রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে ঘিরে খুব একটা টানাপোড়েনের সুযোগ থাকে না। কিন্তু ঘটনাচক্রে ১৯৬৯-এর পঞ্চম রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ছিল ব্যতিক্রম।লিখলেন উত্তম দেব-
দোরগোড়ায় দেশের ষোড়শ রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। ভারতের রাষ্ট্রপতি সাংবিধানিক প্রধান মাত্র। সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় এটাই নিয়ম। সংসদীয় গণতন্ত্রে রাষ্ট্রপতি সরকারের অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সঙ্গে দেশের জনগণের সরাসরি কোনও যোগাযোগ নেই। রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচিত করেন জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। সংসদের দুই কক্ষের নির্বাচিত সাংসদ ( মনোনীত সাংসদরা ভোটদানের অধিকারী নন।) এবং রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের বিধানসভাগুলির নির্বাচিত বিধায়করাই কেবল রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগ পান। তাই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ফলাফল কী হবে তা আগে থেকেই আন্দাজ করা যায়। এই কারণেই অধিকাংশ সময় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন একটা আনুষ্ঠানিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় মাত্র। দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৫২-র দোসরা মে। সেই নির্বাচনে প্রত্যাশা মতোই বিপুল ভোটে জিতেছিলেন রাজেন্দ্র প্রসাদ । যদিও ১৯৫০-এর প্রথম প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন থেকেই তিনি ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি। ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের ৭২ বছরের ইতিহাসে মাত্র একবারই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে ঘিরে টানটান উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল। এবং সেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে-পরের প্রতিক্রিয়া আধুনিক ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের গতিপথকে পর্যন্ত ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল।
জাকির হুসেনের মৃত্যু ও অসময়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন
দেশের তৃতীয় রাষ্ট্রপতি জাকির হুসেন মেয়াদ পূর্ণ করে যেতে পারেন নি। কর্মরত অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয় ১৯৬৯-এর ৩ মে। সেই সময় উপরাষ্ট্রপতি ছিলেন ভিভি ( বরাহগিরি ভেঙ্কটগিরি) গিরি। রাষ্ট্রপতির আকস্মিক মৃত্যুতে ২০ জুলাই পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন ভিভি গিরি। ৬৯-এর ১৪ জুলাই পঞ্চম রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের দিন ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। ১৬ অগাস্ট নির্বাচনে দিন নির্ধারিত হয়। তার আগে থেকেই অবশ্য মধ্যবর্তী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে ঘিরে পর্দার পেছনে কলকাঠি নাড়ানোর খেলা শুরু হয়ে গিয়েছিল। রাজনীতিতে খেলা শুরুরও একটা খেলা থাকে। সেই খেলার সূত্রপাত আরও আগে। প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর অকাল ও রহস্যজনক মৃত্যুর পর থেকেই জাতীয় কংগ্রেসের ঘরে ঠান্ডাযুদ্ধের শুরুয়াৎ।
কামরাজের চালে দেশাই মাৎ, ইন্দিরার প্রধানমন্ত্রীত্ব লাভ
শাস্ত্রীর মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রীর কুর্শিতে কংগ্রেসের প্রবীণ নেতাদের অধিকাংশেরই পছন্দের পাত্র ছিলেন মোরারজি দেশাই। সেই সময় কংগ্রেসের সংগঠনে সবথেকে প্রভাবশালী নেতা হয়ে উঠেছিলেন কে কামরাজ। কামরাজ সিন্ডিকেট কংগ্রেসের পান্ডা হলেও লালবাহাদুরের উত্তরসূরী হিসেবে মোরারজির থেকে ইন্দিরাকেই বেশি নির্ভরযোগ্য মনে করেছিলেন। ধুরন্ধর কামরাজের ধারণা ছিল- রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ ইন্দিরাকে তাঁদের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা অনেক সহজ হবে। কামরাজ কংগ্রেসের ভেতরে ইন্দিরাকেই প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসানোর তদ্বির শুরু করলেও রাস্তা ছাড়লেন না মোরারজি দেশাই। দেশাই কংগ্রেস সংসদীয় দলে ভোটাভুটি দাবি করলে কামরাজ ইন্দিরার হয়ে সমর্থন জোটানোর কাজে নেমে পড়েন। মূলতঃ কামরাজের চালেই মোরারজি দলে একঘরে হয়ে পড়েন। ভোটাভুটিতে দেখা গেল ইন্দিরার পক্ষে পড়েছে ৩৫৫টি ভোট। দেশাইয়ের ঝুলিতে মাত্র ১৬৯। ১৯৬৬-র ১৯ জানুয়ারি ভারতের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন ইন্দিরা গান্ধী।
৬৭-র সাধারণ নির্বাচনে জোর ঝটকা কংগ্রেসে
কংগ্রেসের ভেতরে ও বাইরে সবাই ভেবেছিলেন, ইন্দিরাকে পর্দার পেছন থেকে চালনা করবেন দলের প্রভাবশালী সিন্ডিকেট লবি। কিন্তু অচিরেই সকলের ভুল ভাঙে। ইন্দিরা স্বাধীনভাবে নানা পদক্ষেপ নিতে শুরু করতেই সিন্ডিকেটের নেতাদের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বাড়তে থাকে। কামরাজও বুঝতে পারেন, নেহেরুর বেটিয়া মোটেই ‘গুঙ্গি গুড়িয়া’ নয়, তাঁকে নিয়ন্ত্রণে রাখা কার্যত অসম্ভব। কংগ্রেসের ভেতরে ইন্দিরার সঙ্গে সিন্ডিকেটের ঠান্ডাযুদ্ধ তীব্রতর হয়। কংগ্রেসের সাধারণ কর্মী-সমর্থক ও তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ইন্দিরার জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছিল কিন্তু তখনও দলের সংগঠনের রাশ প্রবীণ নেতাদের হাতে। এই প্রবীণ নেতারা তাঁর পিতার জামানার। ইন্দিরা আতঙ্কে থাকতেন- কে কামরাজ, এস নিজলিঙ্গাপ্পা, এস কে পাটিল, মোরারজি দেশাই, নীলম সঞ্জীব রেড্ডি, অতুল্য ঘোষ এবং সি এম পুনাচার মতো হেভিওয়েট নেতারা তাঁকে যে কোনও মুহুর্তে পদ থেকে সরিয়ে দেবে। সাতষট্টির সাধারণ নির্বাচনের আগে কংগ্রেসের অন্দরে ‘সিন্ডিকেট’ বনাম ইন্দিরা ডামাডোল চরমে ওঠে। সিন্ডিকেটের নেতারা তখন ইন্দিরাকে ঘাড় থেকে নামাতে পারলে বাঁচেন। দলের মধ্যেকার এই গভীর অন্তর্দ্বন্দ্ব নির্বাচনের ফলেও প্রতিফলিত হয়। স্বাধীনতার বিশ বছরের মাথায় কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা জোর ধাক্কা খেয়েছিল- সাতষট্টির নির্বাচনে। লোকসভায় এক ধাক্কায় ৭৮টি আসন হারায় কংগ্রেস। গুজরাট সহ সাতটি রাজ্যে কংগ্রেস বিরোধীদের পেছনে থাকে। রাজধানী দিল্লির সাতটি আসনের মধ্যে ছয়টিই দখল করে জনসংঘ। চার শতাংশ জন সমর্থন খুইয়ে কংগ্রেসের ভোট নেমে আসে ৪০.৭৮-এ। এক লপ্তে নয়টি রাজ্যে ক্ষমতাচ্যুত হয় দেশের সর্বাধিক শক্তিশালী রাজনৈতিক দল। তখন জাতীয় কংগ্রেসের বয়স চুরাশি। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলেন, ভারতের রাজনীতিতে কংগ্রেসের অবক্ষয়ের সূচনা ১৯৬৭ থেকেই।
সিন্ডিকেটের চাপে কোনঠাসা ইন্দিরা
নির্বাচনের পর কুর্শি আগলে রাখতে পারলেও সিন্ডিকেটের চাপে মোরারজি দেশাইকে ক্যাবিনেটে দুই নম্বর জায়গাটি ছাড়তে বাধ্য হন ইন্দিরা গান্ধী। মোরারজি হন সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রী, সেই সঙ্গে হাতে পান অর্থ মন্ত্রকও। মোরারজি দেশাইকে মেনে নেওয়া ছিল ইন্দিরার জন্য সাপের ছুঁচো গেলার মতো। দলের মধ্যে নীতির প্রশ্নে দু’জন ছিলেন দুই মেরুতে। উভয়ের ব্যক্তিগত সম্পর্কও ছিল চরম শীতল। মোরারজি ছিলেন ইন্দিরার ক্যাবিনেটে সিন্ডিকেটের ঘুঁটি। দলের শীর্ষ মহলে ইন্দিরা কার্যত একঘরে হয়ে পড়েন। এবং সরকারের কাজে সিন্ডিকেট লবির হস্তক্ষেপে তিনি দিনে দিনে বিব্রত হতে থাকেন। যদিও কংগ্রেসের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে ঘিরে কংগ্রেসে গৃহযুদ্ধ
কংগ্রেসে সিন্ডিকেট বনাম ইন্দিরার ঠান্ডাযুদ্ধ যখন ক্রমেই গৃহযুদ্ধের দিকে গড়াচ্ছে ঠিক সেই সময় রাষ্ট্রপতি জাকির হুসেনের মৃত্যু। সিন্ডিকেট কংগ্রেসের নেতারা লোকসভার অধ্যক্ষ নীলম সঞ্জীব রেড্ডিকে রাইসিনা হিলের সবথেকে সুরম্য ও সুবৃহৎ প্রাসাদটিতে পাঠানোর তোড়জোড় শুরু করতেই প্রমাদ গোনেন ইন্দিরা। ইন্দিরা আশঙ্কা করলেন, অদূর ভবিষ্যতে তাঁর কাছ থেকে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ার কেড়ে নিতেই ষড়যন্ত্র করে রেড্ডিকে রাষ্ট্রপতি পদে বসাতে চাচ্ছে সিন্ডিকেটের নেতারা। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ইন্দিরা দলিত নেতা জগজীবন রামের নাম প্রস্তাব করলেও ভোটাভুটিতে তা খারিজ হয়ে যায়। প্রকাশ্যে নীলম সঞ্জীব রেড্ডির হয়ে মনোনয়ন জমা দিয়ে এলেও ভেতরে ভেতরে অন্য খেলা খেলতে শুরু করে দেন প্রধানমন্ত্রী। ১৯৬৯-এর ২০ জুলাই আচমকাই ভিভি গিরি উপরাষ্ট্রপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে নির্দল প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা করতেই বিষয়টা সবার কাছে পরিস্কার হয়ে যায়।
বামেদের সমর্থন ইন্দিরার প্রার্থী ভিভি গিরিকে
রাষ্ট্রপতি ভোট সম্পূর্ণ গোপন ব্যালটে হলেও লোকসভা-রাজ্যসভা ও বিধানসভার ভেতরে দলগুলি তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে সদস্যদের প্রতি হুইপ জারি করতে পারে। ঊনসত্তরের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে যখন কংগ্রেসের ভেতর হুইপ জারির প্রসঙ্গ উঠল তখন লোকসভার নেতা হিসেবে নীলম সঞ্জীব রেড্ডির হয়ে হুইপ জারি করতে অস্বীকার করলেন ইন্দিরা। পরিবর্তে বিবেক ভোট দেওয়ার ডাক দিলেন তিনি। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে ঘিরে দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল আড়াআড়ি বিভাজিত হয়ে গেল। সিন্ডিকেট কংগ্রেসের নেতারা বুঝতে পারলেন- ভিভি গিরির হয়ে ময়দানে নেমে পড়েছেন ইন্দিরা। গিরিকে জেতাতে প্রকাশ্যে ও আড়ালে তৎপরতা শুরু করে দেন প্রধানমন্ত্রী। গিরির হয়ে সমর্থন জোটাতে রাজ্যে রাজ্যে সফরে বেরোন ইন্দিরা গান্ধী। নিজের দল ছাড়িয়ে অন্য দলের কাছেও ভিভি গিরিকে জেতাতে তদ্বির শুরু করেন নেহেরু কন্যা। দীর্ঘদিন শ্রমিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার সুবাদে ভিভি গিরি ছিলেন বামপন্থীদের ঘনিষ্ঠ। সেই সময় ব্যাঙ্ক ও বীমা জাতীয়করণ সহ একাধিক পদক্ষেপ দ্বারা দেশের বাম শিবিরের আস্থাভাজন হয়ে উঠেছিলেন ইন্দিরা। ইন্দিরা গান্ধীর আবেদনে সাড়া দিয়ে দুই কমিউনিস্ট পার্টি সহ অন্যান্য বাম দলের এমপি-এমএলএ’রা ভিভি গিরিকে ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
রেড্ডি হারলেন, সিন্ডিকেটের নেতাদের মুখ পুড়ল
ঊনসত্তরের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিরোধী জনসংঘ ও স্বতন্ত্র পার্টির হয়ে প্রার্থী হয়েছিলেন সি ডি দেশমুখ। সিন্ডিকেটের নেতারা যখন দেখলেন বামপন্থীদের সমর্থন আদায়ের পাশাপাশি কংগ্রেসের ভোটেও বড়সড় ভাঙন ধরাতে সক্ষম হবেন ইন্দিরা, তখন তাঁরাও জনসংঘে ও স্বতন্ত্র পার্টির দ্বারস্থ হলেন। জনসংঘ ও স্বতন্ত্রের জনপ্রতিনিধিদের কাছে সিন্ডিকেট কংগ্রেসের তরফ থেকে আবেদন জানানো হল- তাঁরা যেন দ্বিতীয় পছন্দের ভোটটি নীলম সঞ্জীব রেড্ডির অনুকুলেই দেন।
টানটান উত্তেজনার মধ্যে পঞ্চম রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ভোটগ্রহণ পর্ব মিটেছিল ১৯৬৯-এর ১৬ অগাস্ট। চারদিন পর দিল্লিতে গণনা শুরুর পর দেখা গেল রেড্ডি আর গিরিতে কাটে কা টক্কর। লোকসভা-রাজ্যসভা মিলিয়ে কংগ্রেসের মোট ৪৩১ জন সাংসদ ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছিলেন। ২৬৮ জনের ভোট গিয়েছিল নীলম সঞ্জীব রেড্ডির পক্ষে। ১৬৩ জন ভোট দেন ভিভি গিরিকে। ১৭টি রাজ্যের মধ্যে ১১ টি রাজ্যেই সংখ্যাগরিষ্ঠ বিধায়কদের ভোট নিজের অনুকুলে টেনে নেন ভিভি গিরি। এই ১১ টিই ছিল কংগ্রেস শাসিত রাজ্য। মাত্র একটি কংগ্রেস শাসিত রাজ্যে জয়লাভ করেন নীলম সঞ্জীব রেড্ডি।
প্রাথমিক গণনায় ইলেক্ট্রোরাল কলেজে ভিভি গিরি পেয়েছিলেন ৪ লক্ষ ১ হাজার ৫১৫ টি ভোট। নীলম সঞ্জীব রেড্ডির জোটে ৩ লক্ষ ১৩ হাজার ৫৪৮ টি ভোট। সি ডি দেশমুখের ভোট ছিল ১ লক্ষ ১২ হাজার ৭৬৯ টি। আরও কয়েকজন প্রার্থী ছিলেন। তাঁদের প্রাপ্ত ভোট নগণ্য। দ্বিতীয় পছন্দের ভোট যোগ করে চূড়ান্ত গণনায় ভিভি গিরি পান ৪ লক্ষ ২০ হাজার ৭৭ ভোট, নীলম সঞ্জীব রেড্ডির ভোট দাঁড়ায় ৪ লক্ষ ৫ হাজার ৪২৭। ভোটের ফল ঘোষণা হতেই কংগ্রেসের ঘরে ধুন্ধুমার কান্ড বেঁধে যায়। সেই সময় কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন এস নিজলিঙ্গাপ্পা। কামরাজের পরেই তিনি ছিলেন সিন্ডিকেট কংগ্রেসের অন্যতম কান্ডারী। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে নিজের পছন্দের প্রার্থী ভিভি গিরিকে জিতিয়ে আনার পর ইন্দিরার আত্মবিশ্বাস বহু গুণ বেড়ে গেল। ইন্দিরা উপলব্ধি করতে পারলেন- দলের একেবারে শীর্ষে সিন্ডিকেটের প্রবীণ নেতাদের আধিপত্য থাকলেও প্রদেশ স্তরে তাঁদের জনপ্রিয়তা নেই। দলের মধ্যে সিন্ডিকেটের নেতাদের আরও কোনঠাসা করতে রাজ্যে রাজ্যে টহল দিতে শুরু করলেন ইন্দিরা। ইন্দিরার অভিসন্ধি বুঝতে পেরে তাঁকে অভিযুক্ত করে প্রকাশ্যে চিঠি লিখলেন নিজলিঙ্গাপ্পা। চিঠিতে কংগ্রেস সভাপতির অভিযোগ ছিল- ইন্দিরা ও তাঁর দোসররা দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রকে নষ্ট করতে অন্তর্ঘাতে লিপ্ত হয়েছেন। জবাবে নিজলিঙ্গাপ্পা আহূত দলীয় বৈঠক বর্জনের পথে হাঁটলেন ইন্দিরা ও তাঁর অনুগামীরা। এর পর বাকি রইল কেবল কংগ্রেসের আনুষ্ঠানিক ভাঙন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রায় তিন মাস পর সেটাই ঘটল ১৯৬৯-এর ১২ নভেম্বর।
শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস ভাঙলই
১৯৬৯- এর ১২ নভেম্বর দিল্লির এআইসিসি সদর দফতরে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক ডাকলেন সভাপতি এস নিজলিঙ্গাপ্পা। একই দিনে পাল্টা সভা বসল প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে। কংগ্রেস দফতরে বৈঠক শেষে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ইন্দিরা গান্ধীকে দল থেকে বহিষ্কারের কথা ঘোষণা করলেন নিজলিঙ্গাপ্পা। এই ঘোষণার কিছুক্ষণের মধ্যেই এআইসিসি’তে ধস নামল- ৭০৫ জনের মধ্যে ৪৪৬ জনই ইন্দিরার শিবিরে যোগ দিলেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে যে কংগ্রেস তার নাম হল কংগ্রেস ( আর ) বা কংগ্রেস ( রিকুইজিশনিস্ট)। যদিও সিন্ডিকেট নেতাদের দ্বারা পরিচালিত সংগঠন কংগ্রেসের বিপরীতে ইন্দিরার নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠী রাজনৈতিক মহলে জনপ্রিয়তা পেল নব কংগ্রেস নামেই।
কংগ্রেসে যৌথ নেতৃত্বের অবসান
ঊনসত্তরে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ঘিরে জট না পাকালেও প্রবীণ-নবীন দ্বন্দ্বে কংগ্রেসে ভাঙনটা ছিল অবধারিত। জাকির হুসেনের আকস্মিক মৃত্যুর জেরে অসময়ের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কংগ্রেসের বিভাজনকে ত্বরান্বিত করেছিল মাত্র। যৌথ নেতৃত্বে চলা সংগঠন কংগ্রেস অচিরেই পর্যুদস্ত হয়ে কালের গর্ভে হারিয়ে যায়। ইন্দিরার নব কংগ্রেসই ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের স্বত্ত্বাধিকারী লাভ করে। তবে এই কংগ্রেসের অভ্যন্তরে যৌথ নেতৃত্বের অবসান ঘটে চিরদিনের জন্য। কংগ্রেসের ডিএনএ থেকে এতদিনে যৌথ নেতৃত্বের ধারা লুপ্ত হয়েছে বলা চলে।
Photo sources- collectd from different sources. Feature image is representational.