শ্রাবণ মানেই শিবঠাকুরের মাস। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে জল্পেশ্বর আর দক্ষিণে তারকেশ্বর- শ্রাবণ মাস জুড়েই ভক্তের ভিড়ে জমজমাট দুই শৈব মহাপীঠ। শ্রাবণের প্রতি সোমবার একসূত্রে বাঁধা পড়ে বাংলার দুই বিন্দু।লিখলেন ঋতুপর্ণা কোলে-
শ্রাবণ মাস মানেই শিবের মাস। সারাভারতের নানাপ্রান্তে এসময় শিব মন্দিরকে কেন্দ্র করে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। পশ্চিমবঙ্গ সেদিক থেকে ব্যতিক্রম নয়। উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ির জল্পেশ মন্দিরে এবং দক্ষিণবঙ্গের হুগলি জেলার তারকেশ্বর মন্দিরে শ্রাবণ মাসে লাখ লাখ ভক্তের সমাগম হয়। মন্দিরের চারপাশের এলাকা মেলার আকার নেয়। করোনা অতিমারির কারণে পরপর দুবছর মেলা বন্ধ রাখার পর এবছর থেকে ভক্তদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে দুই মন্দিরই। প্রথম সোমবারই ভক্তদের ভিড় ছিলো চোখে পড়ার মতো।
কৃষি সংস্কৃতির অঙ্গ
শ্রাবণ মাসে শিবমন্দিরে গিয়ে শিবলিঙ্গে জলঢালার প্রথা আসলে কৃষিসংস্কৃতিকেই স্মরণ করায়। বর্ষাকালে পৃথিবী পাহাড় পর্বতকে বৃষ্টিতে স্নান করায় সেই জল নীচে গড়িয়ে গিয়ে নদী নালাকে পুষ্ট করে চারিদিককে শস্য-শ্যমলা করে তোলে। মানুষ এই ঘটনার এক অনুকরণ আচরণ করে বৃষ্টিকে আহ্বান করে কৃষিকাজ সূচনার পূর্বে, শস্য বপনের আগে। পৃথিবীমাতৃকা স্বরূপ ঘড়া থেকে পাহাড় আকৃতি স্বরূপ শিবলিঙ্গে জল ঢালা হয়। উত্তরভারতে এসময় হয় ‘হরিয়ালি তিজ’ নাম থেকেই কৃষি সংস্কৃতির উৎসব স্পষ্ট। উত্তরভারত থেকেই বাংলায় শিবকে ঘিরে শ্রাবণ মাসের উৎসব প্রবেশ করলেও বর্তমানে বাংলার নানা শৈবক্ষেত্রে মহাধুমধাম করে পালিত হয় গোটা শ্রাবণ মাস জুড়ে শ্রাবণী মেলা। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য উত্তরবঙ্গের জল্পেশ্বর এবং দক্ষিণবঙ্গের তারকেশ্বর।
উত্তরে বাবা জল্পেশ্বর
জল্পেশ্বর মন্দিরের প্রধান মেলা বললে শিবরাত্রির মেলার কথাই সবার প্রথম মাথায় আসে কারণ বাংলার প্রাচীন মেলাগুলির মধ্যে এটি একটি। মন্দিরের ইতিহাস-ও খুব প্রাচীন। কালিকাপুরাণেও এই মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায়। জল্পেশ্বর-টেম্পল কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত “জল্পেশ্বর মন্দিরের ইতিবৃত্ত” গ্রন্থ অনুসারে বর্মণ বংশের শেষ রাজা জল্পেশ্বর বর্মণ এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন আনুমানিক ৮০০ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ। এ মন্দিরটি নানা সময় বিজাতীয় আগ্রাসনের শিকার হয়ে বারবার ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। প্রথমবার ত্রয়োদশ শতক নাগাদ ধ্বংসের কারণ হিসাবে অনুমান করা হয় মহম্মদ তোঘলকের নাম। ১৬৬৩ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ কোচবিহারের রাজা প্রাণনারায়ণ মন্দিরটি পুনরায় প্রতিষ্ঠা করেন। এই পুনরায় প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে প্রমাণিত হয় মধ্যেকার ৮০০বছরেও পূজা প্রচলিত ছিলই। প্রাণনারায়ণের নির্মাণ করা মন্দিরই এখন দেখতে পাওয়া যায়। সেসময় থেকেই শিবরাত্রির সময় এখানে মেলা বসলেও আধুনিক কালে গোটা শ্রাবণমাস জুড়েই এই মন্দিরে ঘটে বিপুল জন সমাগম। জল্পেশ্বরের অনাদি শিবলিঙ্গ বাইরে থেকে দৃশ্যমান নয়। মন্দিরের গর্ভগৃহে গৌরীপট্টের ২ফুট নিচে একটি কূপে এঁর অবস্থান। সিঁড়ি দিয়ে ১০ফুট নিচে নেমে তবেই মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করা সম্ভব। তিস্তা নদী থেকে বাঁক কাঁধে জল এনে শিবের মাথায় ঢালেন ভক্তরা।
দক্ষিণে বাবা তারকেশ্বর
অপরদিকে তারকেশ্বর মন্দিরটি হুগলি জেলার তারকেশ্বরে অবস্থিত। মন্দিরটি জল্পেশ্বরের মন্দিরের থেকে অর্বাচীন। ১৭২৯ সালে ভারমল্ল রাজা মন্দিরটি নির্মাণ করে। এই মন্দিরে গাজন, শিবরাত্রির পাশাপাশি শ্রাবণীমেলা অত্যন্ত জনপ্রিয়। শ্রাবণীমেলা শুরুর ইতিহাস সেভাবে পাওয়া না গেলেও ১৯৭৭ সালে সন্ধ্যা রায় ও বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায় অভিনীত ‘বাবা তারকনাথ’ সিনেমাটির পর থেকেই মন্দিরটির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। তবে দক্ষিণ বঙ্গের উল্লেখযোগ্য শিব মন্দিরের মধ্যে এই মন্দিরকে প্রধান বলা যায়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পল্লীসমাজ’ উপন্যাসে এই মন্দিরের উল্লেখ আছে পাশাপাশি রামকৃষ্ণ, সারদা দেবীর জীবনী থেকে জানা যায় দক্ষিণেশ্বরে যাওয়া আসার পথে এই তারকেশ্বর মন্দিরে তাঁদের নিত্য যাওয়া আসা ছিল। এসব থেকে মন্দিরটির গুরুত্ব অনুধাবণ করা যায়। প্রতিবছর শ্রাবণ মাসে লাখ লাখ ভক্ত শ্যাওড়াফুলি থেকে গঙ্গার জল নিয়ে তারকেশ্বর পর্যন্ত প্রায় ৪০ কিমি পথ হেঁটে তারকেশ্বরের শিবের মাথায় জল ঢালেন।
শিবকে কেন্দ্র করে শ্রাবণ মাসের প্রতি সোমবার পালিত হওয়া উৎসবে গোটা দেশের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দুই বিন্দু এভাবেই একটি সূত্রে বাধা পড়ে যায়।
ছবি- সংগৃহীত।
- লেখক পরিচিতি-ঋতুপর্ণা কোলে। পিএইচডি গবেষক, বাংলা বিভাগ, অসম বিশ্ববিদ্যালয়।