একুশের ২ মে বিজেপির নবান্ন দখলের স্বপ্নভঙ্গের পরেও অর্জুন সিং যে এতদিন পদ্মপত্রে ছিলেন এটাই তো অনেক বেশি। তৃণমূলের ক্যামাক স্ট্রিট শাখা সহায় না হলে এত তাড়াতাড়ি মনে হয় অর্জুনের ঘর ওয়াপসি সম্ভব হত না। বিশেষ প্রতিবেদন-
অর্জুন সিং যে ফুল বদল করবেন বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই সেই ইঙ্গিত মিলছিল। দল বদল বিষয়টা ভাটপাড়ার অর্জুনের কাছে নতুন নয়। বিজেপির কর্মী-সমর্থকেরা যদি অর্জুনের দলত্যাগে শকড হয়ে থাকেন তবে তাঁদের বলতে চাই- তাঁরা কি আশা করেছিলেন মাত্র তিন বছরেই অর্জুন সিং বিজেপির নীতি-আদর্শের প্রতি আত্মনিবেদিত প্রাণ একজন সৈনিক হয়ে উঠেছিলেন? অর্জুনের কোন ঠেকাটা পড়েছে চিরকাল বিজেপির ঝান্ডা কাঁধে বহন করার? রাজ্য রাজনীতির হাঁড়ির খবর যাদের রাখতে হয় তাঁরা ভালোই জানেন, ব্যারাকপুরের সাংসদ কোন পিচে ব্যাটিং করে অভ্যস্ত। আপনি যে দলেরই একনিষ্ঠ সমর্থক হোন না কেন, দলবদলুদের কাছ থেকেও যদি আপনি আপনার দলের প্রতি চিরস্থায়ী আনুগত্য আশা করে বসে থাকেন, তাহলে বুঝতে হবে আপনি একটা আস্ত বোকা। যেই লোক রাজনৈতিক জীবনে দু’বার পাল্টি খেয়েছে। সেই লোক তিন নম্বর বার পাল্টি খেলে মহাভারত কী এমন অশুদ্ধ হয়?
ক্যামাক স্ট্রিট হয়ে অর্জুনের ঘর ওয়াপসি
যেদিন ভাটপাড়ায় অর্জুন সিংকে রামনবমীর মিছিলে তৃণমূলের বিধায়কের পাশাপাশি হাঁটতে দেখা গিয়েছিল সেদিনই অনেকে বুঝে ছিলেন অর্জুন কালীঘাটে পৌঁছানোর রাস্তা পরিস্কার করতে লেগে গিয়েছেন। ঘর ওয়াপসির হোম ওয়ার্ক নিশ্চয় তার বহু আগেই শুরু। এখন তো আবার ঘরে ফিরতে চাইলে কালীঘাটে না গিয়ে ক্যামাক স্ট্রিটে গেলেই চলে। শোনা যাচ্ছে, অর্জুনকে ঘরে ফেরানোর যাবতীয় পরিকল্পনা কালীঘাটের হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট থেকে নয়, করা হয়েছে ক্যামাক স্ট্রিট থেকে। এর আগে বাবুল সুপ্রিয়কেও আমরা দেখলাম ক্যামাক স্ট্রিট ধরেই তৃণমূলে ঢুকতে। তবে কি এখন ক্যামাক স্ট্রিট ধরে তৃণমূলে পৌঁছানোটাই বেশি সহজ মনে হচ্ছে? রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন, ক্যামাক স্ট্রিট কাউকে দলে নিতে চাইলে কালীঘাটের আপত্তি শেষ পর্যন্ত খুব একটা বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। যত দূর জানা যাচ্ছে, ভাটপাড়ার অর্জুনকে ফেরানোর ব্যাপারে যতটা আগ্রহ ক্যামাক স্ট্রিটের ছিল ততটা আগ্রহ কালীঘাটের ছিল না।
লোকসভায় টিকিট না পেয়ে পদ্মে ভিড়েছিলেন অর্জুন
চক্ষুলজ্জা, পাতলা চামড়া এবং স্মৃতি কাতরতা- এই সব যাঁর বেশি বেশি আছে, আর যাই হোক রাজনীতি তাঁর জায়গা নয়। তিন বছর আগের ঘটনা- লোকসভায় টিকিট জুটবে না ইঙ্গিত পেয়েই তলে তলে বিজেপিতে ইট পাতার কাজ শুরু করেন অর্জুন সিং। মুকুল রায় তখন এইসব ব্যাপারে বিজেপির আঁড়কাঠির কাজ করছেন। দু’জনেই তৃণমূলে থাকতে মুখ দেখাদেখি ছিল না। কিন্তু ওই যে বললাম, রাজনীতি আত্মসম্মানের জায়গাই নয়। তাই মুকুলকে চ্যানেল করেই বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মন পেতে কোনও অসুবিধা হয় নি অর্জুনের। এদিকে অর্জুনের মতিগতি সুবিধের নয় বুঝতে পেরেই তাঁকে দলে ধরে রাখতে উঠেপড়ে লাগেন মমতা। কিন্তু অর্জুনকে যারা ব্যক্তিগতভাবে চেনেন তাঁরা ভালোই জানেন একবার গোঁ উঠলে অর্জুনকে ফেরানো মুশকিল। তখন লোকসভা নির্বাচনের ডামাডোল বেজে গিয়েছে। তৃণমূলের প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত। এক সন্ধ্যায় হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাড়িতে অর্জুন সিংকে ডেকে পাঠান তৃণমূল সুপ্রিমো। কলকাতা-দিল্লি ফ্লাইটের টিকিট বুক করে কালীঘাটে গিয়ে অর্জুন নেত্রীকে দলত্যাগ না করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বেরিয়েই গাড়ি ছোটান দমদম বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে। রাতেই দিল্লি পৌঁছে পরদিন সকালে দীনদয়াল ভবনে গলায় বিজেপির উত্তরীয় ধারণ।
নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যত ভেবেই ফের ফুল বদল
পাটের দরদাম নিয়ে জেসিআই-এর বিরুদ্ধে সুর চড়ানো। রাজ্য বিজেপির সাংগঠনিক বিষয় নিয়ে অসন্তোষ- এইসব তো ছিল অর্জুন সিংয়ের বাহানা। অর্জুন বরাবরই লক্ষ্যে স্থির। আদর্শ ধুয়ে জল খাওয়ার মানুষ তিনি নন। ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল হচ্ছে অর্জুন সিংয়ের বৃহত্তর রাজনৈতিক ক্ষেত্র। আর ভাটপাড়া হচ্ছে অর্জুনের রাজনৈতিক ভরকেন্দ্র। উনিশে ব্যারাকপুর থেকে যেই মার্জিনে অর্জুন সিং জিতেছিলেন, লোকসভার নিরিখে ওটা কোনও মার্জিনই না। একুশের বিধানসভা নির্বাচনে ভাটপাড়া ছাড়া ব্যারাকপুর লোকসভার অন্তর্গত বাকি ছয়টি সিটেই বিজেপি হেরেছে। অর্জুন সিংয়ের বিশাল সাংগঠনিক ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা থাকলে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে বিজেপির এমন শোচনীয় ফল হওয়ার কথা না। নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতেই যে অর্জুন সিংয়ের বিজেপি ত্যাগ, এটা বোঝার জন্য জন স্টুয়ার্ট মিলের মতো রাজনৈতিক পান্ডিত্যের অধিকারী হওয়ার দরকার নেই, কান্ডজ্ঞানই যথেষ্ট।
পাওনাগন্ডা নিয়ে রফা না করেই ঘরে ফেরার বান্দা নন
তৃণমূলে যোগদানের আগ মুহুর্ত পর্যন্ত অর্জুন সিং শুধু বিজেপির টিকিটে নির্বাচিত সাংসদই ছিলেন না ছিলেন রাজ্য বিজেপির সহ-সভাপতিও। অর্জুনের কাছে এই মুহুর্তে রাজ্য বিজেপির সহ-সভাপতিগিরির থেকেও অনেক বেশি জরুরী ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল ও ভাটপাড়ায় নিজের তালুক সামলানো। তিনটা বছর ক্ষমতাসীন দলের বাইরে। এই তিন বছরে অর্জুনের প্রাপ্তি তৃণমূল সরকারের কাছ থেকে দেড় শতাধিক মামলা। কিন্তু ঘরে আমদানি তলানিতে। মামলা-টামলার ভয় ভাটপাড়ার অর্জুন পান না। কিন্তু আমদানির মতো সিরিয়াস বিষয় নিয়ে তো ভাবতেই হয়। ক্যামাক স্ট্রিটের বসের সঙ্গে পাওনাগন্ডা নিয়ে পাকা একটা রফা না করেই অর্জুন দুম করে পুরোনো শিবিরে ফিরে এলেন- এমন ভাবার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।
শুভেন্দু বাদে সবাই ফিরে গেল ঘরে
মিডিয়ায় দিলীপ ঘোষের টিআরপি মূলতঃ বেফাঁস মন্তব্য করে বাজার গরম করার জন্য। কিন্তু দিলীপের এই কথাটা খাঁটি- “মানুষ গরু-ছাগল নয়। কেউ দল ছেড়ে যেতে চাইলে তাঁকে খুটায় বেঁধে রাখা সম্ভব নয়।” মন চলো নিজ নিকেতন বলে একুশের মে মাসের পর থেকে কত নেতাই তো মুরলীধর সেন লেন ছেড়ে কালীঘাট-ক্যামাকে ফিরে গেল। শুভেন্দু অধিকারী বাদে প্রায় সবারই ঘর ওয়াপসি সারা বলেই মনে হয়। রাজ্য বিজেপির ভাড়াটে সেনারা একে একে ভাগলবা। খুব সঙ্গত কারণেই শুভেন্দুকে নিয়েও গুঞ্জন তীব্র হয়েছে রাজনৈতিক মহলে। বিজেপির সাধারণ কর্মী-সমর্থকদের মধ্যেও নেতাদের প্রতি সন্দেহ-অবিশ্বাস-অশ্রদ্ধা জাঁকিয়ে বসেছে। সত্যি কথা বলতে কী! পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি এখন বিষ্ঠাপূর্ণ যেই নালায় গিয়ে নেমেছে, গঙ্গাজল ছুঁয়ে কেউ দল ও আদর্শের প্রতি অনুগত থাকার শপথ নিলেও আর বিশ্বাস করার কারণ নেই।
Photo Credit- AITC official FB page.