মানসম্মান নামক কোনও বস্তু শরীরে অবশিষ্ট থাকলে শনিবার নিজের মনোনয়নটি চুপচাপ প্রত্যাহার করে নেবেন যশবন্ত সিনহা। লিখলেন উত্তম দেব-
শুক্রবার বিকেলে কলকাতায় ইসকনের রথ টানতে এসে মমতা যা বেচে গেলেন তার নামই কলা। সন্ধ্যায় নিশ্চয় দিল্লিতে দীনদয়াল ভবনে বসে মুচকি হাসছেন শাহ আর নাড্ডা। আর নিভৃতে হয়তো কপাল চাপড়াচ্ছেন এক বৃদ্ধ এই ভেবে যে শেষ বয়সে কী বেইজ্জতিটাই না হতে হল তাঁকে। আগামীকাল ( শনিবার ) রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন। রথযাত্রার দিন খোদ দলনেত্রী যেভাবে ঢাকঢোল পিটিয়ে তাঁর যাত্রাভঙ্গ ঘটালেন তারপর আর যশবন্ত সিনহার লড়াইয়ের রিংয়ে থাকার মানে হয় না। মানসম্মান নামক কোনও বস্তু শরীরে অবশিষ্ট থাকলে শেষদিনে নিজের মনোনয়নটি চুপচাপ প্রত্যাহার করে নেবেন যশবন্ত।
দিদির খেলা কে বুঝিতে পারে!
প্রথম দিন থেকেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে বিরোধী শিবিরে সবথেকে বেশি সক্রিয় ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দিল্লিতে গিয়ে কনস্টিটিউশন ক্লাবে সমস্ত বিরোধী দলকে নিয়ে গ্র্যান্ড মিটিং থেকে শুরু করে জোটের প্রার্থী হওয়ার জন্য এঁকে তাঁকে জোরাজুরি- সবেতেই সামনের সারিতে ছিলেন মমতা। শেষ পর্যন্ত সবাই মিলে মমতার দলের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি যশবন্ত সিংহকে প্রার্থী হিসেবে পছন্দ করলে যশোবন্ত তাঁর নেত্রীকে শতশত বাধাই ও শুকরিয়া জানিয়ে সানন্দে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে রাজি হয়ে যান। ১৭টা বিরোধীদলের সম্মিলিত প্রার্থী হিসেবে প্রাক্তন বিজেপি নেতা যশবন্তের নামে সিলমোহর পড়লে সিপিএম পর্যন্ত আলিমুদ্দিনের গোঁসার ধার না ধেরে নাচতে নাচতে যশবন্তের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। কলকাতার মিডিয়া কোরাস গাইতে থাকে- এই দ্যাখো দিদি কেমন খেলে দিলেন।
আগে জানলে তো দ্রোপদীর পাশেই থাকতেন মমতা!
কিন্তু কে জানত রথযাত্রার দিন দিদি এমন খেলে দেবেন যে খোদ জোটের রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীই ভিরমি খেয়ে যাবেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা হওয়ার আগে থেকেই সবার জানা এনডিএ যাঁকেই প্রার্থী করুক তাঁর বিজয় নিশ্চিত, কারণ ইলেক্টোরাল কলেজ এনডিএ-র অনুকুলে। তবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়-পরাজয়টাই বড় ব্যাপার নয়। অতীতে বহুবার হার নিশ্চিত জেনেও কংগ্রেস মনোনীত রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রার্থী দিয়েছে বিরোধীরা। এনডিএ শিবির প্রার্থীর নাম ঘোষণা করার আগেই যশবন্ত সিংহকে তাদের রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করে একটু চমকেই দিয়েছিল বিরোধীরা। কিন্তু তার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই বিজেপি যে চাল চালল তাতে বিরোধীদের চমক নিতান্তই ফিকে হয়ে গেল। মিডিয়া তখন বলতে লাগল- বুঝেছো, একেই বলে মাস্টার স্ট্রোক! নিজেদের প্রার্থীর জয়ের পথে যাতে কোনও রকমের কাঁটা না থাকে তা নিশ্চিত করতেই মোদী-শাহ-নাড্ডা নিজেদের আস্তিন থেকে তাস বের করেন একেবারে শেষ বেলায়। এখন মমতা বলছেন- “বিজেপি আগে জানায় নি, তাঁরা এক আদিবাসী মহিলাকে প্রার্থী করছে। তাহলে অন্যভাবে ভাবতাম।”
যেই মমতা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জবরদস্ত বিরোধী প্রার্থী দেওয়ার জন্য এত লম্ফঝম্ফ করলেন সেই মমতাই প্রকাশ্যে বলে দিলেন- “দ্রৌপদী মুর্মুরই জয়ের সম্ভাবনা বেশি।” মমতা আরও যা বললেন- “আমি আদিবাসী, দলিত সবাইকে সমর্থন করি। আমার অন্যরকম সেন্টিমেন্ট কাজ করে। এনডিএ যে দ্রৌপদী মুর্মুকে প্রার্থী করবে সেটা আগে জানলে অন্যভাবে ভাবতাম।” মমতা এই বক্তব্য মুখ থেকে বের করা মাত্রই আলোর বেগে মিডিয়ায়, সোস্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে সজ্ঞানে বুঝে শুনেই রথযাত্রার সমারোহের মধ্যে তাঁর ‘মন কি বাত’ দেশবাসীকে শোনালেন তা বুঝতে কারোরই অসুবিধা হচ্ছে না। সামাজিক মাধ্যমে নির্মল মাজির ‘সারদা-মমতা’ তত্ত্ব নিয়ে খিল্লি না ফুরোতেই মমতা-যশবন্ত নিয়ে নতুন খিল্লি শুরু হয়ে গেছে। নেটাগরিকেরা বলছে- শেষে বুড়োটাকে গাছে তুলে দিয়ে মই সরিয়ে নিলেন দিদি! বঙ্গের বাম সমর্থকদের অবস্থা সবথেকে শোচনীয়। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে তৃণমূলের নেতাকেই সমর্থন করলেন সীতারাম ইয়েচুরি। নিষ্ফল আক্রোশে ঘটনাটা তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না আলিমুদ্দিনের কমরেডদের। এখন খোদ তৃণমূল সুপ্রিমোই যখন বিজেপির রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীর জয়ের সম্ভাবনা বেশি দেখছেন তখন সাধারণ বাম সমর্থকেরা মুখ ছোটাতে ছাড়বে কেন? ফেসবুকে নিজেদের ক্যাপ্টেন ইয়েচুরির ইজের নিয়ে টানাটানি শুরু করে দিয়েছেন বাংলার বামপন্থীরা।
শেষ পর্যন্ত যশবন্তের পাশে থাকবে তো তৃণমূল?
শুক্রবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে যা বললেন তারপর রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক- শেষ পর্যন্ত নিজেদের প্রার্থীকে ভোট দেবে তো তৃণমূল? কারণ মমতার কথার মধ্যে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার একটা হালকা ইঙ্গিতও খুঁজে পাচ্ছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। দ্রৌপদী মুর্মু বিজয়ী হলে তিনিই হবেন দেশের প্রথম আদিবাসী রাষ্ট্রপতি। ইতিমধ্যেই এনডিএ’র বাইরে থাকা একাধিক দল দ্রৌপদী মুর্মুকে সমর্থন জানিয়েছে। যশবন্তের পক্ষে থাকা উদ্ধব থ্যাকারের শিবসেনা মহারাষ্ট্রে ছত্রভঙ্গ। এমনকি বিরোধী শিবিরের একাধিক দলের আদিবাসী জনপ্রতিনিধিরা, দলের হুইপ অমান্য করে দ্রৌপদী মুর্মুকেই তাঁদের প্রথম পছন্দের ভোটটি প্রদান করতে পারেন, এমন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও তাঁর দলের বিধায়ক-সাংসদের মতিগতি নিয়ে ধন্ধে আছেন। রাষ্ট্রপতি ভোটের দিন পশ্চিমবঙ্গ থেকে বড় মাত্রায় ক্রশভোটিং হয়ে গেলে তৃণমূলকে লজ্জায় পড়তে হবে। মহারাষ্ট্রে শিবসেনার পরিণতি দেখার পর মমতা আগেভাগেই সতর্ক হয়ে যেতে চাইছেন বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
Photo Credit- Official FB page of Mamata Banerjee.