলিত ছিলো লৌকিক মঙ্গলকাব্য ছাড়া বাকি ধারাগুলির একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল কাব্যগুলি বাংলার জল হাওয়ায় পরিপুষ্ট হলেও, চরিত্ররা হাজার বাঙালি হয়ে গেলেও অস্বীকার করার উপায় নেই অযোধ্যা, মথুরা, বৃন্দাবন ইত্যাদি স্থানিক নামগুলো বাংলার নয়। তবে চৈতন্য পরবর্তী যুগের অবদান, ব্যক্তি চৈতন্য দেবের জীবনকেন্দ্রিক জীবনী সাহিত্যগুলি একেবারেই স্বতন্ত্র। বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসকে শ্রীচৈতন্যদেবের মানদন্ডে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করাযেতে পারে ১) প্রাক চৈতন্য যুগ ২) চৈতন্য সমসাময়িক যুগ ৩) চৈতন্য পরবর্তী যুগ। মঙ্গলকাব্য অবশ্যই প্রাক চৈতন্য যুগের অবদান, তার ধারাবাহিকতা রয়ে গেছে চৈতন্য পরবর্তীযুগেও। এবার বিশ্বকর্মা পূজার প্রসঙ্গে ফেরা যাক। খানিক চিনে নেওয়া যাক বাঙালির কাছে বিশ্বকর্মা কীভাবে ধরা দিয়েছেন। ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য‘- কথাটি যদি সারা ভারতের জন্য সত্য হয়, বাঙালির জন্য তবে সত্য ঐক্যের মধ্যে বৈচিত্র্য। বাঙালি সমস্ত গ্রহণ, বর্জনের ভিতর দিয়েও নির্মাণ করে চলে নিজস্ব ঘরানা, নিজস্ব রীতি; বলা ভালো নিজস্বতার তুলি দিয়ে এঁকে চলে সবকিছুকে। চরিত্র যাই হোক, যেখানকারই হোক না কেনো বাঙালি আদর্শে, বাংলার জল মাটির স্পর্শে তা সম্পূর্ণ বাঙালি হয়ে ওঠে। জন্মাষ্টমী অর্থাৎ কৃষ্ণের জন্ম তিথি। মথুরা নগরের কারাগারে তাঁর জন্ম, পালিত হয়েছেন বৃন্দাবনে, সেই কৃষ্ণের জন্মদিন পালনে বাঙালি অবশ্যভাবে ভোগের জন্য তৈরি করে তালের বড়া, আট কড়াই ভাজা ইত্যাদি যা একেবারেই বাঙালিয়ানার পরিচায়ক। বিশ্বকর্মাও তেমনি। বাঙালির ঐতিহ্য সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গেছে একান্ত ভাবে।
মঙ্গলকাব্যে পাই বিশ্বকর্মার বহু বর্ণনা
মঙ্গলকাব্যের সাক্ষ্য নিয়ে আজ খোঁজার চেষ্টা করব দেবতা বিশ্বকর্মার সেই বাঙালি সত্তাটিকে। মঙ্গলকাব্যের ওপর গুরুত্ব দেবার কারণ বাংলার যত টেক্সট আছে তার মধ্যে মঙ্গলকাব্যেই সব থেকে বেশি এসেছে বিশ্বকর্মা প্রসঙ্গ। ‘বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস‘ গ্রন্থে শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য লিখেছেন, “বিশ্বকর্মা মঠ–মন্দির নির্মাণের কার্য হইতে দেবীগণের কাঁচুলি নির্মাণের পর্যন্ত ভার লইয়াছেন। এই দুই (বিশ্বকর্মা ও বানর) পৌরাণিক চরিত্রকে দিয়া মঙ্গলকাব্যের কবিগণ অসম্ভাবিত কার্য করাইয়াছেন”। বাংলা সাহিত্যর ইতিহাসের মধ্যযুগ নিয়ে বলতে গেলে বারবার মনে হয় চরম সংকটের কাল। সকল প্রতিকূলতাকে সঙ্গে নিয়ে, তাদের সাথে লড়াই করেও নিজের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখার কাল এই মধ্যযুগ। ‘অন্ধকার যুগের‘ ধাক্কা সহ্য করে আবার বাঙালি রুখে দাঁড়িয়েছে, আবার কলম ধরেছে। সাতদিন ধরে কেবল বিক্রমশীলা পুড়ে যায়নি, পুড়েছিলো একটি জাতির ইতিহাস, একটি জাতির শিকড়। সেখান থেকে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন বাঙালি কবিরা, শুরু করেছেন পথ চলা। নিজের ভাষায়, নিজের মনের কথা বলা যদি এতই সহজ হত তবে কেবল চর্যাপদেই থেমে থাকত না আমাদের প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস। বাংলা ভাষাকে নিজের মাটি অর্জন করতে হয়েছে, লড়াই করতে হয়েছে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের সঙ্গে, লড়াই করতে হয়েছে ইসলামের সঙ্গে। সংস্কৃত, আরবি, ফার্সির নাগপাশ থেকে নিজেকে মুক্ত করে আপন অস্তিত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়েছে। এসময় লেখা হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, শ্রীকৃষ্ণবিজয়, রামায়ণের অনুবাদ, মহাভারতের অনুবাদ, পদাবলী সাহিত্য ইত্যাদি এবং লেখা হচ্ছে লৌকিক মঙ্গলকাব্য। বিশ্বাসের কেন্দ্রস্থল অর্জনে লেখার বা লিখিত রূপের আলাদা গুরুত্ব আছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। সেদিক থেকে যখন একের পর এক পৌরাণিক দেব–দেবীরা সেই জায়গা দখল করতে শুরু করে দিয়েছে তখন লৌকিক দেব–দেবীর অস্তিত্বরক্ষার বিশেষ প্রয়োজন ধরা দিলো বাঙালি কবিদের কাছে। সুতরাং বলাই যায় পৌরাণিক দেবতাদের প্রতিস্পর্ধী হয়ে আপন সত্তাকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই এই লৌকিক মঙ্গলকাব্যগুলি। সে ভয়ে ভক্তি হোক বা ভালোবেসে, ভক্তি আদায়ের জন্য একটা লিখিতরূপ ভীষণ প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। প্রাক চৈতন্যযুগ থেকে চৈতন্য পরবর্তী যুগের প্রায় সব মঙ্গলকাব্যেই প্রধান দেব বা দেবীর সহকারী দেবতা হিসাবে বিশ্বকর্মার স্থান অত্যন্ত উজ্জ্বল। অর্থাৎ লৌকিক দেব দেবীকে প্রতিষ্ঠা দেবার লড়াইয়ে কাব্যের কবিদের সঙ্গে সমান তালে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন বিশ্বকর্মা। দেবী চণ্ডীর কাঁচুলী নির্মাণ থেকে বেহুলা– লখীন্দরের বাসর নির্মাণ, পুরী, নগর, নৌকা, টোপর, ফলা প্রভৃতি নির্মাণ এবং তাহাদিগের চিত্রকরণের কার্য সবই বিশ্বকর্মার কীর্তি। সেকারণেই শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, “প্রত্যেক শিল্পকর্মের গুরুই বিশ্বকর্মা– স্থাপত্য–শিল্প হইতে আরম্ভ করিয়া সূক্ষ্মতম চিত্রকলাও বিশ্বকর্মারই কার্য। মঙ্গলকাব্যের সকল শিল্পকীর্তিই বিশ্বকর্মার নামে উৎসর্গীকৃত হইয়াছে”।
বাঙালির বিশ্বকর্মা বিগ্রহে আছে স্বাতন্ত্র্য
কেবল শিল্পকীর্তিই নয় বাঙালির এক প্রকার আত্মপরিচয় নির্মাণের অনেকটাই বিশ্বকর্মাকে উৎসর্গ করা যায়। বিশ্বকর্মার মূর্তি নিয়ে আলোচনা করলে সারা ভারতের সঙ্গে বাঙালির আরাধ্য মূর্তিটির ফারাক অত্যন্ত স্পষ্ট। শাস্ত্রীয় মতানুসারে বিশ্বকর্মা ‘অবরোহী ব্রহ্ম‘। বাংলা ব্যতীত বিশ্বকর্মার যে রূপ পূজিত হয় সেখানে মূর্তির মধ্যে ব্রহ্মার রূপের সঙ্গে অসম্ভব মিল লক্ষিত হয়। এবং সেই বিশ্বকর্মার বাহন হাঁস। বাংলার বিশ্বকর্মার সঙ্গে দেব সেনাপতি, চিরযুবক কার্তিকের মিল দেখা যায়। আর বাহন হাতি। যুবক মূর্তি আর বাহনের এমন তারতম্যের কয়েকটি কারণ অনুমান করা যায় বাঙালির চোখে বিশ্বকর্মা সবচেয়ে বড় ইঞ্জিনিয়ার, যিনি শ্রমজীবী মানুষের প্রতিনিধি সেক্ষেত্রে বয়স্ক মূর্তির থেকে সুঠাম গঠন অনেক বেশি কাম্য বলেই মনে করা যেতে পারে। অপরদিকে হাতিকে সুজলা সুফলা সময়ের পরিচায়ক বলে মনে করা হয়। যে বছর মা দূর্গা হাতিতে আসেন দেশের ও দশের পক্ষের তা অত্যন্ত সুসময় বলে গণ্য করা হয়। ভাদ্র সংক্রান্তিতে বিশ্বকর্মার পূজা। বৃহৎ সংহিতাতে বলা হয়েছে, “গ্রীষ্মান্তে যে সূর্য মেঘ রচনা করে বর্ষণের মাধ্যমে বিশ্বের কর্ম (অর্থাৎ কৃষি) সংরক্ষণ করেন তিনিই হলেন বিশ্বকর্মা” (পূজা পার্বনের উৎসকথা, পল্লব সেনগুপ্ত)। অর্থাৎ কেবল শ্রমজীবী নয় কৃষিজীবী মানুষেরও নিজের দেবতা বিশ্বকর্মা। পশ্চিমবাংলায় মূলত রাঢ় বাংলায় এই দিন যন্ত্রপাতি পূজার পাশাপাশি রান্না পূজার প্রচলন আছে যা শস্য উৎসবকেই স্মরণ করায়। ফলে সবদিক দিয়ে বিচার করে বলাই যায় বাঙালির বিশ্বকর্মার রূপ, বিশ্বকর্মার অস্ত্র এবং বিশ্বকর্মার বাহন নির্মাণ করেছে স্বতন্ত্রতা।
বাংলা বিশ্বকর্মার সৃষ্টি!
লেখক পল্লব সেনগুপ্ত তাঁর বই–এ বিশ্বকর্মাকে দেখতে চেয়েছেন, “মেহনতী মানুষের নিজস্ব দেবতা” হিসাবে। কিন্তু আমরা সেটুকুতে আবদ্ধ না থেকে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত এভাবেও ভাবতে পারি, যে সমগ্র বাংলাদেশের নির্মাতাই হলেন বিশ্বকর্মা। ‘বুড়ো আংলা‘য় তিনি লিখছেন, “বিশ্বকর্মার ছিষ্টি বাঙলাদেশ দেখে বিশ্বামিত্র এবারে নিন্দা করতে পারলেন না, চমৎকার! সুজলা সুফলা–বীজ ছড়ালেই ফসল, কোথাও উঁচু–নীচু এবড়ো খেবড়ো পাহাড়– পর্বত নেই বললেই হয়, যতদূর চোখ চলে সবুজ ক্ষেত আর জলা”। বাঙালির আত্মপরিচয়ের অন্বেষনের প্রেক্ষিতে বাংলার নির্মাতা বিশ্বকর্মাকে স্মরণ করেই আজ আরও খানিক এগিয়ে চলা যাক শেকড়ের পথে।
ছবি- সংগৃহীত।
- লেখক পরিচিতি : ঋতুপর্ণা কোলে। পিএইচডি গবেষক, বাংলা বিভাগ, অসম বিশ্ববিদ্যালয়।